রবিবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০১৮

আদিবাসী ও বিচ্ছিন্নতা

পাকিস্তান আমলে আমরা কিন্তু পরাধীন ছিলাম না। আমরা তখন স্বাধীন ছিলাম। "হাত মে বিড়ি, মু মে পান, লড়কে লেংগে পাকিস্তান। "এই শ্লোগানের অগ্রভাগে বাঙালি মুসলমানদের সংখ্যাই বেশি ছিল। আমরা আসলে পরাধীন ছিলাম ব্রিটিশ আমলে। আমরা আমাদের সংগ্রামের ফসল স্বাধীন পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছি মাত্র। যে বিষয় বা ঘটনা একাত্তরের জন্য দায়ী তা অধীনতা নয়, তা মূলত আঞ্চলিক বৈষম্য। আমরা আঞ্চলিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেছিলাম, যা কালক্রমে বিচ্ছিন্নতার যুদ্ধে পরিণত হয়। আমরা কি সাতচল্লিশে না একাত্তরে স্বাধীন হয়েছিলাম? অবশ্যই বিতর্কের বিষয়।
তবে কথা হলো আমরা বৈষম্য দূর করতে চেয়ে প্রতিবাদ করেছিলাম, প্রতিবাদ রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিল বিচ্ছিন্নতার যুদ্ধে এবং সেখান থেকেই আবার স্বাধীনতা । আমরা আমাদেরই একসময়ের পেয়ারা পাকিস্তানকে ভেঙে করেছি বাংলাদেশ। এক স্বাধীনতা থেকে পড়েছি আরেক স্বাধীনতায়।
সেদিনও আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন যে বঙ্গবন্ধু দুটো দেশের জাতির পিতা ছিলেন। ভাবার বিষয় বৈকি!

এবার ভাবুন, বাংলাদেশের পাহাড়ি জনগোষ্ঠী বা আদিবাসীদের কথা। দেখুন, এদের সঙ্গে বৈষম্যের পাকিস্তানি বৈষম্যের মিল খুঁজে পান কিনা।
আমরা বাঙালিরা  পাহাড়িদের বাঙালি হয়ে যেতে বলেছি। এটা কি জঘন্যতম সাংস্কৃতিক আগ্রাসন নয়?
আমরা বাঙালিরা উচ্ছেদ করছি তাদের ভিটেমাটি থেকে , এগুলো কি রাজনৈতিক আগ্রাসন নয়?
গুম, খুন, পুড়িয়ে হত্যা, ধর্ষণের নিত্যকার ঘটনা কি পাকিস্তানকে মনে করিয়ে দেয় না?
বিশাল এক সেনাবাহিনী নিয়োগ করেছি, আদিবাসীদের শায়েস্তা করার জন্য, পাহাড়িদের মধ্যে পরিকল্পিতভাবে ঢুকিয়ে দিচ্ছি বাঙালি, দখল করে নিচ্ছি তাদের জায়গা জমি সম্পদ।
পুড়িয়ে দিচ্ছি গ্রামের পর গ্রাম।
চুক্তি করে ভেঙে ফেলছি চুক্তির শর্তাবলী। করছি ওয়াদার বরখেলাপ।
এগুলো কি  যুদ্ধপূর্ব পাকিস্তানি অত্যাচারের চেয়ে কম ভয়াবহ?
সত্যিই যদি আদিবাসীরা তাদের মুক্তিযুদ্ধ শুরু করত তবে দেখা যেত বাঙালি মুসলমানের আসল চেহারা। ভুলে যাওয়া কঠিন, রাজাকার আলবদর আলশামস তো আমরাই।
ইংরেজ আর পাকিস্তানিরা যে ধরনের আচরণ করেছে আদিবাসীদের সঙ্গে, আমরা কি কোন অংশে কম করছি?

পাহাড়িরা যদি এসব আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার জন্য লড়াই করে, অন্যায় হবে?
ওদের কি আত্মরক্ষার অধিকার নেই?
ওদের কি সাংস্কৃতিক আগ্রাসন থেকে নিজেদের স্বাতন্ত্রিকতা বজায় রাখার অধিকার নাই?
ওদের ইজ্জত আব্রু সম্পদ কি ইতর বাঙালির চেয়ে কম দামি?
পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্নতা যদি ন্যায়সঙ্গত হতে পারে তবে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্নতাও ন্যায়সঙ্গত হতে বাধ্য। নয় কি?

বাঙালির সব ছিল। ভারত ছিল, সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল। স্বাধীনতা এসেছে।
আদিবাসীদের কেউ নাই, কিচ্ছু নাই। এরা বারবার মার খেয়েছে। মার খেয়েছে ইংরেজ আমলে, পাকিস্তান আমলে। এখন এই শেষ ভরসা বাংলদেশেও।
আদিবাসীদের কাছে বিচ্ছিন্নতা কিংবা স্বাধীনতার যুদ্ধ একটা ফাঁদ কারণ আওয়ামী লীগকে আওয়ামী মুসলিম লীগের ভুতে ধরেছে, কারণ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এই উছিলাটাই চাইছে।
আদিবাসীদের উপর নির্যাতন সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
সরকার এবং সেনাবাহিনী চাচ্ছে আদিবাসীরা লড়াইয়ে আসুক। তাহলে এদের সমূলে উচ্ছেদ করতে সহজ হবে।
তাই পাহাড়িদের তথাকথিত স্বাধীনতা যুদ্ধের পথে পা দেয়াটা হয়ে যেতে পারে চরম আত্মঘাতী।

ভৌগলিক বিচ্ছিন্নতাই শেষ কথা নয়, স্বাধীনতা নয় । স্বাধীনতা যুদ্ধ প্রতিদিনের যুদ্ধ।


EmoticonEmoticon