ফিলিস্তিন সংকট, হিটলারের নামাঙ্কিত ভ্রান্তি এবং ন্যায়ের সার্বজনীনতা
আজকের বিশ্বে সবচেয়ে বেদনাদায়ক রাজনৈতিক সংকটগুলোর একটি হলো ফিলিস্তিন সংকট। এটি কেবল একটি ভূখণ্ডগত বিরোধ নয়—বরং ইতিহাস, অধিকার, জাতীয়তাবাদ, উপনিবেশবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তির এক জটিল মোড়কে গাঁথা এক নির্মম বাস্তবতা। ফিলিস্তিনিদের ওপর বছরের পর বছর ধরে চলা নিপীড়ন, হত্যা, ঘরবাড়ি ধ্বংস, ভূমি দখল এবং নাগরিক অধিকারের অবমাননা—এই সবকিছু একটি সুসংগঠিত দখলদার রাষ্ট্রের নৃশংসতার চিত্র তুলে ধরে।
এই প্রসঙ্গে প্রতিবাদ যেমন জরুরি, তেমনি সেই প্রতিবাদের ভেতরে থাকা নৈতিক বোধ ও যুক্তিবোধ আরও জরুরি। আজকে আমরা দেখতে পাই—ফিলিস্তিনের প্রতি সহমর্মী কিছু মানুষ ইজরায়েলের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে এমন কিছু অবস্থান নিচ্ছেন, যা কেবল ইতিহাস বিকৃতি নয় বরং মানবতাবিরোধী দর্শনের প্রশ্রয় হয়ে দাঁড়ায়। এর সবচেয়ে কুরুচিপূর্ণ দৃষ্টান্ত হলো—হিটলারকে 'নায়ক' হিসেবে তুলে ধরা।
ইহুদি বিদ্বেষ নয়, শোষণবিরোধিতা হোক আমাদের অবস্থান
ইজরায়েলের রাষ্ট্রীয় নীতির কঠোর সমালোচনা করা এক কথা, আর সব ইহুদি জনগোষ্ঠীকে দোষী বা শত্রু ভেবে ঘৃণা ছড়ানো আরেক কথা। ইতিহাসে ইহুদি জাতি যুগে যুগে নানা নিপীড়নের শিকার হয়েছে। মধ্যযুগ থেকে শুরু করে ২০শ শতকের নাৎসি জার্মানির অধীনে গণহত্যা—এই জাতিকে ঘিরে ঘৃণা কখনোই ন্যায়সঙ্গত ছিল না। আজ যখন কেউ ইহুদি পরিচয়কেই সমস্যার মূলে তুলে ধরে, তখন সে ইতিহাসেরই আরেক ধারায় নিপীড়নের যোগসূত্রে অংশ নেয়।
বিশ্বের বহু ইহুদি ব্যক্তি ও সংগঠন আজও ইজরায়েলের দখলদার নীতির বিরুদ্ধে কথা বলেন। "Jewish Voice for Peace", "Neturei Karta", এমনকি স্বয়ং ইজরায়েলের মধ্যেও অসংখ্য নাগরিক, সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী রয়েছেন যারা নিজেদের রাষ্ট্রের অন্যায়ের প্রতিবাদ করছেন। সুতরাং, ধর্ম বা জাতিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে সকলকে দায়ী করা শুধু অনৈতিকই নয়, বরং তা একটি ভুল দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন।
হিটলার: ইতিহাসের এক কলঙ্ক, কোনোভাবেই নায়ক নয়
আশ্চর্যের বিষয়, কিছু মানুষ ইজরায়েলের অপরাধের প্রতিবাদ করতে গিয়ে হিটলারকে ‘নায়ক’ হিসেবে তুলে ধরেন। এটি কেবল অজ্ঞতা নয়, বরং মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রতি পরোক্ষ সমর্থন। হিটলার একজন যুদ্ধাপরাধী, একনায়ক, ফ্যাসিস্ট, এবং জাতিগত নিধনের স্থপতি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি ৬০ লক্ষ ইহুদি, হাজার হাজার রোমা, প্রতিবন্ধী, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও অন্য জাতিগোষ্ঠীর লোকদের গ্যাস চেম্বারে পাঠিয়ে হত্যা করেন।
তাকে নায়ক বানানো মানে ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ গণহত্যাকে বৈধতা দেওয়া, যার অর্থ দাঁড়ায়—ফিলিস্তিনিদের মতো নির্যাতিতদের পক্ষ থেকে কথা বলার নৈতিক অধিকার আমরা নিজেরাই খর্ব করছি। যে প্রতিবাদ ঘৃণার উপর দাঁড়ায়, তা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না।
গোলান মালভূমি: দখলদারির রাজনৈতিক প্রতিচ্ছবি
১৯৬৭ সালের ছয়দিনের যুদ্ধে ইজরায়েল সিরিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমের গোলান মালভূমি দখল করে নেয়। ঐ যুদ্ধের সময় ইজরায়েল একযোগে মিশর, জর্ডান এবং সিরিয়ার বিপক্ষে হামলা চালায় এবং তাদের অনেক ভূখণ্ড কব্জা করে নেয়। ১৯৮১ সালে ইজরায়েল এই মালভূমিকে নিজেদের অংশ হিসেবে ঘোষণা করলেও জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আজও সেটিকে “ইজরায়েল অধিকৃত সিরীয় অঞ্চল” হিসেবেই চিহ্নিত করে।
২০১৯ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইজরায়েলের সেই দখলদারিত্বকে স্বীকৃতি দেন এবং পরে ইজরায়েল সেই এলাকাতে "Trump Heights" নামক বসতি স্থাপন করে। এটি সাম্রাজ্যবাদী সহযোগিতার একটি নিদর্শন।
কিন্তু প্রশ্ন হলো—এই ঘটনার জন্য কেবল আমেরিকার জনগণকে দোষারোপ করাটা কতটা যুক্তিসঙ্গত? রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি এবং নাগরিকদের নৈতিক অবস্থান সবসময় এক নয়।
বয়কট, ভিসা ও নাগরিকত্ব: বাস্তবতা বনাম আবেগ
প্রতিবাদ মানেই যে সবকিছু ত্যাগ করে আগুনে ঝাঁপ দেওয়া, তা নয়। কেউ কেউ যুক্তি দেন—“যদি সত্যিই আমেরিকা দখলদারদের পক্ষ নেয়, তাহলে কেন কেউ তাদের পণ্য ব্যবহার করে? কেন ভিসা নেয়?” কিন্তু এমন প্রশ্নগুলো বাস্তবতা বিচ্ছিন্ন।
বিশ্বায়নের যুগে আমেরিকার পণ্য ও সেবা অনেক ক্ষেত্রেই অপরিহার্য। শিক্ষার জন্য আমেরিকায় যাওয়া মানেই কি সেই রাষ্ট্রের সকল নীতিকে সমর্থন করা? অনেকে বয়কট করেন, কেউ কেউ করেন না—কিন্তু সেটি ব্যক্তি পরিস্থিতির উপর নির্ভরশীল। বয়কটও একটি কৌশল, প্রতিবাদের একমাত্র পথ নয়।
তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো—যে অবস্থানই নেওয়া হোক, সেটা যেন যুক্তিবোধ ও মানবতার জায়গা থেকে হয়।
প্রতিবাদের নৈতিকতা এবং সার্বজনীন মানবতা
ফিলিস্তিনিদের মুক্তির সংগ্রাম একটি ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন। কিন্তু এই ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াতে গিয়ে যদি আমরা নিজেরাই অন্যায়কে প্রশ্রয় দিই, ইতিহাস বিকৃতি করি, ঘৃণাকে উৎসাহ দিই—তবে আমরা আর ন্যায়ের প্রতিনিধি থাকি না। তখন আমরা হয়ে যাই আরেক ঘৃণার ধারক, যা মূল সমস্যাকে আরও জটিল করে তোলে।
উপসংহার
ফিলিস্তিন সংকট আমাদের বিবেককে প্রশ্ন করে—আমরা কী ন্যায়ের পক্ষে? না ঘৃণার? আমরা কি সত্যিকার প্রতিবাদ করতে পারি, না কেবল আক্রোশের নামে আরেক ইতিহাসের ভুলকে প্রশ্রয় দিই? যদি সত্যিই ফিলিস্তিনিদের পাশে দাঁড়াতে চাই, তবে আমাদের উচিত যুক্তিবোধ, মানবতা, এবং ইতিহাসবোধকে সমন্বয় করে দাঁড়ানো—ঘৃণাকে নয়, ন্যায়কে হাতিয়ার বানিয়ে।