এক. বৈধতার ধারণা
জনগণের সংখ্যা কোটি-কোটি, কিন্তু তারা শেষ-বিচারে শাসিত হয় এক ব্যক্তির দ্বারা। কোটি-কোটি মানুষ এক ব্যক্তিকে মানবে কেনো? মানার মূলে থাকে বৈধতার উপলব্ধি ও অনুভূতি।
এখানে বৈধতা বলতে শুধু আইনানুগতা বুঝানো হচ্ছে না। বৈধতার মূলে আছে আইনসঙ্গতা ও ন্যায্যতা বা ন্যায়সঙ্গতার একটি যৌথ জটিল বোধ।
যেহেতু স্বয়ংক্রিয়ভাবে যা আইনসঙ্গত তা-ই ন্যায়সঙ্গত এবং যা ন্যায়সঙ্গত তা-ই আইনসঙ্গত হয় না, তাই জনগণের মধ্যে শাসকের বৈধতা হচ্ছে আইনসঙ্গতা ও ন্যায়সঙ্গতার একটি ডায়ালেক্টিক্যাল বা দ্বান্দ্বিক ধারণা।
দুই. উচ্ছেদ পদ্ধতি
কোটি-কোটি মানুষ যখন উপলব্ধি ও অনুভব করে যে, ক্ষমতার শীর্ষে থাকা ব্যক্তিটি বৈধতা হারিয়েছেন, তখন তারা আর তার প্রতি আনুগত্য বোধ করে না।
জনগণের কাছে বৈধতা হারানো শাসককে উচ্ছেদ করা যায় দু'ভাবেঃ হয় যুক্তিতে নয়তো শক্তিতে। এই দু'টির আছে আবার একাধিক পদ্ধতি।
যুক্তির পথে অবৈধ শাসককে উচ্ছেদের প্রথম পদ্ধতি ভৌটাধিকার প্রয়োগ। তবে, জনগণের যদি এই উপলব্ধি হয় যে, ভৌটাধিকার প্রয়োগের কোনো সুযোগ নেই কিংবা প্রয়োগ করলেও তার উপেক্ষিত, তখন জনগণ এই পদ্ধতির ওপর আস্থা হারায়।
দ্বিতীয় পদ্ধতি হচ্ছে আইন প্রণেতাদের দ্বারা অভিশংসন, তৃতীয় পদ্ধতটি হচ্ছে শীর্ষ বিচারকদের দ্বারা বাতিলায়ন। অন্যদিকে, শক্তির দ্বারা অবৈধ শাসককে উচ্ছেদ করার একটি পদ্ধতি হচ্ছে অভ্যূত্থান ও আরেকটি হচ্ছে বিপ্লব।
অভ্যূত্থান ও বিপ্লবও আবার দু'রমের হতে পারে। জনগণ যখন অবৈধ-প্রত্যক্ষিত শাসককে অমান্য করে উত্থিত হয়, তার নাম হয় গণ-অভ্যূত্থান। আর, এটি যখন জনগণের পরিবর্তে রাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী করে, তার তাকে বলা হয় সামরিক অভ্যূত্থান।
অন্যদিকে, বিপ্লবও হতে পারে দু'প্রকারে। জনগণ যখন শাসকের সাথে সাথে রাষ্ট্র ব্যবস্থাটাকেই অবৈধ হিসেবে প্রত্যক্ষণ করে, তখন শক্তি প্রয়োগ করে শাসক-সহ রাষ্ট্র ব্যবস্থা উচ্ছেদ করে নতুন রাষ্ট্র ও শাসন প্রতিষ্ঠা করলে, তা হয় রাষ্ট্র বিপ্লব।
আর, জনগণ যখন শুধু শাসক নয়, শুধু রাষ্ট্র ব্যবস্থা নয়, তার সাথে সমগ্র সমাজ ব্যবস্থা তথা সমাজের শ্রেণী-বিন্যাস ও সম্পদ বণ্টন ব্যবস্থাকে অবৈধ মনে করে একই সাথে তার প্রতিষ্ঠিত শাসক, রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা উচ্ছেদ করে নতুন সমাজ, রাষ্ট্র ও শাসন প্রতিষ্ঠা করে, যার নাম হচ্ছে সামাজিক বিপ্লব।
উপরের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের ভিত্তিকে নীচে অবৈধ-প্রত্যক্ষিত শাসক উচ্ছেদের ৭টি পদ্ধতির তালিকা দেওয়া হলোঃ
(১) অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন
(২) আইন-স্রষ্টাদের দ্বারা অভিশংসন
(৩) বিচারপতিদের দ্বারা বাতিলায়ন
(৪) গণ-অভ্যূত্থান
(৫) সামরিক অভ্যূত্থান
(৬) রাষ্ট্র বিপ্লব
(৭) সামাজিক বিপ্লব
তিন. বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা
উপরের তালিকার মধ্যে প্রথম, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ পদ্ধতিতে বাংলাদেশে শাসক উচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে। এদের মধ্যে একাধিক পদ্ধতির পুনরাবৃত্তিও ঘটেছে।
১৯৭০ সালের সমগ্র জাতি নির্বাচনের মাধ্যমে তৎকালীন অবৈধ প্রত্যক্ষিত পশ্চিম-পাকিস্তানী শাসকদের উচ্ছেদের জন্যে রায় দিয়েছিলো। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও একাধিকবার এমটি হয়েছে।
বাংলাদেশে গণ-অভ্যূত্থান ঘটেছে দু'বার। ১৯৬৯ সালে অবৈধ প্রত্যক্ষিত শাসক ফীল্ড মার্শাল মুহাম্মদ আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে প্রথম বার এবং ১৯৯০ সালে লেফটেন্যাণ্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বিরুদ্ধে দ্বিতীয়বার।
নির্বাচনের মাধ্যমে অবৈধসামরিক অভ্যূত্থান ঘটেছে দু'বার - ১৯৭৫ সালে প্রথম বাকাশালী একনায়ক শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে এবং ১৯৮২ সালে সামরিক একনায়ক জেনারেল জিয়াউর রহমানের উত্তরাধিকারী প্রেসিডেণ্টে আব্দুর সাত্তারের বিরুদ্ধে।
বাংলাদেশে রাষ্ট্র বিপ্লব হয়েছে একবার ১৯৭১ সালে, যা একটি জাতির জন্যে বিরল ঘটনা। ১৯৭২ সাল থেকে সামাজিক বিপ্লবের চেষ্টা করলেও সেটি অদ্যাবধি সংঘটিত হয়নি।
০২/০৯/২০১৭
লণ্ডন, ইংল্যাণ্ড
EmoticonEmoticon