বৃহত্তর চট্টগ্রাম আমাদের সামনে মানবিকতার এক কঠিন পরীক্ষা হাজির করেছে। পরীক্ষাটি হচ্ছে সংখ্যালঘুর নির্যাতিত হওয়ার প্রেক্ষিতে বাঙালী হিসেবে আমাদের মধ্যে অনুভূত মানবিক মূল্যবোধের।
১ম পরীক্ষাঃ পার্বত্য চট্টগ্রামের জাতিগত ও একই সাথে ধর্মগত সংখ্যালঘু বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশের রাষ্ট্রিক ও অরাষ্ট্রিক নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হচ্ছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, বাঙালী জাতিরাষ্ট্রে যখন সংখ্যালঘু জাতিসত্তার ওপর নির্যতন ও নিপীড়ন হয়, তখন মানবিক বাঙালী হিসেবে আমাদের অবস্থান করণীয় কী?
২য় পরীক্ষাঃ বার্মার আরাকান তথা রাখাইন প্রদেশে ইসলাম ধর্মাবলম্বী ও রাজনৈতিকভাবে 'রোহিঙ্গা' আত্মপরিচয়দানকারী জনগোষ্ঠী সরকার কর্তৃক 'বাঙালী' হিসেবে চিহ্নিত ও নিপীড়ণ ও গণহত্যার শিকার হয়ে চট্টগ্রামে আশ্রয় নিচ্ছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, প্রতিবেশী রাষ্ট্র যখন তার নাগরিকদের ওপর 'বাঙালী' নাম দিয়ে নিপীড়ন ও গণহত্যা চালায়, তখন বিশ্বের একমাত্র বাঙালী জাতিরাষ্ট্রের বাসকারী মানবিক বাঙালী হিসেবে আমাদের অবস্থান ও করণীয় কী?
লক্ষ করছি, বাঙালী জাতির লোকেরা সম্পূর্ণ মানবিক অনুভূতি বিবর্জিত নয়। এমন নয় যে, মানুষ যখন নির্যাতন, নিপীড়ন,ধর্ষণ ও গণহত্যার শিকার হয়, বাঙালী তখন নির্বিকার থাকে। এটি ঠিক আছে।
কিন্তু যেটি ঠিক নয়, যেটি আমার ভালো লাগে না, আমাকে পীড়া দেয় এবং আমার স্বজাতি সম্পর্কে শ্রদ্ধায় প্রচণ্ড ধাক্কা দেয়, তা হচ্ছে তাদের মানবতারবোধের পক্ষাঘাতগ্রস্ততা। পক্ষাঘাতগ্রস্ততা মানে, আংশিক সংবেদনশীলতা।
আমি লক্ষ করি, যারা চট্টগ্রামে আশ্রয়প্রার্থী মুসলিম রোহিঙ্গাদের জন্যে বিশ্বের কাছে মানবিক আবদেন জানাচ্ছেন এই জনগোষ্ঠীর ওপর বর্মী সরকারী ও বেসরকারী নিপীড়িন লক্ষ করে, তারাই নীরব-নিশ্চুপ থাকছেন স্বদেশে জাতিগত ও ধর্মগত সংখ্যালঘু মানুষের ওপর চলমান সরকারী ও বেসরকারী নিপীড়ন লক্ষ করে।
আবার, যারা বাংলাদেশের জাতিগত-ধর্মগত সংখ্যালঘুর ওপর সরকারী ও বেসরকারী নিপীড়ন লক্ষ করে প্রতিবাদে আন্দোলিত হচ্ছেন, তারাই আবার 'বাঙালী' বলে চিহ্নিত মুসলিম-রোহিঙ্গাদের ওপর চলমান নিপীড়নের বিরুদ্ধে শুধু নিশ্চুপই নন, চট্টগ্রামে এসে তাদের আশ্রয় প্রার্থনাকে পর্যন্ত তারা সহ্য করতে পারছেন না।
আমার কষ্টের কারণ হলো, উপরে বর্ণিত দুই পরীক্ষার দু'টোতেই খুব অল্প সংখ্যক বাঙালীই পূর্ণ-মানবিকতা প্রদর্শন করতে পারছেন - অধিকাংশই পক্ষাঘাতগ্রস্ত মানবিকতা দেখাচ্ছেন। আর, দুর্ভাগ্যবশতঃ এই পক্ষাঘাতগ্রস্ততা ঘটছে ধর্মীয় লাইনে!
বাঙালীকে একটি সভ্য, সমৃদ্ধ ও আত্মশ্রদ্ধাশীল ও মর্য্যাদাপূর্ণ জাতি হিসেবে গড়ে উঠতে হলে এই পক্ষাগ্রস্ততা থেকে আরোগ্যলাভ করতে হবে। আর এই আরোগ্যলাভের প্রথম পথ্য হচ্ছে অবিভাজ্য বাঙালী আত্মপরিচয়বোধ!
৩১/০৮/২০১৭
লণ্ডন, ইংল্যাণ্ড
EmoticonEmoticon