১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের সহযোদ্ধা খন্দকার মোশতাক আহমেদ আওয়ামী-প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে যে-নজিরবিহীন নৃশংসতায় তাঁকে সপরিবারে হত্যা করিয়েছে, আমি আওয়ামী-বাকশালী রাজনীতির বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও শুরু থেকে শেষপর্যন্ত দৃঢ় নৈতিকতার ভিত্তিতে এই জঘন্য ষড়যন্ত্র ও হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা করি।
১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ পাক-হানাদার বাহিনীর দ্বারা আক্রান্ত হয়ে বাঙালী জাতি যে-স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু করেছিলো, তা তারা করেছিলো তাদের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নামে। এ-বিষয়ে কারও বিন্দুমাত্রও সন্দেহ থাকা উচিত নয়। এমনকি স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে যে মেইজর জিয়াউর রহমানের নাম কেউ কেউ বলে থাকেন, স্বয়ং তিনিও যা বলেছিলেন, তাও ঐ শেখ মুজিবুর রহমানের নামেই বলেছিলেন।
আমার মনে হয়, বাঙালী জাতির স্বাধীকার ও স্বাধীনতার জন্যে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালীর মননে ও হৃদয়ে যে অনন্য ও অসমান্তরাল স্থায়ী আসন করে নিয়েছিলেন, তারই প্রকাশ ঘটেছিলো ১৯৭০ সালের নির্বাচনে। সেই নির্বাচনে সমগ্র বাঙালী জাতি ভৌট দিয়েছিলো কোনো প্রার্থীর গুণ-বিচারে নয়, বরং শেখ মুজিবুর রহমানের নামে।
আমি মনে করি, 'জাতির পিতা' হিসেবে ঘোষিত শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর নামে স্বাধীন হওয়া দেশে নির্বাচন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সরকার প্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার মধ্যে নিয়ে যাওয়াটা বাঙালী জাতির উচিত হয়নি। 'জাতির পিতা' সংজ্ঞানুসারে জাতির অন্য সবার চেয়ে ঊর্ধ্বে, এবং সে-কারণেই তাঁকে তাঁর 'সন্তান'দের সাথে ক্ষমতার প্রশ্নে প্রতিযোগিতায় নামিয়ে আনা ঠিক নয়।
শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভূমিকা ও অসমান্তরাল অবস্থান বিবেচনা করে বাঙালী জাতির উচিত ছিলো তাঁকে সমস্ত প্রকারের প্রতিযোগিতা ও বিতর্কের ঊর্ধ্বে রেখে জাতির পিতা হিসেবে জাতীয় বিপ্লবের অথোরিটি ও জাতির কনশেন্স বা বিবেক হিসেবে অনেকটা ভারতের মোহনদাস গান্ধী বা ইরানের আয়াতুল্লাহ্ খোমেনীর মতো সর্ব-প্রকারের রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার বাইরে রাখা।
আর, শেখ মুজিবুর রহমানের উচিত ছিলো ১৯৭২ সালে দেশে ফিরে আসার পর, স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকল রাজনৈতিক দলকে একটি ঐক্যবৃত্তে নিয়ে এসে, তাজউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে একটি জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠনের নির্দেশ দিয়ে, তাদের সকলের মেণ্টর হিসেবে নির্বাহী ক্ষমতা থেকে দূরে থেকে একটি স্বাধীন, সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী জাতি হিসেবে গড়ে তোলার নির্দেশনা দান করা।
আমার বিশ্বাস, শেখ মুজিবুর রহমান যদি নির্বাহী ক্ষমতা না নিয়ে জাতির পথপ্রদর্শক ও বিবেক হিসেবে সবার ওপর 'পিতা' হয়ে থাকতেন, বাঙালী জাতি আজ স্বদেশে ও বিশ্বপরিমণ্ডলে অনেক ভালো অবস্থানে থাকতো।
শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবনের কারণে যে অটোক্র্যাসির জন্ম হয়েছিলো এবং তাতে বাঙালী জাতির যে ক্ষতি হয়েছিলো, তার চেয়ে বহুগুণ ক্ষতি হয়েছে ষড়যন্ত্র করে জাতির এই অনন্য ও সমান্তরাল নেতাকে নৃশংসভাবে হত্যা করার মধ্য দিয়ে।
১৫ই অগাষ্ট নিঃসন্দেহে বাঙালী জাতির জন্যে একটি শোকের ও রিফ্লেকেশনের দিন। এ-দিনটি থেকে আমরা যদি ঐতিহাসিক শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি, সেটিই হবে আমাদের অপূরণীয় ক্ষতির মধ্যেও প্রাপ্তি।
EmoticonEmoticon