হিমালয়ের গা ঘেষে ছোট্ট যে দেশ তার নাম নেপাল। পাহাড় ব্যাষ্টিত নেপাল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অন্যতম আকর্ষণ। নেপালের সৌন্দর্য জগত জোড়া হলেও দারিদ্রকৃষ্ট এই দেশ তেমন উন্নতি করতে পারেনি। দীর্ঘদিন ছিল নেপাল রাজতন্ত্রের অধীনে। ফলে এই সামন্তবাদী ব্যবস্থা জনগণের জীবনযাত্রা উন্নয়নে ভূমিকা রাখেনি। ফলে নেপালের জনগণ বার বার মুক্তির স্বপ্ন দেখেছে। নেপালের শাসকগোষ্ঠী ভারতের অনুগত ছিল। ফলে ভারতীয় উৎপাদনের অন্যতম বাজার ছিল নেপাল।
দীর্ঘদিন থেকে নেপালের মাওবাদী দল রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। যার ধারাবাহিকতায় রাজতন্ত্র বিতাড়িত হয়ে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু করেছে। নেপালের সংবিধানকে ধর্ম নিরপেক্ষ ঘোষণা করা হয়েছে। ভারতীয় একক আধিপত্য থেকে নিজেদের অনেকটা স্বাধীন মনোবৃত্তি গড়ে তুলেছে। দেখা যাচ্ছে সদ্য রাজতন্ত্র থেকে মুক্ত হওয়া নেপালের গণতন্ত্র অনেক উন্নত। এমনকি বাংলাদেশ গত ৪৬ বছরে যা পারেনি নেপাল কয়েক বছরে ব্যাপক উন্নতি করেছে।
সদ্য নির্বাচনে নেপালের বামপন্থী দল সিপিএন-ইউএমএল এবং সিপিএন-মাওবাদী কেন্দ্র জোটগতভাবে এগিয়ে রয়েছে। এর মধ্য দিয়ে নেপালের নির্বাচন ধারার বাম দল (কমিউনিস্ট নয়) ক্ষমতাসীন হবে। এর মধ্য দিয়ে নেপালে কি সমাজতন্ত্র হয়ে যাবে বা এরকম কোন সম্ভাবনা আছে? বাংলাদেশে কেউ কেউ অনলাইনে নেপালের বামদের বিজয়কে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম সমাজতান্ত্রিক দেশ বলে প্রচার চালাচ্ছেন। যা বাস্তবে অনেকেই বিভ্রান্ত হবেন। নেপালের যে দলগুলো ক্ষমতায় আসছে এরা বর্তমান চীনঘেষা দল। যে চীন দুনিয়াজুড়ে পুঁজিবাদী অর্থনীতির বড় শক্তি কিন্তু নিজেদের নাম দিয়েছে চীনাধাপের সমাজতন্ত্র! (মার্ক্সীয় সমাজতন্ত্র নয়)। এখন প্রশ্ন হল নেপালের মত ছোট অর্থনীতির দেশ যারা উৎপাদন ক্ষেত্রে অন্যের উপর নির্ভরশীল; তারা কী বড় কোন অর্থনীতির নির্ভরশীলতা ছাড়া চলতে পারবে? উত্তর হল না। নেপালকে কোন বড় অর্থনীতির উপর নির্ভর করতে হবে। আগে যা ছিল ভারতের উপর নির্ভরশীল, এখন ঝুকেছে চীনের দিকে। এখানে মেকি হলেও লাল ঝাণ্ডার প্রভাব আছে। আবার অর্থনীতিতে চীনের ব্যাপক অগ্রগতি অন্যতম কারণ। এখন যদি নেপাল চীনের একছত্র বাজারে পরিণত না হয়ে দেন-দরবার নির্ভর পুঁজির বিকাশ ঘটাতে পারে, বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারে, সাথে সাথে শিক্ষা স্বাস্থ্য বাসস্থান এগুলোর উন্নতি ঘটাতে পারে। এটাই হবে আজকের নেপালের গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কারণ ২০১৫ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্পে নেপালের ব্যাপক প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে যা এখনো কাঠিয়ে উঠতে পারেনি। ফলে দুর্বল অর্থনীতির নেপালে সমাজতন্ত্র হবে না সেখানে দরকার পুঁজিবাদের বিকাশ। যা একদিকে অর্থনৈতিক অবকাঠামো গড়ে তুলবে, গণতান্ত্রিক বিকাশ ঘটাবে এবং প্রলেয়ারিয়েত শ্রেণীর বিকাশ ঘটাবে যারা পুঁজিপতিদের ক্ষমতা থেকে হঠিয়ে সমাজতন্ত্র কায়েম করবে। তবে বিদেশী বিনিয়োগ মানে নিজেদের সবকিছু বিকিয়ে দেওয়া নয়, পরিবেশ প্রতিবেশ, জনগণের স্বাস্থ্যগত বিষয় খেয়াল রেখে যদি বিদেশী পুঁজি বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয় তবে তা হবে নেপালের জন্য শুভকর। এখন যদি নেপালের বর্তমান ক্ষমতাসীনরা চীনের একছত্র বাজারে পরিণত করেন, ব্যাপক দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হন, জনগণের শিক্ষা স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল না করে একটি গোষ্ঠীর স্বার্থে কাজ করেন তবে সেই সরকার হবে গণবিরুধী। তবে সাম্রাজ্যবাদ নির্ভর নেপালের পক্ষে বের হয়ে আসা খুব সহজ হবে না, আবার যারা নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতাসীন হবেন তারা কাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করবেন তা দেখার বিষয়।
তবে সমাজতন্ত্রের জন্য নেপালের প্রলেতারিয়েতের লড়াই হবে দুনিয়ার অন্যান্য দেশের প্রলেতারিয়েতের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলা, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার প্রলেতারিয়েত শ্রেণীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠা ছাড়া কোন দেশেই সমাজতন্ত্রের বিজয় সম্ভব নয়। একই সাথে বা সমসাময়িক দক্ষিণ এশিয়ায় বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সমাজতান্ত্রিক দক্ষিণ এশিয়ার যাত্রা সমাজতন্ত্রের জন্য টেকশই এবং শক্তিশালী হতে পারে। নেপালের জনগণের বিজয় কামনা করি।
EmoticonEmoticon