বৃহস্পতিবার, ১৬ মে, ২০১৯

কবি হেনরী স্বপন এর নি:শর্ত মুক্তি চাই !

হেনরি স্বপন কবি মানুষ। তিনবার তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। প্রথমবার তার অফিসে গিয়েছিলাম। দ্বিতীয়বার তিনি আমার অফিসে এসেছিলেন। তৃতীয়বার বিবির পুকুরপাড়ে। একদিন  আমি আর আমার ছোটো মেয়ে বিবির পুকুরের মাছগুলোকে চিপস খাওয়াচ্ছিলাম। মাছগুলোও ছিল পাঁজি। আমাদের চিপস না খেলে তাদের দিন কাটে না। খুব হৈচৈ করে। ফলে প্রতিদিন বিকেলে বাবামেয়ে আমাদের এই দুজনকে বিবির পুকুরপাড়ে যেতেই হয়।

সেদিনও গিয়েছিলাম। মেয়েটা মাছেদের চিপস দিচ্ছে। আর ফাল দিয়ে ফাল দিয়ে মাছগুলো গিলে নিচ্ছে। মাঝে মাঝে মেয়ে আমার তাদেরকে গানও শোনাচ্ছে। মেঘের কোলে রোদ হেসেছে বাদল গেছে টুটি। এই গানটি বিবির পুকুরের মাছগুলো আমার মেয়ের কাছ থেকে শিখে নিয়েছিল। তারা পুরো গানটা ঠিক ঠিক গাইতে পারত। মাছেদের এই গান তখন বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল।

এর মধ্যেই একদিন দেখি, হেনরি স্বপন পুকুর পাড় দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। বললাম, কেমন আছেন? তিনি থামলেন না। দাঁড়াবার সময় নেই।  দ্রুতপায়ে অশ্বিনীকুমার টাউন হলে চলে গেলেন। সেখানে কবিতা পড়বেন। পায়ে স্যান্ডেল।

বরিশালের হেনরি স্বপনের কবিতা শোনা হয়নি। কিন্তু মাছেদের গান শুনেছি অনেক।

এর মধ্যে আমরা শুধু বরিশাল নয়-- দেশ  ছেড়ে গেছি। আমার ছোটো মেয়ে এখন বাফেলো ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। প্রায়ই নায়েগ্রা ফলসে যায়। আমাকে ফোন করে শুধায়, বিবির পুকুরের মাছগুলো এখন কেমন আছে। নিশ্চয়ই অনেক বড়ো হয়েছে। নিশ্চয়ই তারা রোজ বিকেলে অপেক্ষা করে। চিপস খেতে খেতে মেয়ের কাছ থেকে আরেকটি গান শিখবে।

এই আলোচনার মধ্যে হেনরি স্বপন নেই। তিনি কবি মানুষ। হয়তো কবিতা নিয়ে খুব ছোটাছুটি করছেন। কোথাও কবিতা পড়তে ব্যস্ত আছেন।  তিনি মাছে খবর জানেন না।

আজ দেখি তাতুন হেনরি স্বপনের ছবি পাঠিয়েছে। আইসিটি আইনে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছে। তার অপরাধ, তিনি স্থানীয় খ্রিস্টান ধর্মযাজকের সমালোচনা করেছেন। শ্রীলংকায় যেদিন বোমা হামলা হলো, সারা পৃথিবী যখন বিষাদে চোখের জল ফেলছে-- সেই সেদিন সেসময়ে বরিশালের যাজক সাহেব চার্চে গানবাজনায় মশগুল। বোমা হামলায় প্রায় তিনশত নিরীহ মানুষের মৃত্যু তাকে স্পর্শ করেনি। কিন্তু কবি স্বপনকে করেছে।

কবি হেনরি স্বপন ফেসবুকে যাজককে কবির মতো করে খুব নিরীহভাবে সমালোচনা করে একটি স্ট্যাটাস লিখেছিলেন। সেজন্যে তাকে এক রাতে কিছু লোকজন ভুত সেজে এসে হুমকি দিয়েছিল। স্বপন এজন্য থানায় জিডি করেছিলেন।

পুলিশ যাজকের ভুতগুলোকে গ্রেফতার করেনি। করেছে কবিকে। কবির বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার মামলা করেছেন এই খ্রিস্টান যাজক। বেচারা।

যীশুকে ধর্ম অবমাননার দায়ে ক্রুশে চড়ানো হয়েছিল। হেনরি স্বপন যীশুর ধর্মে জন্ম নিয়েছেন। আজ তার বিরুদ্ধেও ধর্ম অবমাননার মামলা হলো।

অথচ যীশুকে নিয়ে এইকালে মহা মহা বই লেখা হয়েছে। মহা মহা সিনেমা হয়েছে। সেখানে যীশুকে ঈশ্বরের পুত্র হিসেবে নয়, যকরিয়ার পুত্র হিসেবে দেখানো হয়েছে। অবিবাহিত যীশুকে মাগদিলিনির স্বামী বলা হয়েছে। বলা হয়েছে যীশুর ছেলেমেয়ে নাতিপুতি ছিল। তার ধর্ম নিয়ে মহা ঠাট্টা মশকরা করা হয়েছে। কেউ এদের বিরুদ্ধে ধর্ম অবনাননার মামলা আনেনি। এনেছে কবি স্বপন হেনরি নামে বরিশালের এক নিরীহ কবির বিরুদ্ধে। এ অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করার প্রশ্নই আসে না। কিন্তু পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছে।

গ্রেফতারের আগে স্বপনের বিরুদ্ধে খ্রিস্টান সম্প্রদায় কোনো মিটিং মিছিল করেনি। কোনো খ্রিস্টান তাওহিদী জনতা প্রধান চার্চ থেকে সরকারের প্রতি হুংকারও ছাড়েনি। কেউ তার মাথার দামও হাঁকেনি। তাহলে স্বপনকে গ্রেফতার করা হলো কেনো?

এর জবাব হলো, দেশে ইসলাম ধর্ম অবমাননার অভিযোগে সরকার ইসলামী কট্টরপন্থীদের চাপে নাস্তিক, যুক্তিবাদী, বিজ্ঞানমনষ্ক, মুক্তমনা, ভীন ধর্মের মানুষদের গ্রেফতার করছে। তাদের চাপের মুখে ব্লাশফেমি আইন চালু করতে চায়। সেজন্যে শুধু ইসলাম  ধর্মের নয়, অন্য ধর্মের কট্টরপন্থীদের কাছ থেকেও ধর্ম অবমাননার অভিযোগ ওঠা প্রয়োজন। তাহলে ব্লাশফেমী আইন করার দায় কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মের কট্টরপন্থীদের উপর নয়, অন্য ধর্মের উপরও পড়বে। আইন করাটা সহজ হতে যাবে।

আমার তো ধারণা এরপর হিন্দু, বৌদ্ধ ধর্মের কোনো পুরোহিত লোকজন তাদের সম্প্রদায়ের কারো বিরুদ্ধে অতি নিরীহ অভিযোগ করলেও সরকারের নির্দেশে পুলিশ আইসিটি আইনে গ্রেফতার করবে।

এটা একটা ট্রাপ।


EmoticonEmoticon