রবিবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৭

১৯৭১ সালের যুদ্ধ কী ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ ছিল?

১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ভারতের তরফ থেকে দাবি করা হচ্ছে এটা ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ, যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জন্ম। যার দাবির যৌক্তিকতা কতটুকু? ভারত কেন যুদ্ধে জড়ালো? ঐসময় কী ভারতের সাথে পাকিস্তানের কোন দ্বন্দ্ব চলছিল? ভারত পাকিস্তান অন্য কোন স্বার্থের দ্বন্দ্ব ছিল না, ভারত যুদ্ধে জড়িত হয়েছে বাংলাদেশের জন্য। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগে যখন সব ধরণের আলাপ আলোচনার পর পাকিস্তান রাষ্ট্রের শাসকরা একটি মিলিটারি ক্র‍্যাকডাউন এর পরিকল্পণা করছিল। এর অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল প্রচুর ত্রাশ সৃষ্টি করে ভয় উৎপাদন করা যার মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলার জনগণ যাতে স্তিমিত হয়ে যায়, আন্দোলন সংগ্রামের ইস্তফা দেয়, সুবোধ বালকের মত যা বলবে তাই মেনে নেয়। ফলে ঐদিন রাতে ব্যাপক ত্রাশের মাধ্যমে একই দেশের সেনাবাহিনী নিজ জনগণের উপর অপারেশন সার্চলাইট এর নামে হত্যার হুলিখেলা চালায়। এর মধ্য দিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সাথে একত্রে বসবাসের আর কোন বাস্তবতা ছিল না, যুদ্ধ তখন অনিবার্য। বাংলার জনগণের হাতে দুইটা পথ বাকি ছিল এক হত্যা নির্যাতন জুলুম সহ্য করে পাকিস্তানের দাসত্ব মেনে নেওয়া অথবা জানবাজি রেখে যুদ্ধ করে স্বাধীন গণতান্ত্রিক রিপাবলিক ঘোষণা করা। চাওয়াটা সহজ হলেও পাওয়াটা বড্ড কঠিন ছিল। কারণ জনগণের বৃহৎ অংশের মধ্যে গণতান্ত্রিক পন্থায় আন্দোলন করার সাহস থাকলেও স্বশস্ত্র যুদ্ধ করার কোন অভিজ্ঞতা নেই। বাংলার জনগণের যে অংশ পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে কর্মরত তারা সবাই বিচ্ছিন্নভাবে নানা জায়গায় কর্মরত, তখনো একত্র হওয়ার বাস্তব কোন পরিকল্পনা ছিল না। ফলে যুদ্ধের জন্য ভারতের উপর নির্ভরশীল হতে হয়েছে। পূর্ব বাংলার তিনদিকে ভৌগিলিকভাবে ভারতের অবস্থান। আবার বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে ভারতীয় কতৃপক্ষ আগে থেকেই পজেটিভ ছিল। ফলে সংহত কারণের ভারতের উপর সাহায্যের হাত বাড়াতে হয়েছে। ভারত তার রাজনৈতিক হিসাব নিকাশ করেই সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছে, পশ্চিমবঙ্গসহ বাঙ্গালী অধ্যুষিত অঞ্চলের জনগণ আন্তরিকভাবে সাহায্য করেছে। বিশাল শরণার্তীর বোঝা সহ্য করেছে। ফলে ভারতের কাছে এটা ছিল বাড়তি চাপ। কিন্তু আন্তর্জাতিক রীতিনীতি লঙ্ঘন করে ভারতের পক্ষে সরাসরি যুদ্ধ অংশগ্রহণ করা কঠিন ছিল। প্রথম দিকে যে যুদ্ধ চলছিল তা হল দেশের ভিতরে গেরিলা যুদ্ধ, কাদের বাহিনী সহ কয়েকটি বাহিনীর যুদ্ধ, কমরেড সিরাজ শিকদার সহ কমিউনিস্ট কয়েকটি গ্রুপের নিজস্ব তত্ত্বাবধানে যুদ্ধ। যারা মনে করেন কমিউনিস্টরা যুদ্ধ করে নাই, বিরুধীতা করেছে এরা ভুল বলেছে। কমিউনিস্ট যে গ্রুপগুলো যুদ্ধ করেছে তারা মুক্তিবাহিনী বা ভারতের কমান্ড মেনে যুদ্ধ করে নাই, নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে যুদ্ধ করেছে। ফলে অন্যদের কাছে এটা বিরুধী মনে হবে। আবার মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আওয়ামীলীগ এর যে বয়ান তার সবগুলো সঠিক নয় কারণ তাঁদের স্বার্থের বাইরে যেগুলো ছিল সব তারা নাকচ করে দিয়েছে। আবার মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সাথে মুজিববাহিনীর বিরোধ ছিল। মুজিব বাহিনীর নেতা শেখ ফজলুল হক মনি তাজউদ্দিনের অস্থায়ী সরকারকে মেনে নেয়নি। ফলে বিভিন্ন জায়গায় তাঁদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের সংঘর্ষ হয়েছে।

আবার আসি ভারত প্রসঙ্গে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং আমেরিকার ঠান্ডাযুদ্ধ চলছিল। আবার পাকিস্তানের সাথে আমেরিকা এবং চীনের সখ্যতা ছিল। ফলে যুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষে আমেরিকা চীনের সহযোগীতা ছিল। ঐসময় পাকিস্তানের মাধ্যমে চীনের সাথে আমেরিকার কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। ফলে ভারতের আশংকা ছিল তারা যদি যুদ্ধে জড়িত হয় তবে তারা চীন এবং আমেরিকার আক্রমণের শিকার হতে পারে। ফলে ধীরে চল নীতিতেই ভারত চলছিল। শুধুমাত্র সীমান্ত এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দেওয়া, কমান্ড করা আর মাঝে মাঝে সীমান্ত এলাকায় আক্রমণ করা ছাড়া ভারত তখনো কিছু করেনি। এর মধ্যে ভারত আন্তর্জাতিক মিত্র খোঁজা শুরু করে। সম্ভাব্য মিত্র সোভিয়েত ইউনিয়ন এর সাথে আলাপ আলোচনা শুরু হয়। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ, ছাত্রইউনিয়ন কর্মীদের যুদ্ধে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয় যাথে সোভিয়েত ইউনিয়ন কে বুঝানো যায় এটা জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম। তাজউদ্দিনের উদ্দ্যোগে মনিসিংহ, মোজাফফর আহমেদদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়। এইসব উদ্দ্যোগের কারণ ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নকে বুঝানো কমিউনিস্টরা যুদ্ধের সাথে যুক্ত এবং এটা জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম। আগস্ট মাসে ভারত সোভিয়েত ইউনিয়ন সহযোগীতা চুক্তি হয়। তার পর থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে অস্ত্র আসা শুরু হয়। যার ফলে আগস্ট থেকে যুদ্ধে পাকিস্তান বাহিনীর উপর আক্রমণ বৃদ্ধি পায়। দেশের ভিতরে তরুণদের গেরিলাবাহিনী একের পর এক সফলতা অর্জন করে। সীমান্ত এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা বড় বড় অপারেশন চালায়। ফলে আস্তে আস্তে প্রতিপক্ষ কোনঠাসা হতে থাকে।

মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহায়তার কারণে পাকিস্তানি শাসকরা স্বভাবতই ক্ষুদ্ধ ছিল। ফলে পাকিস্তান ভারতের উপর হামলার পরিকল্পণা করে। আবার ভারতের উপর বিশাল শরণার্তীর চাপ ছিল। এজন্য ভারত চাইছিল শীত শেষ হওয়ার আগে যুদ্ধ শেষ করা যাতে চীনকে আক্রমণের সুযোগ দেওয়া না যায়। ভারত যখন যুদ্ধে আক্রমণ বৃদ্ধি করে তখন পাকিস্তান ভারতের উপর পশ্চিম অংশে হামলা চালায়। ফলে ভারত ডিসেম্বরের প্রথম থেকে সরাসরি যুদ্ধে জড়িত হয়ে যায়। তখন থেকে ভারতে পূর্ববাংলার আকাশে বিমান হামলা শুরু করে। ফলে পাকিস্তান বাহিনী বিপর্যস্ত হতে থাকে। ডিসেম্বরের নয় দশ তারিখে পাকিস্তান বাহিনী শক্তিহীন হয়ে পড়ে সব জায়গায় পরাজয় বরণ করে। অন্য উপায় না দেখে পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করার স্বিদ্ধান্ত নেয়। তবে তারা মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করবে না। এর কারণ ছিল মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ অধিকতর অপমানের। আবার বাংলাদেশের কোন স্বীকৃত বাহিনী ছিল না; পাকিস্তান বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের চেয়ে ভারতের বাহিনীর কাছে নিরাপদ মনে করেছে। ফলে আত্মসমর্পণ অনেকটা বাস্তব কারণে ভারতীয় বাহিনীর কাছে করেছে। এর মধ্য দিয়ে ভারতের যুদ্ধ জয়েয় বিজয় বুঝা যায় না। ভারত যুদ্ধে জড়িত হয়েছে বাংলাদেশের কারণে। উদ্দেশ্য যাই হোক বাংলাদেশের জনগণ ভারতের এই সহযোগীতাকে কৃতঘ্নতা ভরে স্মরণ করবে। কিন্তু এটা ভারতের নিজস্ব কোন যুদ্ধ ছিল না, ভারত সহযোগী হয়েছিল মাত্র।


EmoticonEmoticon