বুধবার, ৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৯

সাবেক রাষ্ট্রদূত লেঃ কর্ণেল (অবঃ) শরিফুল হক ডালিম বীর উত্তম এর লেখা থেকে

** চরম দুর্নীতির ফলেই ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ হয়
** শেখ মুজিব গণতন্ত্রকে হত্যা করেন
** আওয়ামী দু:শাসন এবং দুর্নীতির মুখোমুখি সামরিক বাহিনী
** '৭১ এর চেতনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা, আওয়ামী কুশাসন এবং প্রতিরোধ
** বাকশাল ছিল দু-মুখী অস্ত্র
* জাতীয় রক্ষীবাহিনীর অত্যাচার সীমাহীন হয়ে পড়ে
** বিশেষ ক্ষমতা অর্ডিন্যান্স জারি করা হয় এবং সংবিধানের কতিপয় ধারা স্থগিত ঘোষণা করা হয়। সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
১৯৭২ সালের যে কোন জাতীয় সংবাদপত্র খুললে প্রথমেই চোখে পড়বে খুন, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানী, আর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির খবর। প্রতিদিন দেশের শহরগুলোতে ঘটছিল প্রকাশ্য খুন, ডাকাতি ও রাহাজানীর ঘটনা। গ্রামে-গঞ্জেও চলছিল ত্রাসের রাজত্ব। ক্রমবর্ধমান এ ত্রাসের নাগপাশে জনগণ এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় কাল অতিবাহিত করছিল। যখন জনগণের পরনে কাপড় নেই তখনই ঘটেছিল সুতা নিয়ে কেলেংকারী। পেটে যখন ভাত নেই তখন লাখ লাখ টন বিদেশী সাহায্যে প্রাপ্ত খাদ্য নির্বিবাদে পাচাঁর হয়ে গিয়েছিল সীমান্তের ওপারে।
মার্চের শুরু থেকেই খবর আসতে থাকে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে- মানুষ মরছে অনাহারে, না খেয়ে। বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর, টাঙ্গাইলে বিরাজ করছে দুর্ভিক্ষ অবস্থা। আকাশচুম্বী দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল বের হতে থাকে স্থানে স্থানে। এ অবস্থায় ভারতীয় দূতাবাসের মুখপাত্রও স্বীকার করেন যে, চোরাচালান হচ্ছে ব্যাপক হারে। তারা বলেন, “সীমান্ত বাণিজ্য চুক্তি হয়ে গেলেই এই চোরাচালান বন্ধ হবে।” এ বক্তব্য দূতাবাস থেকে দেয়া হয় ২৩-৩-১৯৭২ তারিখে। দুর্নীতি ছড়িয়ে পরে দেশের সব জায়গায়, সর্বস্তরে।
১৯৭২ সালের ৬ই জুন দৈনিক বাংলার  খবর - গ্রেফতারকৃত চোরাচালানীরা প্রভাবশালী ক্ষমতাসীন নেতাদের চাপে ছাড়া পাচ্ছে।
আগষ্ট মাসে দেশে বন্যা শুরু হয়। আসে বিস্তর রিলিফ। রিলিফ নিয়ে লুটপাটের কাহিনী পাওয়া যাবে ১৯৭৪ সালের আগষ্ট, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বর, ডিসেম্বর মাসের সংবাদপত্রসমূহে। অবাধ লুটপাট চলে বাশঁ, টিন, খাদ্যসামগ্রী, রিলিফের ঔষধপত্র এবং কম্বল নিয়ে।
প্রতিদিনের সংবাদপত্রে ছাপা হয় ক্ষুধাতুর মানুষের ছবি। অন্ন নেই, বস্ত্র নেই, মাথা গোজাঁর ঠাই নেই। কোটি কোটি লোক হয় ক্ষতিগ্রস্ত ও  বাস্তুহারা। ৩রা আগষ্ট ইত্তেফাকে ছাপা হয় এসব ছবি। কমেন্ট >
ইত্তেফাকে ছাপা হয় এসব ছবি। দৈনিক বাংলায় খবর বের হয়, বমি খাচ্ছে মানুষ। বাংলাদেশ রেডক্রস সর্ম্পকে প্রকাশিত হয় চুরি, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অসংখ্য অভিযোগ।
মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা চলে। সে সময়কার পত্রিকার পাতা উল্টালে গা শিউরে উঠে। মানুষের সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ কেড়ে নেয় লাখ লাখ মানুষের প্রাণ। হাজার হাজার চাষী যারা একদা কষে ধরতো লাঙ্গল, মাঠ ভরে তুলত সবুজ শস্যের সমারোহে, তারা ভিক্ষার জন্য শহরের মানুষের কাছে হাত পাতে। ফিরে যায় ভিক্ষা না পেয়ে। তারপর বেওয়ারিশ লাশ হয়ে পড়ে থাকে।
আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম প্রতিদিন ঢাকা শহর থেকেই তিরিশ থেকে চল্লিশটি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করছিল। সে কাহিনী ও ছবি আছে সেই সময়কার দৈনিক সংবাদপত্রগুলোর পাতায় পাতায়। ঢাকায় প্রতি ঘন্টায় ৩-৪ জন লোক মারা যেতে থাকে অনাহারে। এর এক পর্যায়ে আঞ্জুমানের লাশ দাফনের কথা খবরের কাগজে প্রকাশ করা বন্ধ করে দেয়া হয় সরকারি আদেশে।
শেখ মুজিব বাকশালের মাধ্যমে নিজের ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চেয়েছিলেন কিন্তু শেখ মনি এবং তার দোসররা চেয়েছিল বাকশালকে ক্ষমতা দখলের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করতে।
দেশের এই দূরাবস্থায় শেখ মুজিবের ক্ষমতালিপ্সা বেড়ে গেল। ক্ষমতার চূড়ায় অবস্থান করেও তার সন্তুষ্টি ছিল না। রাষ্ট্রের সর্বক্ষমতা তার নিজ হাতে কুক্ষিগত করার জন্য তিনি একদলীয় শাসন ব্যবস্থার কথা চিন্তা করতে লাগলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের একটি মূল উপাদান ছিল গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা এর জন্যই হয়তো বা শেখ মুজিব এতদিন এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেননি। তার এই মনোভাব জানতে পেরে দলীয় সুবিধাবাদী গোষ্ঠি নিজেদের স্বার্থ ও ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য তাকে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করার জন্য প্ররোচণা দিতে থাকে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর হাজার হাজার কোটি টাকার অস্ত্র, গোলাবারুদ, স্বর্ণ, মূল্যবান ধাতু, যানবাহন, মিল-কারখানার মেশিনপত্র, কাঁচামাল ভারতের হাতে তুলে দিয়ে আওয়ামী লীগ সমগ্র জাতিকে প্রতিপক্ষ করে স্বাধীনতার সোল এজেন্ট সেজে বসেছিল। এসবের প্রতিবাদ করতে যাওয়ায় দেশমাতৃকার অন্যতম সেরা সন্তান ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর জলিলকে গ্রেফতার করা হয়েছিল; প্রাণ হারাতে হয়েছিল বিপ্লবী সিরাজ সিকদার ও হাজারো মুক্তিযোদ্ধাকে। লাঞ্ছণার শিকারে পরিণত হতে হয় অনেক দেশপ্রেমিককে। দীর্ঘমেয়াদী অসম চুক্তির মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বন্ধক রেখেছিল আওয়ামী লীগই।
লালবাহিনী, নীলবাহিনী, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী, রক্ষীবাহিনীসহ ইত্যাকার নানা রকমের বাহিনী গঠনের দ্বারা দুঃসহ নৈরাজ্য সৃষ্টি করার মধ্য দিয়ে বিনা বিচারে ত্রিশ হাজার থেকে চল্লিশ হাজার রাজনৈতিক কর্মীর প্রাণ সংহার করার কালো ইতিহাস আওয়ামী-বাকশালীদের দ্বারাই সৃষ্টি হয়েছিল। বন্দী অবস্থায় রাজনৈতিক নেতা জনাব সিরাজ সিকদারকে নির্মমভাবে পাশবিক অত্যাচার করে হত্যা করার পর শেখ মুজিব স্বয়ং সংসদ অধিবেশনে ক্ষমতার দম্ভে বলেছিলেন, “কোথায় আজ সিরাজ সিকদার?”
১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকেই শেখ মুজিব একদলীয় শাসন ব্যবস্থার পক্ষে প্রচারণা শুরু করেন। নভেম্বর ১৯৭৪-এ মস্কোপন্থী দলগুলোও সংসদীয় গণতন্ত্রের ব্যর্থতার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারকে একদলীয় শাসন কায়েম করার জন্য আহ্‌বান জানায়। শেখ মুজিবের একান্ত বিশ্বস্ত তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব মনসুর আলীকে সোভিয়েত ইউনিয়নের দূতাবাসে ডেকে একদলীয় সরকার কায়েমের পরামর্শ দেয়া হয়। মনসুর আলী, শেখ মনি এবং মস্কোপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর প্ররোচণা এবং শেখ মুজিবের নিজের ক্ষমতাকে আরো বাড়িয়ে তোলার বাসনা ও রাষ্ট্রকে সবদিক দিয়ে তার এবং তার দলের অনুগত রাখার জন্য একদলীয় সরকার কায়েমের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
একদলীয় শাসন ব্যবস্থা বাকশাল কায়েম করে গণতন্ত্রের কবর রচনা করে এক আদেশ জারি করলেন শেখ মুজিব।
পরে জেনারেল ওসমানী ও জনাব ব্যারিষ্টার মঈনুল হোসেন একদলীয় শাসন ব্যবস্থার বিরোধিতা করে তাদের সংসদ সদস্যপদ থেকে ইস্তফা দেন। আওয়ামী লীগের প্রবীণ গণতন্ত্রীমনা নেতৃবৃন্দ শেখ মুজিবের এই পদক্ষেপে ভীষণ অসন্তুষ্ট হন। বাকশাল গঠনের পর দেশের রাজনৈতিক অবস্থার কথা ভেবে তারা চিন্তিত হয়ে পড়েন। বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে হত্যা করার জন্য অন্য কেউই দায়ী নন। স্বয়ং শেখ মুজিবই হত্যা করেছিলেন গণতন্ত্রকে। দেশে একনায়কত্বের বিরুদ্ধে চাপা অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। বাকশাল গঠনের দিন অনেকেই বলেছিলেন, “শেখ মুজিব নিজেই আওয়ামী লীগের নীতি-আদর্শ বিসর্জন দিলেন স্বীয় স্বার্থে।”
বাকশাল গঠন করার আগে শেখ মুজিব কোন পদ্ধতিই অনুসরন করেননি। সংসদীয় দলের মিটিংয়ে অনেকেই বাকশাল গঠনের বিরুদ্ধে বক্তব্য রেখেছিলেন। দ্বিতীয় দিনের অধিবেশনে জনাব নূরে আলম সিদ্দিকী ৫৫মিনিট  বক্তৃতা করেন। তার জ্বালাময়ী বক্তৃতায় শেখ মুজিব প্রমাদ গুনেছিলেন। তার কারণ, এ বক্তৃতাকে সংসদ সদস্যদের বৃহৎ অংশ ঘনঘন করতালির মাধ্যমে সমর্থন জানান। এই বক্তৃতার পর অধিবেশন মূলতবী ঘোষণা করা
পরদিন জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী এবং জনাব শামছুল হকও বক্তৃতা করার অনুমতি চান। কিন্তু তাদের সে অনুমতি না দিয়ে জনাব শেখ মুজিব গম্ভীর স্বরে সবাইকে বলেন, “আর বক্তৃতা নয়। তোমরা আমারে চাও কি না সে কথাই শুনতে চাই।” সবাই তার এ ধরণের বক্তব্যে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন। কথা ছিল, সব সদস্যকেই এ প্রস্তাবের উপর বক্তব্য রাখার সুযোগ দেয়া হবে। তিনি আবার বললেন, “বলো, আমারে চাও কিনা?” এরপর তার বিরোধিতা করার সাহস আর কারো হল না। কিন্তু বঙ্গবীর জেনারেল ওসমানী এরপরও তার বক্তৃতায় নির্ভয়ে বলেন, “আমরা ইয়াহিয়া খানকে সরিয়ে মুজিব খানকে চাই না।”
বাকশালের জগদ্দল পাথর বাংলাদেশের মানুষের বুকের উপর এভাবেই চেপে বসল। এ পাথরকে উপড়ে না ফেলা পর্যন্ত মানুষের নিস্তার নেই। এর পরই সরকারি আদেশ জারি করে আইন বিভাগের স্বাধীনতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও জনগণের মৌলিক স্বাধীকার ছিনিয়ে নেয়া হয়।


EmoticonEmoticon