আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা সভাপতি মাওলানা ভাসানী ১৯৫৭ সালে দল থেকে বের হয়ে ন্যাপ গঠন করেন। এই অঞ্চলের বামপন্থিদের প্রকাশ্য দলে পরিণত হয়। ১৯৬৭ সালে মস্কোপন্থি নাকি চিনপন্থি এই মহাবিতর্কে ন্যাপ ভেঙ্গে মোজাফ্ফর বের হয়ে যান। এই সময়টাতে পূর্ব পাকিস্থান ছাত্র ইউনিয়ন ভেঙ্গে মেননগ্রুপ চিনপন্থি আর মতিয়াগ্রুপ মস্কোপন্থি বলে দৃশ্যমান হয়। তথা পশ্চিম পাকিস্থানে জাতীয় ছাত্র ফেডারেশন রাশেদগ্রুপ যারা চিনপন্থি ছিলেন। ছাত্র ইউনিয়ন মেননপন্থিদের সঙ্গে জাতীয় ছাত্র ফেডারেশন রাশেদপন্থিদের যোগাযোগ ছিল। স্বৈরাচার আইয়ুব সরকারে বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্থানে NSF চিনপন্থিরা তুমুল আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে তুলে। পুলিশ ছাত্রদের হত্যা, মিছিলে গুলিবর্ষণ, গ্রেফতার অভিযান চালাতে থাকে। ফলে সরকার দলীয় NSF এর একজন ছাত্রনেতা কে পূর্ব পাকিস্থানে ছাত্র ইউনিয়ন চিনপন্থিরা খুন করে। এরপর পূর্ব পাকিস্থানে আন্দোলনের ঢেউ লাগতে থাকে। সর্বমহলে বিতর্ক চলতে থাকে পশ্চিম পাকিস্থানিরা এত কিছু করছে আমরা কিছুই করব না? আমরা কি বাদ পড়ে যাচ্ছি? ভাসানী আইয়ুব হঠাতে ঐক্যের ডাক দেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত ন্যাপ মোজাফ্ফর ও সিপিবি'র প্রচেষ্টায় গণতান্ত্রিক শক্তিদের নিয়ে "ডাক" গঠন করা হয়। ডাকের ৮দফায় স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি না থাকায় জনগণের কাছে এর গ্রহণযোগ্যতা তেমন ছিল না। বরং পাঞ্জাবের কমরেড নিয়ে অখণ্ড পাকিস্থান থেকে আইয়ুব হঠানোর কথা তারা বলতে ছিল। কিন্তু চিনপন্থি ভাসানী ও ছাত্রদের মধ্যে মেননগ্রুপ তা মানতে পারেনা। তবে স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে ছাত্রলীগ মেননগ্রুপের সাথে কিছুটা ঐক্যমত থাকলেও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে রাজি ছিল না। তৎকালীন ন্যাপ ও সিপিবি সহ ছাত্র ইউনিয়ন মস্কোপন্থিরা তাদের ডাকের ৮ দফায় সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী কোন বিষয়াদি রাখেনি। ডাক যখন জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারায় তখন ছাত্র ইউনিয়ন মতিয়াগ্রুপের ছাত্রদের দিয়ে ছাত্রলীগ ও মেননপন্থিদের ঐক্য করে ১১দফার ভিত্তিতে ১৭ জানুয়ারি ১৪৪ ভাঙে। ফলে পশ্চিম পাকিস্থানের মতো পূর্ব পাকিস্থানেও আন্দোলন শুরু হল, সমগ্র পাকিস্থান যখন আন্দোলনে ফুঁসে উঠছে তখন ডাকের পক্ষ থেকে সরকারের ডাকা গোলটেবিল বৈঠক কে সমর্থন করা হয়। ছাত্র ইউনিয়নের মতিয়াগ্রুপ আন্দোলন থেকে নিজেদের পিছিয়ে রাখলেও মেননগ্রুপ ও ছাত্রলীগ গোলটেবিলের বিরুদ্ধে স্লোগান তুলতে থাকে। "গোলটেবিল না রাজপথ, রাজপথ রাজপথ" স্লোগানে মুখরিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। অপরদিকে রাজনৈতিক পার্টিগুলোর মধ্যে ভাসানী ৭ ডিসেম্বর ১৯৬৯ পল্টনের এক জনসভায় পাকিস্থান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। পরের দিন বেবি-ট্রেক্সি শ্রমিকদের হরতাল ঢাকাতে আন্দোলনের নতুন মাত্রা যোগ করে। মস্কোপন্থিরা ঐক্য গঠনের জোর চেষ্টা চালাতে থাকে। এই পর্যায়ে সর্বদলীয় ঐক্য গঠনের আহবানে ছাত্রদের পক্ষ থেকে ছাত্র ইউনিয়ন মতিয়াপন্থি ও ছাত্রলীগ চাপ দিতে থাকলেও চিনপন্থিরা জাতীয়তাবাদী সংকীর্ণ স্বার্থে সর্বহারার আন্তর্জাতিকতাবাদ কে ত্যাগ করে...ঐক্য হতে পারেনা। তাই ভাসানীপন্থি ন্যাপ ঐক্যবদ্ধ না হয়ে নিজেদের মতো স্বাধীন বাংলার জন্য আন্দোলন চলমান রাখে। নির্বাচনকে বর্জন করে। চিনপন্থিদের সমাজ বিশ্লেষণে পূর্বেই ধরা পড়ে পাকিস্থান আর থাকছে না। তবু সেইকালে ন্যাপ মুজাফ্ফর ও সিপিবি আওয়ামী লীগকে বারবার নিজেদের লোক ভাবতে থাকে। এরা ৭০-এর নির্বাচন করল কিন্তু ক্ষমতা না পেয়ে মুক্তিযুদ্ধের ডাক দিলেন। যদিও ন্যাপ, সিপিবি ও আওয়ামী লীগ পাকিস্থানের ভাঙন কখনো চায়নি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালিন সময়ে চিনপন্থিরা স্বশস্ত্র শক্তি নিয়ে সংগ্রাম চালিয়ে যায়। সংগ্রাম দিনকে দিন বেগবান হতে থাকলে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি মস্কোপন্থিরা সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে যোগাযোগ শুরু করে এবং ভারত সরকার কে চিনপন্থিদের অবস্থান অবগত করলে দ্রুত বাংলাদেশ স্বাধীন করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ভারতের সাথে পাকিস্থানের যুদ্ধ লেগে যায়। রাশিয়ার হস্তক্ষেপে মুক্তিযুদ্ধ বন্ধ করা হয় যা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে চিনের সাম্রাজ্য বিস্তারের লড়াই। একটি পরীক্ষিত যুদ্ধ ছাড়াই একটি স্বাধীন দেশ পাই। পরিণতিতে কি হল? ১৯৭৫ পর দক্ষিণপন্থিরা ক্ষমতায় আবার প্রতিষ্ঠিত হল। জিয়াউর রহমানের হত্যার পরপর সাত্তার সরকারের আমলে কোন মুক্তিযোদ্ধাকেই সরকারে রাখা হল না। এরশাদ সরকার মার্কিনীদের দালালে পরিণত হন একমাত্র তার আমলের ব্যক্তিগত পুঁজির বিকাশ, ব্যবসা বাণিজ্যের উন্নতি ঘটে। যে স্বৈরাচারী আইয়ুব হঠানোর জন্য ছাত্র ইউনিয়ন মেননপন্থি ও জাতীয় ছাত্র ফেডারেশন রাশেদপন্থিরা শুরু করেছিল তা আর শেষ হল কই? নতুন খোলসে জিয়া ও এরশাদের আগমন। তাই আজ ছাত্র ইউনিয়ন মতিয়াগ্রুপ যখন থানায় থানায় কলেজ গুলোতে ইফতার পার্টির আয়োজন করে, তখন খুব বেশ অবাক হওয়ার মত নয়। কারণ মস্কোপন্থিরা ন্যাপ ও সিপিবি কখনো সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী ছিল না। তারা বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব করতে গিয়ে ৭১-এ ফেল করে...এখন ৭২-এর ভিশন নিয়ে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন চলে আসে মেননপন্থিরা এখন কোথায়?? ৭১ এর সমাজ বাস্তবতায় আমরা রাশিয়া ও ভারতের হস্তক্ষেপ ছাড়াই মুক্তিযুদ্ধ শেষ করতে পারতাম বা এখনো যুদ্ধ চলমান থাকত। যাক গে, ৭১ এর পরপর একটা শক্তিশালী বিরোধী দল গঠনের বাস্তবতা ছিল। তখনো বিএনপি, জাতীয় পার্টির জন্ম হয়নি। ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল। তখনকার বাস্তবতায় চেয়ে আজ বামদের ঘুরে দাঁড়ানোটা অনেক বেশি কঠিনতর। আজকের সমাজ বিশ্লেষণে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী লড়াইটা মুখ্য হয়ে উঠেছে। এর জন্য আওয়ামী লীগের সাথে জোট করে যেমন সম্ভব নয় আবার তৃতীয় বিকল্প শক্তি দিয়েও সম্ভব নয়। কারণ সমাজে দুইটা পক্ষ আছে দক্ষিণপন্থা ও বামপন্থা। তাই আপনি না চাইলেও জনগণ আপনাকে একদিকে ফেলে দিবেই।
তাই সকল বামদল গুলোর নিজ নিজ পার্টির কংগ্রেস করে একটা রাজনৈতিক লাইন ঠিক করতে হবে। এই প্রাথমিক কাজটা যদি তারা পারে...যদি মস্কো-চিনের মহাবিতর্ক থেকে শিক্ষা নেয়...তবেই প্রমাণ হবে আওয়ামী লীগ একটা সাম্প্রদায়িক দল।
সোমবার, ৪ জুন, ২০১৮
তৃতীয় কোনশক্তি নেই

Artikel Terkait
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
EmoticonEmoticon