সম্প্রতি প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপিল বিভাগ সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করেন। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে বিদ্যমান স্বৈরাচারী শাসন এবং একটি অগণতান্ত্রিক সংবিধানের দুর্বলতা ফুটে উঠেছে। একটি গণযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উৎপত্তি হলেও একটি বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক শাসন কাঠামো বা সংবিধান গড়ে উঠেনি। সংবিধানের চার মূলনীতি একটির সাথে অন্যটি সাংঘর্ষিক। যেমন জাতীয়তাবাদের সাথে সমাজতন্ত্রের বিরোধ আছে। আবার সংবিধানে সমাজতন্ত্র থাকলে গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ বা ধর্ম নিরপেক্ষতা আলাদাভাবে বলার দরকার নেই। আবার গণতন্ত্র থাকলে এর সাথে ধর্ম নিরপেক্ষতা, বা জাতীয়তাবাদের দরকার নেই। কারণ গণতন্ত্র মানেই সব ধর্মের মানুষকে সমান অধিকারের স্বীকৃতি দেয়। আবার যখন গণতন্ত্র থাকবে তখন একক বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ এর সাথে সাংঘর্ষিক। কারণ বাংলাদেশে বাঙ্গালীর বাইরে অনেকগুলো ছোট ছোট জাতির অস্তিত্ব আছে। ফলে এইসব জাতির সাংবিধানিক অস্তিত্ব অস্বীকার করে গণতান্ত্রিক সংবিধান হয় না।
আবার সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে প্রধানমন্ত্রীকে একক যে নির্বাহী ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, যে কেউ এই পদে অসীন হয়ে একনায়কতন্ত্রী রূপে হাজির হবে। কারণ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে যেই সরকার গঠন করবে সেই সরকারের প্রধানমন্ত্রী হবেন একক ক্ষমতার অধিকারী। সাংসদরা তাঁর আজ্ঞাবাহী। কেননা যদি কোন সাংসদ প্রধানমন্ত্রী বা দলের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন তাহলে তাঁর সাংসদ পদ বাতিল হয়ে যায়। আবার রাষ্ট্রপতির লাগাম ধরে রাখা। কারণ প্রধানমন্ত্রী চাইলে রাষ্ট্রপতিকে সাংসদের অংশগ্রহণে বরখাস্ত করতে পারেন। ফলে রাষ্ট্রপতি কিছু নির্দিষ্ট ফাইলে সই করা ছাড়া তেমন ক্ষমতা নাই। মাঝে মাঝে মেডিকেল চেক-আপের জন্য বিদেশ ভ্রমণ ছাড়া!
অন্যদিকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অন্যতম অঙ্গ হল স্বাধীন বিচার বিভাগ। কিন্তু বাংলাদেশের বিচার বিভাগকে সব সময় লাগাম ধরে রাখা হয়। এখন যে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল হল তার মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার যে ক্ষীণ আয়োজন ছিল তার অবশেষ রয়ে গেল। কারণ বিচারকদের নিয়োগ এবং বরখাস্ত করার ক্ষমতা যখন সংসদের কাছে যাবে তা কার্যত প্রধানমন্ত্রীর হাতে চলে যায়। ফলে একটি একনায়কতন্ত্রী ব্যবস্থার ষোলকলা পূর্ণ হয়। আবার বর্তমান যে সংসদ তাতো ভোট ছাড়াই নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে। ফলে এই সংসদের অধিকার নেই বিচার বিভাগের উপর হস্তক্ষেপ করার।
অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন। আমি সমাজতন্ত্রে আস্থাশীল হয়ে কেন বুর্জোয়া গণতন্ত্রের পক্ষে বলছি। বাস্তবতা হল আমি চাইলেই সমাজতন্ত্র কাল হয়ে যাবে না। কিন্তু গণতন্ত্র হলেও বাংলাদেশে যে অরাজক রাজনৈতিক পরিস্থিতি চলছে তা থেকে কিছুটা উত্তরণ পাওয়া যাবে। যে লুটপাট দুর্নীতি দলীয়করণ হয়েছে, তার বিপরীতে যদি গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন দাঁড়ায় তবে জনগণের পক্ষেই যাবে। গণতান্ত্রিক আয়োজনের মধ্য দিয়ে শ্রমিক শ্রেণী নিজেদের সংগঠিত হওয়ার সুযোগ পাবে। সেই যায়গা থেকে বর্তমান বাস্তবতায় একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান এবং ক্ষমতার ভারসাম্যমূলক শাসন কাঠামো দরকার। সেই প্রেক্ষিতে সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর একক ক্ষমতা হ্রাস করে রাষ্ট্রপতি, প্রধান বিচারপতি, প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করা সেই সাথে সাংসদদের দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে অবস্থান নেওয়ার সুযোগ, সকল জাতিসত্তার সাংবিধানিক স্বীকৃতি, রাষ্ট্রধর্ম বাতিল করা সহ সংবিধানের সকল অগণতান্ত্রিক ধারা বাতিল করা। অথবা সংসদের উপরে দশ সদস্য বিশিষ্ট সিনেট কমিঠি গড়ে তোলা যা সংসদে গৃহিত যে কোন আইন সিনেট কমিটি অনুমোদন দিলেই তা আইন আকারে আসবে। যদি এমন হয় তাহলে গণতন্ত্রের একটি ভারসাম্য হতে পারে। না হলে যে ধারার সংসদীয় ব্যবস্থার স্বৈরতন্ত্র দেখছি তা থেকে বের হওয়ার সুযোগ নেই। সেই কাজটি সংগঠিত জনগণকেই করতে হবে।
EmoticonEmoticon