![]() |
কার্ল মার্ক্স |
ভূমিকা
কার্ল মার্ক্স (১৮১৮-১৮৮৩) শুধু একজন অর্থনীতিবিদ বা রাজনৈতিক চিন্তাবিদই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন গভীর দার্শনিক যার চিন্তা সমাজ, ইতিহাস ও অর্থনীতিকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করেছে। মার্ক্সের দর্শন শুধু তত্ত্বে সীমাবদ্ধ নেই, এটি সমাজ পরিবর্তনের একটি কর্মসূচি। তাঁর দর্শনের মূল উপাদান হলো ঐতিহাসিক বস্তুবাদ, শ্রেণীসংগ্রাম, alienation (বিচ্ছিন্নতা), এবং সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ধারণা।
১. ঐতিহাসিক বস্তুবাদ (Historical Materialism)
মার্ক্সের দর্শনের কেন্দ্রীয় স্তম্ভ হলো ঐতিহাসিক বস্তুবাদ, যা তিনি ফ্রিডরিখ এঙ্গেলসের সাথে যৌথভাবে বিকশিত করেন। এই তত্ত্ব অনুসারে, সমাজের ভিত্তি হলো উৎপাদন ব্যবস্থা। মানুষের চিন্তা, সংস্কৃতি, রাজনীতি—সবকিছুই নির্ধারিত হয় উৎপাদনশক্তির বিকাশ ও উৎপাদন সম্পর্কের মাধ্যমে।
উৎপাদন পদ্ধতির পর্যায়: মার্ক্স ইতিহাসকে বিভিন্ন উৎপাদনমূলক ব্যবস্থার পর্যায়ে বিভক্ত করেন:
আদিম সাম্যবাদ
দাসপ্রথা
সামন্ততন্ত্র
পুঁজিবাদ
সমাজতন্ত্র ও কমিউনিজম (শেষ লক্ষ্য)
অধিবিদ্যার সমালোচনা: মার্ক্স হেগেলের আদর্শবাদকে খারিজ করে বলেন, "অস্তিত্বই চেতনা নির্ধারণ করে, চেতনা অস্তিত্ব নির্ধারণ করে না"। অর্থাৎ বাস্তব জগতের বস্তুগত অবস্থাই মানুষের চিন্তাকে প্রভাবিত করে।
২. শ্রেণীসংগ্রাম (Class Struggle)
মার্ক্সের মতে, "সমস্ত সমাজের ইতিহাস হলো শ্রেণীসংগ্রামের ইতিহাস" (The Communist Manifesto)। প্রতিটি যুগে শোষক (যেমন—সামন্ত lords, পুঁজিপতি) ও শোষিত (দাস, কৃষক, শ্রমিক) শ্রেণীর মধ্যে সংঘাত বিদ্যমান।
পুঁজিবাদে শ্রেণীদ্বন্দ্ব:
বুর্জোয়া (পুঁজিপতি): যারা উৎপাদনের উপকরণের মালিক
প্রলেতারিয়েত (শ্রমিক): যাদের শুধু নিজের শ্রম বিক্রি করার সামর্থ্য আছে।
মার্ক্সের মতে, শ্রমিকরা একদিন সংঘবদ্ধ হয়ে পুঁজিবাদ উৎখাত করবে।
৩. Alienation (বিচ্ছিন্নতা বা বহিষ্করণ)
মার্ক্সের প্রারম্ভিক দার্শনিক রচনা "Economic and Philosophic Manuscripts of 1844"-এ তিনি alienation ধারণাটি বিশ্লেষণ করেন। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শ্রমিকেরা চারভাবে বিচ্ছিন্ন হয়:
1. নিজের উৎপাদিত পণ্য থেকে (পণ্যে তার শ্রম থাকলেও তার ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই)।
2. নিজের শ্রম প্রক্রিয়া থেকে (শ্রম শুধু জীবিকা উপার্জনের মাধ্যম, আনন্দদায়ক নয়)।
3. স্বীয় সত্তা থেকে (শ্রমিকের সৃজনশীলতা ধ্বংস হয়)।
4. অন্য মানুষের থেকে (পুঁজিপতি ও শ্রমিকের সম্পর্ক শোষণের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে)।
৪. অতিরিক্ত মূল্য (Surplus Value) ও শোষণ
মার্ক্স ব্যাখ্যা করেন যে, শ্রমিকরা তাদের শ্রমশক্তির মাধ্যমে যে পরিমাণ মূল্য উৎপন্ন করে, তার একটি অংশ তারা মজুরি হিসেবে পায়, কিন্তু অবশিষ্ট অংশ পুঁজিপতির লাভ হয়ে যায়। এটিই হলো অতিরিক্ত মূল্য (Surplus Value), যা পুঁজিবাদী শোষণের মূল কারণ।
৫. বিপ্লব ও সাম্যবাদের দর্শন
মার্ক্সের দর্শনের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো একটি শ্রেণীহীন, রাষ্ট্রহীন সমাজ (কমিউনিজম) প্রতিষ্ঠা। তাঁর মতে:
পুঁজিবাদ নিজেই নিজের ধ্বংস ডেকে আনে (অতিরিক্ত উৎপাদন, অর্থনৈতিক সংকট, শ্রমিক অসন্তোষ)।
প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব (Dictatorship of the Proletariat): পুঁজিবাদ উৎখাতের পর একটি অন্তর্বর্তী সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে।
চূড়ান্ত লক্ষ্য কমিউনিজম: যেখানে "প্রত্যেকে সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করবে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী পাবে"
৬. বর্তমান বিশ্বে মার্ক্সবাদের প্রাসঙ্গিকতা
বর্তমান বিশ্বে যুদ্ধ, দারিদ্র্য, পরিবেশগত সংকট এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মার্ক্সবাদ একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে।
শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা: সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন, অর্থনৈতিক অসাম্য ও জাতিগত সংঘাতের সমাধান মার্ক্সবাদী সমতার দর্শনে নিহিত।
মানবিক জীবন গঠন: শ্রমিক অধিকার, গণতন্ত্র ও ন্যায়সঙ্গত সমাজব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য শ্রেণী সংগ্রাম ও সমবণ্টনের নীতির প্রয়োজনীয়তা।
জলবায়ু পরিবর্তন ও পুঁজিবাদ: পরিবেশগত বিপর্যয় প্রতিরোধে মুনাফার পরিবর্তে মানবিক প্রয়োজনকে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।
৭. সমালোচনা ও বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি
মার্ক্সের দর্শনের সমালোচনাগুলো হলো:
অতিসরলীকরণ: ইতিহাসকে শুধু অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না (ধর্ম, সংস্কৃতি, জাতীয়তাবাদও গুরুত্বপূর্ণ)।
স্বাধীনতার প্রশ্ন: কমিউনিস্ট রাষ্ট্রগুলোতে ব্যক্তি স্বাধীনতা খর্ব হয়েছে (যেমন সোভিয়েত ইউনিয়ন)।
অর্থনৈতিক ভবিষ্যদ্বাণী: পুঁজিবাদ ধ্বংস হয়নি, বরং রূপান্তরিত হয়েছে (কল্যাণ রাষ্ট্র, শ্রমিক অধিকার)।
তবে, কিছু বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে:
গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: ব্যক্তি স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক সাম্য বজায় রেখে সমাজতান্ত্রিক রূপান্তর সম্ভব।
বাজার সমাজতন্ত্র: সম্পূর্ণ রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির পরিবর্তে একধরনের মিশ্র ব্যবস্থা যেখানে শ্রমিকরা উৎপাদন ব্যবস্থার মালিক হবে।
উপসংহার
কার্ল মার্ক্সের দর্শন শুধু তাত্ত্বিক নয়, এটি বিশ্বব্যাপী সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। বর্তমান বিশ্বে শান্তি, সাম্য ও মানবিকতার পথে এগিয়ে যেতে মার্ক্সবাদের গুরুত্ব অপরিসীম। মার্ক্সবাদ আজও শোষণ-বিরোধী আন্দোলনের প্রেরণা হিসেবে টিকে আছে।
> "দার্শনিকদের শুধু পৃথিবীকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে; কিন্তু আসল কাজ হলো একে বদলে দেওয়া।"
— কার্ল মার্ক্স, Theses on Feuerbach (১৮৪৫)
EmoticonEmoticon