মঙ্গলবার, ১০ অক্টোবর, ২০১৭

"গল্প নয় সত্যি"- ০২

ছোট থেকেই পরিবারের মুখে একটা কথা শুনতাম আমি নাকি বদ রাগী৷ মাদ্রাসায় যাওয়ার পর সেটা চেঞ্জ হয়ে "বদ জ্বীন" এ পরিনিত হলো৷
সবাই বলতে শুরু করলো আমার সঙ্গে বদ জ্বীন রয়েছে ৷
ঐ পরিবেশে নিজেকে মানানোর জন্য কত যে গুমরে কেঁদেছি তার শেষ নেই—
দেখতে দেখতে একটি বছর পার় হয়ে গেলো৷
মাদ্রাসার লোকেশন চেঞ্জ করা হবে,ভাড়া বাড়ি থেকে নিজেদের তৈরী করা বাড়িতে উঠবে৷আব্বুর কর্মস্থল থেকে সেই জায়গার দূরত্ব অনেক ৷ তাই আব্বু বেশ টেনশনে পড়ে গেলেন- নিজের সমস্যা মাদ্রাসার প্রিন্সিপালের সাথে শেয়ার করলেন,  তিনি তার শ্বশুরের মাদ্রাসার ঠিকানা দিলেন যেটা আব্বুর কর্মস্থল থেকে খুবই কাছে৷
এরপর আমাদের সেখানেই ভর্তি করিয়ে দেয়া হলো৷আবার নতুন পরিবেশ!
সেখানকার নিয়ম বেশ কড়া৷ মাদ্রাসার প্রধানকে সবাই নানা বলে ডাকে, তার চার মেয়ে তিন ছেলে৷ এর আগে আমরা তার সেজো মেয়ের মাদ্রাসায় ছিলাম৷ তিন ছেলে -মেয়েদের ছোট৷ ছোট ছেলের নাম শিবলী,যে আমার সমবয়সী ছিলো৷ ছোট মেয়ে শামীমা তখনও বিয়ে হয়নি৷
ছয় মাসের মধ্যেই সেখানকার বেশকিছু বিষয় অসহ্য লাগতে শুরু হলো, মাদ্রাসার কড়া নিয়ম শুধু মাত্র ছাত্রীদের জন্য, অথচ শামীমার পোষাকআসাক বেশ ব্যাতিক্রম৷ মাদ্রাসার মধ্যেই সে মাঝে মাঝে শার্ট-পেন্ট পরতেন৷
যখন তখন অন্য বোনেদের বাসার কথা বলে বের হয়ে যেতেন৷ বেশ অহংকারীও ছিলো৷
একদিন রাতের খাবার আনার জন্য রান্নাঘরে গেলাম গিয়ে দেখি শামীমা খাবার বেড়ে দিচ্ছেন,আমার প্লেটে ডাল দেবার পর আমার চোখ কপালে উঠে গেলো-বড় সাইজের একটা তেলাপোকা৷
আমি সঙ্গে সঙ্গে বল্লাম আমি এই খাবার খাবোনা৷
সে বল্লো খাবার অপচয় কারী শয়তানের ভাই উপরের খাবারটুকু ফেলে বাকি খাবারটা খেয়ে ফেলো!  তার সাথে তর্কাতর্কির এক পর্যায় আমি খাবার সহ প্লেটটা ছুড়ে ফেলে দেই৷
সাথে সাথে সে আমার কান টেনে ধরে৷
তার সাথে আমার সমস্যার শুরু সেখানেই৷
তিনি আমাদের যে বিষয় ক্লাস নিতেন, আমি ভুল না করলেও তিনি কারনে অকারনে কান মলে দিতেন ,দিনদিন আমার ক্ষোভ বেড়েই চল্লো—
আব্বুকে বিষয়গুলো বলতাম সে শুধু বলতেন তাদের দোষ ধরলে পাপ হবে ৷৷
যশোরের এক হুজুর ছিলেন নাম আদিব, আদিব হুজুরকে আমার বেশ ভালো লাগত,তার সাথে আমার মনের বেশ মিল ছিলো আমার বয়সি তার একটা মেয়েছিলো -সে আমাকে খুব স্নেহ করত
আম্মু ছাড়া কথা বলতেন না ৷
প্রতিদিন ভাবতাম মাদ্রাসার ভিতরের সব কান্ড হুজুরকে বলবো কিন্তু আরো ছত্রীরা সঙ্গে থাকার জন্য বলা হয়ে উঠে না৷
মাদ্রাসা থেকে তখন আমার উপর পর্দা ফরজ করে দেয়া হলো হাত মোজা পা মোজা সহ বোরখা৷
আব্বুর কর্মস্থলে মাঝে মাঝে আমি আর আপু যেতাম ৷ সে বিষয়টা নানার পছন্দ হত না৷তা নিয়েও নানান হাদিস কোরান শুনাতেন ৷
অথচ তার নিজের মেয়েই সপ্তাহে অন্তত একবার মার্কেটে যেতেন-যদিও সে কথা তার বাবা জানতেন না ৷
আরো একটা বিষয় খারাপ লাগত নানার বড় দুই ছেলেও মাদ্রাসার ভিতরে যখন তখন ঢুকে পরত, অথচ তাদের বয়সও তখন পর্দারসমতুল্য৷
সব মিলিয়ে সেখানকার পরিবেশ দিনকে দিন অসহ্য লাগছিলো,কারন প্রতিটি ছাত্রির জন্য যে কড়া নিয়ম ছিলো৷কিন্তু তার সন্তানরা যা তা করে বেড়াতো৷
একবার ঈদের ছুটিতে বাড়ী গেলাম ৷ আব্বুর চাচাতো ভাইয়ের শালা এসেছিলেন বোনের বাড়ী ঈদ কাটাবেন৷
নাম ইব্রাহীম৷
ইব্রাহীম মামার সাথে সব সময় একটা ক্যামেরা থাকত৷ ছবি তুলতে বেশ পছন্দ করতেন৷ একদিন বিকেল বেলা পুকুর পাড়ে বসে আপু সহ বাড়ীর সমবয়সি সবাই সেখানে অাড্ডা দিচ্ছিলো, সেখানে ইব্রাহীম মামা ও ছিলেন, অনেক কথার পর বড় আপুকে মামা বল্লেন ভাগ্নি এসো তোমার একটা ছবি তুলি৷
আপু আপত্তি জানালেন বল্লেন ছবি তুল্লে পাপ হয় ৷
অনেক অনুরোধের পর আপু রাজি হলেন৷সেদিন আপু দাদীর ঈদের শাড়ি পরেছিলেন, পুকুর পাড়ের একটি উঠতি বয়সি মেহেরগুনি গাছের সাথে হেলান দিয়ে ছবি তুলেছিলো৷
মামা চলে যাবার আগে অনেক কথার ফাঁকে আমার থেকে মাদ্রাসার ঠিকানাটা নিয়েছিলেন ৷
ঈদের ছুটি শেষে আবার সেই বন্দি কারাগারে ফিরে এলাম৷ মাস খানেক পর হঠাৎ একদিন দপ্তর রুমে বড় আপুর ডাক পড়লো,সেদিন সেই ছবি তোলার অপরাধে বড় আপুকে জোড়া বেত দিয়ে দু হাতে চারটা বারি দিয়েছিলো৷
বিষয়টা আমি মেনে নিতে পারিনি৷আমার নম্র,শান্ত, ভদ্র বোনের উপর এমনটা কেন হবে ?  সেটা ভেবেই নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছিলামনা ৷
বরিশালের একটা মেয়ে ছিলো নাম হুমায়রা ৷ হুমায়রা আপু শামীমার খুব ঘনিষ্ঠ ছিলো,শামীমার সমস্ত কথা হুমায়রা জানত৷ কিছু একটা বিষয়ে তখন শামীমার সাথে তার মনমালিন্য চলছিলো৷
আপুকে প্রহার করা বিষয়টাও সে মেনে নিতে পারেনি, ইমোশোনালী সে শামীমার সমস্ত কথা আমাকে আর আপুকে বলে দিলো৷
একটা ছেলের সাথে তার সম্পর্ক ছিলো যার সাথে সে মাঝে মাঝে হুমায়রাকে নিয়ে দেখা করতে যেত৷ শামীমার চুল হাটু অবধি ছিলো সে যখন মার্কেটে যেত ইচ্ছে করেই চুলগুলো ছেড়ে দিতো উদ্দেশ্য অন্যরা তার লম্বা চুল দেখে আকর্ষিত হবে৷ সে যখন মাদ্রাসা থেকে বের হত মুখের নেকাপ খুলে ফেলতো৷
সেদিন রাতে ঘুমাতে পারছিলামনা৷ শরীরটা কেমন জ্বলছিলো, হুমায়রা আপুকে বল্লাম এসব বিষয়গুলো আমি আদিব হুজুরকে সব বলবো৷ সেও স্বায় দিলো, আমি সে রাতে বিস্তারিত লিখে আদিব হুজুরকে একটা চিঠি লিখলাম৷
পরদিন শুক্রবার ছিলো তাই হুজুর আসেননি৷চিঠিটা আমার ট্রাঙ্কের এক কোনে রেখে দিয়েছিলাম৷
শুক্রবারদিন সন্ধ্যায় মাদ্রাসার সব ছাত্রীদের এক রুমে ডাকা হলো বিষয় কি তখনও জানায়নি৷
সবাই যখন এক রুমে জমা হলাম তখন বাইরে থেকে দরজা লক করে দেয়া হলো৷
প্রায় আধঘন্টা পর দরজা খুলে দেয়া হলো যখন রুমে গেলাম দেখি আমার আর আপুর ট্রাঙ্কের সমস্ত জিনিস পত্র এলোমেলো ছড়িয়ে রয়েছে৷
মনের ভিতরে কেমন একটা মোচড় দিলো
বুঝতে পারলাম ঝামেলাটা হুমায়রা বাধিয়েছে কিন্তু কিছু না বলে চুপচাপ থাকলাম আর পরিস্থিতি কোনদিকে যায় তার অপেক্ষা করতে লাগলাম৷
পরিবেশ বেশ শান্ত কিচ্ছু হলোনা৷ পরদিন একটা কথা শুনে মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেলো৷ আদিব হুজুরকে চাকুরী থেকে বাদ দেয়া হয়েছে৷ হুজুর বারবার কারন জানতে চেয়েছিলেন বাট কোন উত্তর পাননি৷
সেদিন বিকেল বেলা আব্বু এলেন৷তাকে ডেকে পাঠানো হয়েছিলো ৷
আব্বু সেদিনও খুব বকাবকি করলেন দেন বল্লেন আমি যদি ভালো হয়ে না চলি তাহলে আমাকে আর কখনো বাড়িতে নিবেননা৷ মাদ্রাসাতেই থাকতে হবে৷
আমি আব্বুকে বল্লাম আজ যদি আপনি আমাদেরকে এখান থেকে সঙ্গে করে নিয়ে না যান তাহলে আমি যে কোন সময় এখান থেকে বের হয়ে যেদিকে ইচ্ছে চলে যাবো ৷
আব্বু কিছুক্ষন চুপচাপ দাড়িয়ে রইলেন, তারপর বড় আপুকে জিজ্ঞেস করলেন তুই ও কি এখানে থাকতে চাস না ৷
আপু মাথা নেড়ে আমার সাথে স্বায় দিলেন ৷ সেদিনই আব্বু আমাদেরকে সেখান থেকে নিয়ে এলেন.........


EmoticonEmoticon