রিপাবলিকঃ রাষ্ট্রপতি শাসিত না প্রধানমন্ত্রী শাসিত?
পৃথিবীর ১৯৮টি রাষ্ট্রের মধ্যে ১৫৪টি হচ্ছে রিপাবলিক। ৩৭টি সাংবিধানিক রাজতন্ত্র। ৬টি পরম রাজতন্ত্র। ১টিতে রাজতন্ত্র হলেও সংবিধানে অনির্দিষ্ট (থাইল্যাণ্ড)।
বিশ্বের ৩৭টি রাজতন্ত্রের মধ্যে ৯টিতে রাজা এক্সিকিউটিভ ক্ষমতা ধারণ করেন। বাকি ২৮টিতে রাজার ভূমিকা সেরিমোনিয়্যাল বা আনুষ্ঠানিক।
১৫৪ টি রিপাবলিকের মধ্যে ৪৪টির রাষ্ট্রপতি হচ্ছেন সেরিমোনিয়্যাল বা আনুষ্ঠানিক। বাকি ১০৯টি রিপাবলিকের রাষ্ট্রপতি এক্সিকিউটিভ ক্ষমতা ধারণ করেন এবং ১টিতে রাষ্ট্রপতি নেই, সে-স্থলে ডাইরেক্টোরেইট হচ্ছে এক্সিকিউটিভ ক্ষমতাধর (সুইৎজারল্যাণ্ড)।
১০৯টি রাষ্ট্রের মধ্যে ৬৩টি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি আইনসভা নিরপেক্ষ। অর্থাৎ, তিনি পার্লামেণ্টের অনুমোদন সাপেক্ষ নন। ৩০ রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি পার্লামেণ্টের অনুমোদন সাপেক্ষ নন, কিন্তু মন্ত্রীসভা পার্লামেণ্টের অনুমোদন সাপেক্ষ। ৯টি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রীসভা উভয়ই পার্লামেণ্টের আস্থা সাপেক্ষ।
পৃথিবীর ক্ষমতাশালী রিপাবলিকগুলো রাষ্ট্রপতি শাসিত, যেমন আমেরিকা, রাশিয়া, ফ্রান্স, চীন। এ-রিপাবলিকগুলোর রাষ্ট্রপতিগণ এক্সিকিউটিভ ক্ষমতা রাখেন এবং তাঁরা পার্লামেণ্টের ওপর নির্ভরশীল নন।
আমি মনে করি, রিপাবলিক হওয়ার উচিত রাষ্ট্রপতি শাসিত। লেজিসলেচার (আইনসভা) ও এক্সিকিউটিভের (প্রশনাসন) মধ্যে ব্যালেন্স অফ পাওয়ার (ক্ষমতার ভারসাম্য) এবং জুডিশিয়ারিকে (বিচার বিভাগ) স্বাধীন ও নিরপেক্ষ রাখলেই গণতন্ত্র ভালো কাজ করে বলে আমার ধারণা।
প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রী পরিষদ শাসিত রাষ্ট্রগুলো প্রধানতঃ রাজতন্ত্র বা রাজতন্ত্রের ডোমেনিয়ন - যেমন, যুক্তরাজ্য, অষ্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যাণ্ড। আবার, অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, এসময়কার রাজতন্ত্রের ডোমেনিয়িন এখনও প্রধানমন্ত্রীত্বের নেতৃত্বাধীন মন্ত্রী পরিষদ শাসিত - যেমন, ভারত ও পাকিস্তান।
বাংলাদেশ দেশ হিসেবে অতীতে ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের শাসনাধীন থাকলেও রাষ্ট্র হিসেবে কখনও ডোমেনিয়ন ছিলো না। এমনকি, ১৯৭১ সালে গঠনকালে বাংলাদেশ রিপাবলিকের এক্সিকিউটিভ ক্ষমতা দিয়েই এর প্রথম প্রেসিডেণ্ট হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের নাম ঘোষণা করা হয় এবং তাঁর অনুপস্থিতিতে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে ভাইস প্রেসিডেণ্ট ও অস্থায়ী প্রেসিডেণ্ট করা হয়।
১৯৭২ সালে নতুন সংবিধান করতে গিয়ে প্রধানতঃ ভারত ও ব্রিটেইনের সরকার ব্যবস্থা অনুসরণ করে বাংলাদেশের রাষ্ট্রটিকে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রীপরিষদ শাসিত রিপাবলিক করা হয়। কিন্তু অচিরেই শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি শাসিত রিপাবলিকে পরিণত করেন। কিন্তু এটি করতে গিয়ে তিনি একদলীয় শাসন ও নিজের হাতে সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভুত করেন।
শেখ মুজিবুর রহমানের পর প্রকৃত অর্থে ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রপতি হিসেবে জিয়াউর রহমান ও হুসেন মুহম্মদ এরশাদ এবং উভয়ই অবৈধভাবে ক্ষমতায় আসেন সামরিক বাহিনী থেকে। এঁরা উভয়ই শেখ মুজিবুর রহমান প্রবর্তিত রাষ্ট্রপতির হাতে কেন্দ্রীভুত প্রায় সব ক্ষমতা সংরক্ষণ ও প্রয়োগ করেন। আর সেই থেকে বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার জনপ্রিয়তা হারায়।
ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার কারণেই বাংলাদেশের রাজনীতিকগণ রাষ্ট্রপতি শাসিত রিপাবলিকের পরিবর্তে প্রধানমন্ত্রীত্বের নেতৃত্বাধীন মন্ত্রীপরিষদ শাসিত রিপাবলিক হওয়াটা শ্রেয় মনে করেন। কিন্তু লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রীপরিষদ শাসিত রিপাবলিক হওয়ার পরও বাংলাদেশে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন রোখা যায়নি।
আমার ধারণা, বাংলাদেশকে শেষ পর্যন্ত এক্সিকিউটিভ ক্ষমতাসম্পন্ন রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের দিকেই যেতে হবে। আমি মনে করি, এতে ক্ষমতার ভারসাম্য আনা সহজতর হবে। কিন্তু তার জন্যে প্রয়োজন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান তথা সিভিল সোসাইটি বা নাগরিক সমাজ (সুশীল সমাজ নয়) গড়ে তোলা।
বাংলাদেশের অধিকাংশ বুদ্ধিজীবী রাজনৈতিক নেতৃত্বের আজ্ঞাবহ বলে তাঁরা দেশ বা প্রজাতন্ত্রটির জন্যে স্বাধীনভাবে কিছু ভাবতে পারেন না, কিংবা ভাবলেও প্রকাশ করতে পারেন না। সাধারণতঃ স্বার্থ ও সুবিধার জন্যে তাঁরা স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতাধর নেতৃত্বের খুশিমতো বুদ্ধিবৃত্তি করে থাকেন। প্রতিষ্ঠিত বুদ্ধিজীবীদের অধিকাংশ হয় অথর্ব ও গবেট, নয়তো লম্পট ও ছেচ্চর, অথবা সবকিছুর সংমিশ্রণ।
তাই, বাংলাদেশের জন্যে প্রয়োজন 'এ্যান আর্মি অফ ক্রিটিক্যাল এ্যাণ্ড ফ্রী থিংকিং ইণ্টেলেকচ্যুয়ালস' - অর্থাৎ সূক্ষ্ম ও স্বাধীন চিন্তা করতে সক্ষম বুদ্ধিজীবীদের এক বাহিনী। এই বাহিনী গড়ে তুলতে হবে এক্ষুণি এবং এঁদের আসতে হবে তরুণ প্রজন্ম থেকে।
রোববার ৩ জানুয়ারী ২০১৬
লণ্ডন, ইংল্যাণ্ড
পৃথিবীর ১৯৮টি রাষ্ট্রের মধ্যে ১৫৪টি হচ্ছে রিপাবলিক। ৩৭টি সাংবিধানিক রাজতন্ত্র। ৬টি পরম রাজতন্ত্র। ১টিতে রাজতন্ত্র হলেও সংবিধানে অনির্দিষ্ট (থাইল্যাণ্ড)।
বিশ্বের ৩৭টি রাজতন্ত্রের মধ্যে ৯টিতে রাজা এক্সিকিউটিভ ক্ষমতা ধারণ করেন। বাকি ২৮টিতে রাজার ভূমিকা সেরিমোনিয়্যাল বা আনুষ্ঠানিক।
১৫৪ টি রিপাবলিকের মধ্যে ৪৪টির রাষ্ট্রপতি হচ্ছেন সেরিমোনিয়্যাল বা আনুষ্ঠানিক। বাকি ১০৯টি রিপাবলিকের রাষ্ট্রপতি এক্সিকিউটিভ ক্ষমতা ধারণ করেন এবং ১টিতে রাষ্ট্রপতি নেই, সে-স্থলে ডাইরেক্টোরেইট হচ্ছে এক্সিকিউটিভ ক্ষমতাধর (সুইৎজারল্যাণ্ড)।
১০৯টি রাষ্ট্রের মধ্যে ৬৩টি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি আইনসভা নিরপেক্ষ। অর্থাৎ, তিনি পার্লামেণ্টের অনুমোদন সাপেক্ষ নন। ৩০ রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি পার্লামেণ্টের অনুমোদন সাপেক্ষ নন, কিন্তু মন্ত্রীসভা পার্লামেণ্টের অনুমোদন সাপেক্ষ। ৯টি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রীসভা উভয়ই পার্লামেণ্টের আস্থা সাপেক্ষ।
পৃথিবীর ক্ষমতাশালী রিপাবলিকগুলো রাষ্ট্রপতি শাসিত, যেমন আমেরিকা, রাশিয়া, ফ্রান্স, চীন। এ-রিপাবলিকগুলোর রাষ্ট্রপতিগণ এক্সিকিউটিভ ক্ষমতা রাখেন এবং তাঁরা পার্লামেণ্টের ওপর নির্ভরশীল নন।
আমি মনে করি, রিপাবলিক হওয়ার উচিত রাষ্ট্রপতি শাসিত। লেজিসলেচার (আইনসভা) ও এক্সিকিউটিভের (প্রশনাসন) মধ্যে ব্যালেন্স অফ পাওয়ার (ক্ষমতার ভারসাম্য) এবং জুডিশিয়ারিকে (বিচার বিভাগ) স্বাধীন ও নিরপেক্ষ রাখলেই গণতন্ত্র ভালো কাজ করে বলে আমার ধারণা।
প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রী পরিষদ শাসিত রাষ্ট্রগুলো প্রধানতঃ রাজতন্ত্র বা রাজতন্ত্রের ডোমেনিয়ন - যেমন, যুক্তরাজ্য, অষ্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যাণ্ড। আবার, অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, এসময়কার রাজতন্ত্রের ডোমেনিয়িন এখনও প্রধানমন্ত্রীত্বের নেতৃত্বাধীন মন্ত্রী পরিষদ শাসিত - যেমন, ভারত ও পাকিস্তান।
বাংলাদেশ দেশ হিসেবে অতীতে ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের শাসনাধীন থাকলেও রাষ্ট্র হিসেবে কখনও ডোমেনিয়ন ছিলো না। এমনকি, ১৯৭১ সালে গঠনকালে বাংলাদেশ রিপাবলিকের এক্সিকিউটিভ ক্ষমতা দিয়েই এর প্রথম প্রেসিডেণ্ট হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের নাম ঘোষণা করা হয় এবং তাঁর অনুপস্থিতিতে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে ভাইস প্রেসিডেণ্ট ও অস্থায়ী প্রেসিডেণ্ট করা হয়।
১৯৭২ সালে নতুন সংবিধান করতে গিয়ে প্রধানতঃ ভারত ও ব্রিটেইনের সরকার ব্যবস্থা অনুসরণ করে বাংলাদেশের রাষ্ট্রটিকে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রীপরিষদ শাসিত রিপাবলিক করা হয়। কিন্তু অচিরেই শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি শাসিত রিপাবলিকে পরিণত করেন। কিন্তু এটি করতে গিয়ে তিনি একদলীয় শাসন ও নিজের হাতে সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভুত করেন।
শেখ মুজিবুর রহমানের পর প্রকৃত অর্থে ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রপতি হিসেবে জিয়াউর রহমান ও হুসেন মুহম্মদ এরশাদ এবং উভয়ই অবৈধভাবে ক্ষমতায় আসেন সামরিক বাহিনী থেকে। এঁরা উভয়ই শেখ মুজিবুর রহমান প্রবর্তিত রাষ্ট্রপতির হাতে কেন্দ্রীভুত প্রায় সব ক্ষমতা সংরক্ষণ ও প্রয়োগ করেন। আর সেই থেকে বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার জনপ্রিয়তা হারায়।
ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার কারণেই বাংলাদেশের রাজনীতিকগণ রাষ্ট্রপতি শাসিত রিপাবলিকের পরিবর্তে প্রধানমন্ত্রীত্বের নেতৃত্বাধীন মন্ত্রীপরিষদ শাসিত রিপাবলিক হওয়াটা শ্রেয় মনে করেন। কিন্তু লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রীপরিষদ শাসিত রিপাবলিক হওয়ার পরও বাংলাদেশে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন রোখা যায়নি।
আমার ধারণা, বাংলাদেশকে শেষ পর্যন্ত এক্সিকিউটিভ ক্ষমতাসম্পন্ন রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের দিকেই যেতে হবে। আমি মনে করি, এতে ক্ষমতার ভারসাম্য আনা সহজতর হবে। কিন্তু তার জন্যে প্রয়োজন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান তথা সিভিল সোসাইটি বা নাগরিক সমাজ (সুশীল সমাজ নয়) গড়ে তোলা।
বাংলাদেশের অধিকাংশ বুদ্ধিজীবী রাজনৈতিক নেতৃত্বের আজ্ঞাবহ বলে তাঁরা দেশ বা প্রজাতন্ত্রটির জন্যে স্বাধীনভাবে কিছু ভাবতে পারেন না, কিংবা ভাবলেও প্রকাশ করতে পারেন না। সাধারণতঃ স্বার্থ ও সুবিধার জন্যে তাঁরা স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতাধর নেতৃত্বের খুশিমতো বুদ্ধিবৃত্তি করে থাকেন। প্রতিষ্ঠিত বুদ্ধিজীবীদের অধিকাংশ হয় অথর্ব ও গবেট, নয়তো লম্পট ও ছেচ্চর, অথবা সবকিছুর সংমিশ্রণ।
তাই, বাংলাদেশের জন্যে প্রয়োজন 'এ্যান আর্মি অফ ক্রিটিক্যাল এ্যাণ্ড ফ্রী থিংকিং ইণ্টেলেকচ্যুয়ালস' - অর্থাৎ সূক্ষ্ম ও স্বাধীন চিন্তা করতে সক্ষম বুদ্ধিজীবীদের এক বাহিনী। এই বাহিনী গড়ে তুলতে হবে এক্ষুণি এবং এঁদের আসতে হবে তরুণ প্রজন্ম থেকে।
রোববার ৩ জানুয়ারী ২০১৬
লণ্ডন, ইংল্যাণ্ড
EmoticonEmoticon