ক্যাপিটালিজম (Capitalism) বা পুঁজিবাদ হচ্ছে একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থায় ব্যবসায় বাণিজ্য, শিল্প কারখানা ও উৎপাদন প্রক্রিয়া মূলত চলবে বেসরকারি মালিকানায় ও মুনাফার ভিত্তিতে। পুঁজিবাদের কেন্দ্রীয় বৈশিষ্ট্যের মধ্য অন্তর্ভুক্ত রয়েছে পুঁজি পুঞ্জীভূত করা, প্রতিযোগিতামূলক বাজার এবং শ্রমের বিনিময়ে মজুরি। পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে একটি লেনদেনের পক্ষগুলোই মূলত নির্ধারণ করে বিনিময়ের সম্পদ, পণ্য ও সেবার মূল্য।
প্রতিযোগিতার মাত্রা, হস্তক্ষেপ ও বিধিনিয়ন্ত্রণের মাত্রা এবং ব্যক্তিমালিকানার সুযোগ বিভিন্ন হয় বিভিন্ন মডেলের পুঁজিবাদে। অর্থনীতিবিদ, রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ ও ইতিহাসবিদেরা পুঁজিবাদ বিশ্লেষণে নানা প্রেক্ষাপট টেনে এনেছেন এবং বিভিন্ন ধরনের পুঁজিবাদ অনুশীলনের সুপারিশ করেছেন। বিভিন্ন ধরনের পুঁজিবাদের কয়েকটি হচ্ছে : laissez-faire capitalism, welfare capitalism, crony capitalism Ges state capitalismÑ প্রথম ধরনের পুঁজিবাদে প্রধানত বাণিজ্যিক ব্যাপারে সরকারের হস্তক্ষেপ না করার নীতি অবলম্বন করা হয়। ওয়েলফেয়ার ক্যাপিটালিজমে অনুসরণ করা হয় ব্যাপকভিত্তিক সবাজকল্যাণমুখী অর্থনৈতিক নীতি। আর ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের অর্থনীতিতে ব্যবসায়ের সাফল্য নির্ভর করে ব্যবসায়ী জনগোষ্ঠী ও সরকারি কর্মকর্তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ওপর। স্টেট ক্যাপিটালিজম বা রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় লাভজনক বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে রাষ্ট্র, যেখানে উৎপাদনের উপায় ও ব্যবস্থাপনার পদ্ধতি চলে পুঁজিবাদী কায়দায়।
বিভিন্ন মডেলের পুঁজিবাদে প্রতিযোগিতার মাত্রা, হস্তক্ষেপ ও বিধিনিয়ন্ত্রণ, সরকারি মালিকানার সুযোগ সীমানা মাত্রা বিভিন্ন হয়ে থাকে। অর্থনীতি বিশ্লেষকদের বিশ্লেষণে বাজারের ওপর বিভিন্নœ মাত্রার নির্ভরতা, সরকারের মালিকানার সীমা ও সামাজিক নীতির অন্তর্ভুক্তির কথা বলা হয়েছে। বাজার কতটুকু উন্মুক্ত হবে, বেসরকারি সম্পদসম্পর্কিত বিধিবিধান ইত্যাদি রাজনীতি ও সরকারের অবলম্বিত নীতিনির্ভর বিষয়। অনেক দেশকেই বলা হয় মিশ্র অর্থনীতির পুঁজিবাদী দেশ। এর অর্থ দেশটির অর্থনীতিতে পরিকল্পিত ও বাজার অর্থনীতি উপাদান রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সংস্কৃতিতে ও বিভিন্ন ধরনের সরকারের অধীনে পুঁজিবাদের অস্তিত্ব লক্ষ করা গেছে। ফিউডালিজম তথা সামন্তবাদের পতনের পর পাশ্চাত্য জগতে পুঁজিবাদী অর্থনীতির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
বিশ্বায়নের বৃহত্তর প্রক্রিয়ায়, যেমন সাম্র্রাজ্যবাদী প্রক্রিয়ায় পুঁজিবাদকে ব্যবহার করা হয়েছে বিশ্বব্যপী। ঊনবিংশ শতাব্দী শেষে অর্থনৈতিক ও বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় পুঁজিবাদ হয়ে ওঠে প্রধানতম অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। পরবর্তী সময়ে বিংশ শতাব্দীতে পুঁজিবাদকে উৎরাতে হয় কেন্দ্রীয়ভাবে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার চ্যালেঞ্জ এবং এখন বিশ্বজুড়ে কলছে পুঁজিবাদেরই পদচারণা। উল্লেখ্য, প্ল্যান্ড ইকোনমি হচ্ছে এমন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, যেখানে উৎপাদন ও বিনিয়াগসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয় কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে। সাধারণত এ সিদ্ধান্ত সরকারি কোনো কমিটি বা সংস্থার। ফলে একে বলা যেতে পারে কমান্ড ইকোনমি। এই প্ল্যান্ড ইকোনমি চলতে পারে সেন্ট্রালাইজড কিংবা বিকেন্দ্রায়িত প্রক্রিয়ায়। তবে সাথারণত একে অভিহিত করা হয় সেন্ট্রেলাইজড প্ল্যান্ড ইকোনমি নামে।
বিভিন্ন অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে ক্যাপিটালিজমের বিভিন্ন উপাদানের ওপর জোর দেয়া হয়। লেইসেজ-ফেইরি ও লিবারেল অর্থনীতিবিদেরা জোর দেন সেসব উপাদানের ওপর যেখানে বাজারের ওপর সরকারে নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। আর এরা গুরুত্ব দেন প্রোপার্টি রাইট তথা সম্পদের অধিকারের ওপর: সম্পদ ব্যবহারের অধিকার, সম্পদ থেকে মুনাফা অর্জনের অধিকার, অন্যের কাছে সম্পদ হস্তান্তরের অধিকার এবং সম্পদ অধিকার কার্যকর করার অধিকার। অপর দিকে নিওকাসিক্যাল ও কেইনসীয় অর্থনীতিবিদেরা জোর দেন মনোপলি ঠেকাতে সরকারি বিধিনিষেধ আরোপের প্রয়োজনের ওপর এবং ‘বোম অ্যান্ড বাস্ট’ সাইকলের প্রভাব নমনীয় করার ওপর। মার্কসবাদী অর্থনীতিবিদেরা জোর দেন মূলধন পুঞ্জীভূত করা, শোষণ ও মজুরির ওপর। বেশির ভাগ রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ জোর দেন ব্যক্তিগত সম্পদ সেই সাথে ক্ষমতার সম্পর্ক, মজুরি, শ্রেণী ও একটি ঐতিহাসিক গঠন হিসেবে ক্যাপিটালিজমের অনন্যতার ওপর। বলা হয়, আধুনিক অর্থে ‘ক্যাপিটালিজম’ পদবাচ্যটি সূচনা করেন কার্লমার্কস। তার ‘ম্যাগনাম ওপাস ক্যাপিটাল’-এ মার্কস একটি পদ্ধতি ব্যবহার করে বিশ্লেষণ করেছেন ‘ক্যাপিটালিস্ট মোড অব প্রডাকশন’। এই পদ্ধতির নামই মার্কসবাদ। তা সত্ত্বেও, মার্কস ক্যাপিটালিজম শব্দটি খুব কমই ব্যবহার করেছেন। অপর দিকে তার রাজনৈতিক কর্মের অধিকতর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে ক্যাপিটালিজম শব্দটি ফ্রেডারিখ অ্যাঙ্গেলস তার প্রাথমিক লেখালেখিতে মাত্র দুইবার ব্যবহার করেছেন। বিংশ শতাব্দীতে ক্যাপিটালিজম সিস্টেমের রক্ষকেরা ‘ক্যাপিটালিজম’ শব্দটি প্রতিস্থাপন করেন ‘ফ্রি এন্টারপ্রাইজ’ অথবা ‘প্রাইভেট এন্টারপ্রাইজ’ কথা দিয়ে। আর ‘ক্যাপিটালিস্ট’ শব্দের জায়গায় ব্যবহার করেন ‘রেনটিয়ার’ বা ‘ইনভেস্টর’ শব্দ। এরা এমনটি করেন ক্যাপিটালিজমের নেতিবাচক সমালোচনা এড়াতে।
শনিবার, ১২ আগস্ট, ২০১৭
পুঁজিবাদ...

Tags
Artikel Terkait
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
EmoticonEmoticon