বাংলাদেশের প্রাক্তন সামরিক একনায়ক ও প্রসিডেণ্ট জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ আর নেই। বহু মৃত্যুর কর্তা এই জেনারেল এরশাদ স্বয়ং মৃত্যুর কাছে পরাস্ত হলেন।
জেনারেল এরশাদ যতো রাজনৈতিক কর্মীর জীবন নাশ করেছেন, তার চেয়েও বেশি রাজনৈতিক কর্মীর চরিত্র নাশ করেছেন তাঁর শাসনামলে। জাতীয় রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতাদের ডেকে নিয়ে প্রলোভন দেখিয়ে তিনি নিজের রাজনৈতিক দল ও সহযোগী সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন।
১৯৮২ সালের ২৪শে মার্চ তিনি যখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল ও সারাদেশে সামরিক আইন জারি করে নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ঘোষণা করেন, আমরা তার মাত্র কয়েক মাস আগে ডাকসুতে নির্বাচিত হই। তিনি প্রথম ডাকসুকে বাতিল ঘোষণা করেন, কিন্তু বিপদ আঁচ করে সে-ঘোষণা প্রত্যাহার করেন এবং সুচতুরভাবে ডাকসুর নেতাদের প্রলুব্ধ করে তাঁর দলে নেওয়ার চেষ্টা করেন। কারণ, ডাকসুর নেতৃত্বে থাকা বামপন্থীদের ব্যাপারে তাঁর যৌক্তিক ভীতি ছিলো।
ডাকসুর ইতিহাস হচ্ছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে ও জনগণের পক্ষে সংগ্রামের ইতিহাস। যে-ডাকসু স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেছিলো ১৯৭১ সালে, সে-ডাকসু স্বাধীনতার পর থেকে সকল স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়িয়েছিলো সেই ১৯৭৩ সালেও। ফলে, ডাকসুকে ভয় পাওয়ার কারণ ছিলো স্বৈরশাসক এরশাদের।
যদিও বর্তমানে এটি ভাবতেও হয়তো অসম্ভব মনে হতে পারে, কিন্তু এটিই ঐতিহাসিক সত্য যে, জাসদ-বাসদের ছাত্র সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগ (পরে যার একাংশ ছাত্রফ্রণ্ট নাম ধারণ করে) পর-পর তিনবার ডাকসুর নেতৃত্বে নির্বাচিত হয়। ১৯৭৯-৮০ শিক্ষাবর্ষে জাসদ ছাত্রলীগের মান্না-আখতার পরিষদ, ১৯৮০-৮১ শিক্ষাবর্ষে বাসদ ছাত্রলীগের মান্না-আখতার এবং ১৯৮১-৮২ শিক্ষা বাসদ ছাত্রলীগের আখতার-বাবলু পরিষদ ডাকসুতে বিপুল ভৌটে নির্বাচিত হয়।
ঐতিহাসিক কারণে বাসদ ছাত্রলীগের নেতৃত্বাধীন ডাকসুর ওপর দায়িত্ব পড়ে জেনারেল এরশাদের সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র-আন্দোলন গড়ে তোলার। আমরা ডাকসু ও বাসদ ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে প্রথম দিন থেকেই প্রতিবাদ মিছিল করি।
এখানে উল্লেখ করা উচিত যে, ঐতিহ্যগত কারণে জাসদ ছাত্রলীগও শুরু থেকেই তাদের নিজেদের অবস্থান থেকে প্রতিবাদী ভূমিকা পালন করে। সত্য বলতে, জেনারেল এরশাদের বিরুদ্ধে ছাত্র-আন্দোলন গড়ে তোলে মূলতঃ জাসদ-বাসদ ও অন্যান্য বামপন্থী দলের ছাত্র-সংগঠন-সমূহ, যাদের মধ্যে সিপিবির ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নও ছিলো।
জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আমাদের আন্দোলন গড়ে উঠলে তিনি ডাকসুর সদস্যদের প্রতি বার-বার নানা প্রলোভন দেখিয়ে তাঁর কাছে ডাকেন। আর, এই প্রক্রিয়ায় তিনি ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক জিয়াউদ্দিন বাবলু থেকে শুরু করে বেশ কয়েকজন নেতাকে তাঁর দলভুক্ত করতে সক্ষম হন।
আমাদের ডাকসুর যারাই এরশাদের ডাকে সাড়া দিয়েছেন, তাদের সবাইকে তিন মূল্য পরিশোধ করেছেন - কাউকে মন্ত্রীত্ব দিয়ে, কাউকে এমপিত্ব দিয়ে এবং কাউকে উপজেলার চেয়ারম্যানত্ব দিয়ে। কিন্তু, আমরা যারা তাঁর ডাকে সাড়া দিইনি, তারাই আপসহীন আন্দোলন চালিয়ে যাই। আর এ-আন্দোলনই নানা উত্থান-পতনে মধ্য দিয়ে স্বৈরশাসক এরশাদের পতন অনিবার্য করে তোলে, যা ১৯৯০ এর গণ-অভ্যূত্থানে আপাতঃ সাফল্য লাভ করে।
জেনারেল এরশাদ যে প্রথম থেকেই ডাকসুর নেতৃত্বকে প্রলুব্ধ করে কিনতে চেয়েছিলেন, তার সূচনা ঘটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাশাসনিক কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে নিমন্ত্রণপত্র পাঠানো মাধ্যেম। ১৯৮৩ সালের ২১শে অগাষ্ট আমাকে যে-নিমন্ত্রণপত্রটি পাঠানো হয় এবং আমি যা স্পর্ধার সাথে প্রত্যাখ্যান করেছিলাম, সেটির ছবি নীচে দিলাম।
আজ জেনারেল এরশাদের মৃত্যুতে সেই পুরনো স্পর্ধিত দিনগুলোর কথা স্বভাবতঃ স্মৃতি হয়ে উঠে এসেছে। আমি স্মরণ করছি আমাদের বন্ধু সেলিম, দেলোয়ার, বসুনিয়া, মিলন-সহ অনেক জানা-অজানা বন্ধু-সাথীদের, যারা একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে জীবন উৎসর্গ করেছেন।
কিন্তু হায়, গণতন্ত্র আজও সুদূর পরাহত! আজ প্রায় তিন দশক স্বৈরশাসক এরশাদ ক্ষমতায় নেই এবং এই মুহূর্তে তিনি আর পৃথিবীতেও নেই। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, বাংলাদেশে আর স্বৈরতন্ত্র নেই। স্বৈরশাসক এরশাদ নেই বটে, কিন্তু রেখে গিয়েছেন তাঁর স্মৃতি ও গতি।
EmoticonEmoticon