মাকিন সাম্রাজ্যবাদ হলো বিশ্বব্যাপী মাকিন আধিপত্য, ভূরাজনৈতিক উচ্চকাঙ্খার বাস্তবায়ন, রাজ্য বিস্তারের লক্ষে দেশে দেশে সামরিক আগ্রাসন, প্রাকৃতিক সম্পদ লুন্ঠন, মানবতাধ্বংস, মানবাধিকার লংঘন ইত্যাদী সামগ্রিক তৎপরতাকে চালানোকে বুঝায়। আমেরিকান আদি অধিবাসী রেড ইন্ডিয়ানদের নিমূলের মাধ্যমে মাকিনীরা নিজের দেশে সাম্রাজ্যবাদ শুরু করেছিল বতমানে সারা পৃথিবীতে দেশে দেশে সামরিক আগ্রাসন, গণহত্যা আর মানবতাধ্বংসের মাধ্যমে তার বিশ্বজনীন চরিত্রের প্রকাশ ঘটিয়েছেন মাত্র। শুধু একটি নমুনা পেশ করলে বিষয়টি আরো পরিস্কার হবে। তা হলো মার্কিন সামরিক ইতিহাসবিদ উইলিয়াম ব্লামের গবেষণার একটি উদাহারণ এতে বুঝা যাবে মাকিন সাম্রাজ্যবাদের আসল চেহারা। তিনি তার গবেষনায় বলেন যে , ভূমিদখলের জন্য বিংশ শতাব্দীতে কেবল লাতিন আমেরিকাতেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় শতাধিক ছোটো-বড়ো ও প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সামরিক যুদ্ধ পরিচালিত হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র
নানা দিক দিয়েই যুক্তরাষ্ট্র এক অতি ব্যতিক্রমী ধরনের দেশ। এটাই হয়ত বিশ্বের একমাত্র দেশ যা একটা সাম্রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। জর্জ ওয়াশিংটনের ভাষায় ওটা ছিল শিশু সাম্রাজ্য এবং সেই সাম্রাজ্যের জনকদের বিশাল বিশাল আশা-আকাঙ্ৰা ছিল। এদের মধ্যে সবচেয়ে উদারপন্থী টমাস জেফারসন ভেবেছিলেন যে, এই শিশু সাম্রাজ্যের ছড়িয়ে পড়ে এমন এক ‘নীড়ে’ পরিণত হওয়া উচিত যেখান থেকে গোটা মহাদেশে উপনিবেশ স্থাপন করা যাবে। এতে লালদের অর্থাৎ ইন্ডিয়ানদের হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে কারণ তাদের তাড়িয়ে দেয়া বা নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হবে। কৃষ্ণাঙ্গদের যখন আর কোন প্রয়োজন শ্বেতাঙ্গদের হবে না তখন তাদের আফ্রিকায় ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হবে এবং লাতিনরা উন্নততর জাতের কাছে পরাজিত হবে।(নোয়াম চমস্কি)
মাকিন সাম্রাজ্যবাদের বিভিন্নরুপ
মাকিন সাম্রাজ্যবাদের বিভিন্ন রুপ রয়েছে।যা তার ঘৃনিত বৈশিষ্ট্যকে ফুটিয়ে তোলে।প্রখ্যাত লেখক আজফার হোসেন তার ‘মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সামপ্রতিক ব্যাকরণ’ প্রবন্ধে এ সম্পকে বিস্তারিত বণনা করেছেন। ২০০৩ সালে এক বিশাল যুদ্ধবিরোধী সমাবেশে ফিলিস্তিনি তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক সংগঠক জুবায়ের বিন তালেব সাম্রাজ্যবাদের বিভিন্ন বিশেষণের একটা ফর্দ পেশ করেন এভাবে : ‘নতুন সাম্রাজ্যবাদ,’ ‘নয়া সাম্রাজ্যবাদ,’ ‘নগ্ন সাম্রাজ্যবাদ,’ ‘সামরিক সাম্রাজ্যবাদ,’ ‘কর্পোরেট সাম্রাজ্যবাদ,’ ‘অগ্রসর সাম্রাজ্যবাদ’ এবং এমনকি ‘অতিপ্রাকৃত সাম্রাজ্যবাদ।’
এও বলা দরকার যে, ১১ই সেপ্টেম্বরের আগে একদল ‘উত্তর-বাদী’ (পোস্ট-অল্) তাত্ত্বিক, অর্থাৎ উত্তর-কাঠামোবাদী ও উত্তর-আধুনিকতাবাদী তাত্ত্বিক, সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসী চেহারাকে প্রচ্ছন্ন করার উদ্দেশ্যেই ‘উত্তর-সাম্রাজ্যবাদ’ বা ইংরেজিতে ‘পোস্ট-ইম্পিরিয়ালিজম’ বর্গটি চালু রেখেছিলেন। কিন্তু, না, শেষ পর্যন্ত ওই বর্গটি ধোপে টেকে নি, কেননা সামপ্রতিক সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেই নিজেকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করতে দ্বিধাবোধ করছে না মোটেই। মার্কিন মার্কসবাদী তাত্ত্বিক জন্ বেলামি ফস্টারের মতে ‘নগ্ন সাম্রাজ্যবাদ’-এর ধারণাটিই এখন সবচাইতে যুৎসই ধারণা হিসেবে উপস্থিত হয়েছে অনেকের কাছে। এ-বিষয়টি তলিয়ে দেখা বর্তমান রচনার একটি উদ্দেশ্য, যদিও একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু তার আগে জুবায়ের বিন তালেবের ওই ফর্দের তাৎপর্য নিয়ে কিছু বলা দরকার।
সাম্রাজ্যবাদকে বিভিন্ন বিশেষণে বিশেষিত করার ব্যাপারটি একাধিক ইঙ্গিতকেই সামনে আনে। প্রথমত, সাম্রাজ্যবাদের যুগ শেষ হয়ে যাওয়া তো দূরের কথা, বরঞ্চ সাম্রাজ্যবাদ আরো আগ্রাসী হয়ে তার উপস্থিতি সরবে ঘোষণা করছে এমনভাবে যে, খোদ মার্কিনীদের মধ্যেই যারা একসময় সাম্রাজ্যবাদকে সেকেলে রেটোরিক বলে উড়িয়ে দিত, এমনকি তারাও সাম্রাজ্যবাদকে ওই সাম্রাজ্যবাদ নামেই ডাকতে বাধ্য হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, ওই ফর্দ আরো নির্দেশ করে যে, সাম্রাজ্যবাদের চেহারা একটি নয়, একাধিক। অথবা বলা যায়, সাম্রাজ্যবাদ বিভিন্ন বেশে বিভিন্নভাবেই উপস্থিত হওয়ার ক্ষমতা অর্জন করেছে। বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন কায়দায় বিভিন্ন ধরনের অসম ক্ষমতা-সম্পর্ক তৈরী করে তাকে বিভিন্ন পরিসরে বিকীরিত করে চলেছে আজকের সাম্রাজ্যবাদ। এই সাম্রাজ্যবাদ একই সঙ্গে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক, সামরিক, সাংস্কৃতিক, মতাদর্শিক এবং পরিবেশগতও। সাম্রাজ্যবাদের বিভিন্ন কিন্তু পরষ্পর-সম্পর্কিত চেহারা ও চরিত্র নিয়ে আলোচনা করাও বর্তমান রচনার একটি উদ্দেশ্য।
সাম্রাজ্যবাদ বিভিন্ন বেশে ও চেহারায় বিভিন্ন পরিসরে বা পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় উপস্থিত, প্রভাবশালী ও আগ্রাসী হওয়ার অভূতপূর্ব মতা অর্জন করলেও সাম্রাজ্যবাদ নির্দিষ্ট নামে এবং নির্দিষ্ট জাতীয় পতাকা নিয়েই উপস্থিত হয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে, ইরাকে ও আফগানিস্তানে তো বটেই। এই সাম্রাজ্যবাদের নাম মার্কিন সাম্রাজ্যবাদই, কেননা কোথাও নিজের পতাকা লুকিয়ে ফেলার এখন কোনো ইচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেই। শুধু নিজের দেশের সুপারমার্কেটগুলোতে বিভিন্ন পণ্যের গায়েগায়েই যে মার্কিন পতাকা লেপ্টে থাকে তা নয়, এখন সারাপৃথিবীতেই তৈরী-করা তার প্রায় ৭০০টি সামরিক ঘাঁটিতে পতপত করে উড়ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা। ইউরোপসহ এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় তৈরী-করা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রায় ৭০০টি সামরিক ঘাঁটি কোনো অদৃশ্য, বায়বীয়, ভূতুড়ে জায়গা নয় মোটেই। সারা পৃথিবীকে একলা শাসন করবে বলেই এই ঘাঁটিগুলো তৈরী করা হয়েছে। নিঃসন্দেহে বিষয়টি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের এক অভূতপূর্ব সামরিকায়নকেই নির্দেশ করে বটে। এ-অবস্থায় সাম্রাজ্যবাদ এমনকি ঈশ্বরের মতো সব©ময় ক্ষমতার অধিকারী হতে চাইলেও চূড়ান্ত দৃষ্টান্তে সে বিভিন্ন ক্ষেত্রেরই দৃশ্যমান। শুধু দৃশ্যমানই নয়, সে কেন্দ্রীয় অবস্থানেই দৃশ্যমান বটে।
এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার জনগণের চলমান সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনগুলো থেকে উঠে-আসা যুক্তি ও তত্ত্বগুলো সরাসরিই বলে দেয় যে, আমরা এখন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সামপ্রতিকতম স্তরেই বাস করছি। বছর কয়েক আগে ক্যারিবীয় অঞ্চলে-বিশেষ করে গ্রানাডায়-একাধিক যুদ্ধবিরোধী সমাবেশে গ্রানাডার বিপ্লবী মরিস বিশপের ওই কথাটা নিঃশ্বাসের মতো অনিবার্য হয়ে বারবারই উচ্চারিত হয়েছে : ‘আমাদের সময়ের প্রধান ও প্রাথমিক সমস্যা হলো মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ।’ দুটো বিকল্প বৈশ্বিক মিডিয়া-‘ইন্ডি-মিডিয়া’ ও ‘জি-নেট’-গত কয়েক বছরে ইরাকের প্রায় শতাধিক ছোটো-বড়ো সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন ও তৎপরতার খবর আমাদেরকে দিয়েছে। ওইসব তৎপরতা বুড়ো আঙুল দেখিয়েই চিনে নিয়েছে সাম্রাজ্যবাদকে-যে-সাম্রাজ্যবাদের নাম মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ।
সেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘থিংক-ট্যাংকে’র আলোচনা এবং এমনকি কিছু সরকারি পলিসি-সংক্রান্ত আলোচনা সাম্রাজ্যবাদ কথাটাকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রেরই ব্যবহার করেছে নির্দ্বিধায়। অর্থাৎ ৱায়ুযুদ্ধ চলাকালীন পর্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেখানে ছদ্মবেশে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসেবেই হাজির থেকেছে, সেখানে আজ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ পরিত্যাগ করেছে তার সকল ছদ্মবেশ, এমনকি খুলে ফেলেছে তার সমস্ত বসন। জন বেলামি ফস্টার একেই বলেছেন ‘নগ্ন সাম্রাজ্যবাদ।’ তিনি তাঁর সমপ্রতি প্রকাশিত গ্রন্থ নেকেড ইম্পিরিয়ালিজম-এ অসংখ্য প্রমাণ হাজির করেছেন ওই নগ্ন সাম্রাজ্যবাদের ধারণাকে পরিষ্কার করার জন্যই।
জন বেলামি ফস্টারের নেকেড ইম্পিরিয়ালিজম প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাঠক মহলে তা বেশ সাড়া জাগায়। শুধু তাই নয়, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করে বইটি। বইটির মূল বক্তব্য সংক্ষেপে এভাবে পেশ করা যায় : যদিও ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বরের পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক তৎপরতা অনেকের কাছে ‘নতুন সামরিকবাদ’ ও ‘নতুন সাম্রাজ্যবাদ’-এর আকারে হাজির হয়েছে, আসলে সামরিকবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে মোটেই নতুন কোনো বিষয় নয়, কেননা তার জন্মলগ্ন থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভৌগোলিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবেই তার আধিপত্য বৈশ্বিক পরিসরে বিস্তৃত করতে চেয়েছে (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই সাম্রাজ্যবাদী আকাঙা ঊনিশ শতকে সাংস্কৃতিক বৈধতাও লাভ করে এমনি এক মাত্রায় যে, গণতান্ত্রিক, মহৎ, মানবতাবাদী কবি ব’লে বিশ্বখ্যাত ওয়ল্ট্ হুইটম্যানও তাঁর কিছু কিছু কবিতায় সে আকাঙা সরাসরি প্রকাশ করেন।) কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সামরিকবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ নতুন কোনো বিষয় না হলেও তাদের ইতিহাস কি কেবল স্থিরই থেকেছে? উত্তরে ফস্টার ‘না’ বলেছেন অবশ্যই। তবে, ফস্টারের মতে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের চেহারায় যে পরিবর্তন লক্ষণীয়, তা হচ্ছে তার নগ্ন বর্বরতা বা বর্বর নগ্নতার অভূতপূর্ব প্রকাশ, যে-নগ্নতার প্রমাণ বাস্তব পৃথিবীতে তো বটেই, এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘অফিসিয়াল রেটোরিক’-এ পাওয়া যায়। এখানে কয়েকটি প্রমাণ হাজির করা যাক।
২০০০ সাল। তখন রিচার্ড হাস্ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় প্রতিরক্ষা কাউন্সিলের একজন প্রভাবশালী সদস্য। শুধু তাই নয়, প্রথম বুশের একজন বিশেষ সহকারীও সে, যাকে পরবর্তী সময়ে নব্য-নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রতি জর্জ ডাব্লিউ বুশের স্বরাষ্ট্র বিভাগের নীতি প্রণয়ন ও পরিকল্পনার পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। সেই রিচার্ড হাস্ ২০০০ সালের ১১ই নভেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ‘পলিসি-পেপার’ পেশ করেন, যার শিরোনাম ‘ইম্পিরিয়াল আমেরিকা’। শিরোনাম নিজেই তাৎপর্যপূর্ণ বটে। নীতিমালা প্রণয়ন-সংক্রান্ত ওই রচনায় পরিষ্কারভাবে বলা হয় যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই ‘সনাতন জাতি-রাষ্ট্রের ভূমিকা পালনের পরিবর্তে সরাসরি সাম্রাজ্যের শক্তির চেহারা নিয়ে উপস্থিত হতে হবে, (নেকেড ইমপিরিয়ালিজম, পৃ ১৭)। ফস্টার নিজেই ওই রচনাকে এভাবে উদ্ধৃত করেন :
সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্র নীতির জন্য প্রয়োজন এমন এক নীতি যা কতোগুলো বিশেষ কৌশলে পৃথিবীর পুনর্বিন্যাসে সহায়তা করবে…এক্ষেত্রের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা হবে ঊনবিংশ শতাব্দীর গ্রেট ব্রিটেনের মতোই। (পৃ ১৭) ঊনবিংশ শতাব্দীর গ্রেট ব্রিটেনের মতো? হ্যাঁ, জোরেশোরেই সেই তুলনাটাকে সামনে এনেছেন রিচার্ড হাস্। দরকার হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ফিরে যাবে ধ্রুপদী উপনিবেশবাদের যুগেই; দরকার হলে সে জোর করেই দখল ও শাসন করবে অন্যের ভূমি। না, এখানে ছদ্মবেশ ধারণ করার কোনো অবকাশ নেই। হাসের বক্তব্য অনুসারে সাম্রাজ্যের কৌশল প্রয়োগই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এখন অনিবার্য মিশন। আমরা তো জানিই যে, ১১টি ভার্জিন আইল্যান্ডসহ পুর্তোরিকো এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি উপনিবেশ। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক ও আফগানিস্তান দখল এবং সে-সব অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি শারীরিক উপস্থিতি হার্ট-ও-নেগ্রি-কথিত অবয়বহীন ভূতুড়ে সাম্রাজ্যের উত্তর-আধুনিকতাবাদী ধারণাকে নিমেষেই অকেজো প্রমাণ করে এবং এমনকি যাকে মার্কসবাদী রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ ও ভূগোলবিদ ডেভিড হারভি তাঁর সমপ্রতি প্রকাশিত দ্য নিউ ইম্পিরিয়ালিজম গ্রন্থে সাম্রাজ্যবাদের ‘টেরিটোরিয়াল লজিক’ বলেছেন, তারই প্রাসঙ্গিকতাকে প্রমাণ করে।
ডেভিড হারভি’র দ্য নিউ ইম্পিরিয়ালিজম দু’টো পরস্পর-সম্পর্কিত সাম্রাজ্যবাদী ‘লজিক’-এর ধারণাকে সামনে আনে : একটি হচ্ছে ক্ষমতার পুঁজিবাদী রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ‘লজিক’ এবং অপরটি মতার ‘টেরিটোরিয়াল’ বা ভূগোল-ও-ভূমি-সংক্রান্ত লজিক। পরের লজিকের মোদ্দা কথাটা হচ্ছে এই : আজকের মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ কেবল অনানুষ্ঠানিক ও পুরো অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শাসনকে বা আধিপত্যকেই নির্দেশ করে না; পুঁজিবাদের বিকাশের ও পুঁজির সংবর্ধনের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক তাগিদেই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে সরাসরি ভূমিদখল, ভূমিদস্যুতা বা ভূমিলুণ্ঠন, যে-কাজটি করার জন্য মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ তার সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে এসেছে নিদেনপ সেই ঊনিশ শতক থেকেই। আজ সেই ভূমিদখল বা ভূমিলুণ্ঠন পেয়েছে আরো তীব্রতা। আসলে শুধু ধ্রুপদী উপনিবেশবাদের ক্ষেত্রেরই নয়, আজকের মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের চেহারা ও চরিত্র বোঝার জন্যই ভূমি-প্রশ্ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হিসেবে হাজির হয়।
‘ভূমিতেই সাম্রাজ্যবাদ সবচাইতে দৃশ্যমান ও নগ্ন হয়’-কথাটা একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল ক্যাস্ত্রো। ভূমি যে সাম্রাজ্যবাদের জন্য-বিশেষ করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের জন্য-ঐতিহাসিকভাবে কতটা জরুরী হয়ে উঠেছে, তা নিয়ে ক্যাস্ত্রোর একটি চমৎকার আলোচনা আছে তার সামপ্রতিক গ্রন্থ ওয়ার, রেইসিজম্ এ্যান্ড একোনমিক ইনজাস্টিস-এ। সেখানে ক্যাস্ত্রো আমাদের জানাচ্ছেন যে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ইতিহাস এবং তার ভূমিদখলের ও ভূমিদস্যুতার ইতিহাস কেবল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর কালেই সীমাবদ্ধ নয়। ক্যাস্ত্রোর মতে সেই ইতিহাসের জন্য আমাদেরকে যেতে হবে ঊনিশ শতকেই। তিনি তিনটি গরুত্বপূর্ণ সনের ওপর জোর দেন। এগুলো হচ্ছে ১৮২৩, ১৮৪৮ এবং ১৮৯৮। হ্যাঁ, ১৮২৩ সালে সরবে ঘোষিত হয় ‘মনরো ডকট্রিন।’ তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতির নামাঙ্কিত এই মতবাদ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ভূমিদস্যুতার একটি মতাদর্শিক ভিত্তি তৈরি করার তাগিদেই প্রচার করে যে, ইউরোপীয় উপনিবেশবাদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যই লাতিন আমেরিকাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হেফাজতে রাখা জরুরী। রাষ্ট্রপতি মনরো নিজেই একটি রূপক চালু করেন : ‘লাতিন আমেরিকা হচ্ছে আমাদের বাড়ীর পশ্চাদ্ভাগের উঠোন।’ কিন্তু মতবাদ ও রূপকের চেয়ে আরো সত্য ও বাস্তব হয়ে থাকে ইতিহাসে মূর্ত-হয়ে-ওঠা ঘটনা। ১৮৪৮ সালে মেঙিকোর অর্ধেকেরও বেশি ভূমি ছিনিয়ে নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার ভৌগোলিক সীমানা সমপ্রসারিত করে। এভাবে নিজের দেশেই পরবাসী হয়ে ওঠেন অসংখ্য মেঙিকান। এরপর ১৮৯৮ সালে উঠতি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ভূমিদখলের ও ভূমিদস্যুতার চেহারা আরো নগ্ন হয় : কিউবা, পুর্তো-রিকো, গুয়াম, হাওয়াই এবং ফিলিপাইনস্ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি উপনিবেশে রূপান্তরিত হয়। মার্কিন সামরিক ইতিহাসবিদ উইলিয়াম ব্লামের গবেষণা-মোতাবেক ভূমিদখলের জন্য বিংশ শতাব্দীতে কেবল লাতিন আমেরিকাতেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় শতাধিক ছোটো-বড়ো ও প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সামরিক যুদ্ধ পরিচালিত হয়।
এই ইতিহাস থেকে আজকের নগ্ন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অপতৎপরতাকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না মোটেই। এমনকি মার্কিন সরকারের ভাড়াটে বুদ্ধিজীবীসহ সরকার-প্রভাবিত বা নিয়ন্ত্রিত পত্রিকাগুলো ওই ইতিহাসকেই স্মরণে রেখে আজকের মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে সরাসরি মতাদর্শিক বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করেছে ইতিমধ্যেই। ফস্টার নিজেই নগ্ন সাম্রাজ্যবাদের ধারণাকে পরিষ্কার করার জন্য উদাহরণ জড়ো করেছেন একের পর এক। যেমন ধরা যাক, ‘কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশানস’-এর কথা এবং তার সিনিয়র ফেলো ম্যাকস্ বুটের একটি রচনার কথা। ২০০৩ সালে ৬ই মে ইউ.এস.এ টুডে নামের একটি প্রধান পত্রিকায় ম্যাকস্ বুট-এর যে প্রবন্ধটি ছাপা হয়, তার শিরোনামই চট করে বলে দেয় ওই প্রবন্ধের মূল কথাটাই। শিরোনামটি হচ্ছে ‘আমেরিক্যান ইম্পিরিয়ালিজম? : নো নীড টু রান ফ্রম দি লেবেল।’ ম্যাকস্ বুটের মতে সাম্রাজ্যবাদকে গালি হিসেবে বিবেচনা না ক’রে বরঞ্চ ঐতিহাসিকভাবে কার্যকর তাবৎ সাম্রাজ্যবাদী কলাকৌশল ও অনুশীলনকে যথাযথভাবে ব্যবহার করাই হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাজ। ওই ২০০৩ সালেই এ্যান্ড্রু বেইস্ভিচের সম্পাদনায় বের হয় একটি প্রবন্ধ-সংকলন, যার শিরোনাম দ্যা ইম্পিরিয়াল টেনস্। সেখানে দীপক লাল নামের আরেক ভাড়াটে বুদ্ধিজীবীর একটি প্রবন্ধ আছে। ওই প্রবন্ধটির শিরোনামই বলে দেয় লালের বক্তব্যটা কি। শিরোনামটি হচ্ছে ‘ইন ডিফেন্স অব এম্পায়ারস্।’ সেখানে লাল বলছেন : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাথমিক কাজ হবে মধ্যপ্রাচ্যে একটি নতুন ব্যবস্থা তৈরী করা। অনেকেই দোষারোপ করে বলেন যে, স্থিতাবস্থার এ-ধরনের পুনর্বিন্যাস সাম্রাজ্যবাদের কাজ হিসেবে বিবেচিত হবে, যা মধ্যপ্রাচ্যের তেল নিয়ন্ত্রণের আকাঙাকেই নির্দেশ করবে। কিন্তু আপত্তিকর হওয়া তো দূরের কথা, সাম্রাজ্যবাদই এখন জরুরী, ওই মধ্যপ্রাচ্যে একটি ব্যবস্থা নির্মাণের স্বার্থেই (নেকেড ইম্পিরিয়ালিজম-এ উদ্ধৃত, পৃ ৭) লক্ষণীয় যে, বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অনেক অঞ্চলেই যেখানে উদারনৈতিক বুদ্ধিজীবীরা বড়ো জোর আভাসে-ইঙ্গিতে ইনিয়ে-বিনিয়ে সাম্রাজ্যবাদের কথা বলেন, বা যেখানে তাঁরা সাম্রাজ্যবাদ শব্দটিই উচ্চারণ করতে নারাজ, সেখানে কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভাড়াটে বুদ্ধিজীবীদের আলোচনায় বা সরকারী আলোচনায় ‘সাম্রাজ্যবাদ’ বর্গটি কেবল স্পষ্টোচ্চারণেরই বিষয় থাকছে না, বরঞ্চ তা লাভ করেছে এক অভূতপূর্ব মতাদর্শিক বৈধতা। আবারও ওই ২০০৩ সালের ৫ জানুয়ারী নিউ ইয়র্ক টাইমস্ ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদেই মুদ্রিত হয়েছে এই পঙ্ক্তিটি-‘আমেরিকান এম্পায়ার : গেট ইউজড্ টু ইট।’ অর্থাৎ পত্রিকাটি ডাক দিচ্ছে আমাদেরকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদে অভ্যস্ত হওয়ার জন্য। আমাদের প্রাত্যহিক অনুশীলনে বা আমাদের জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতায়, অনুষঙ্গে, অনুপুঙে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ লাভ করুক প্রশ্নাতীত স্বাভাবিকতা, এই লক্ষেও তো কাজ করে চলেছে মার্কিন রাষ্ট্রসহ তার মতাদর্শিক ও দমনমূলক সব ‘এ্যাপারেটাস্’, বিশেষ ক’রে তার সামরিক বাহিনী, মিডিয়া ও ভাড়াটে বা তাঁবেদার বুদ্ধিজীবীদের দল, যাদের আবার জাতীয় সংস্করণ পাওয়া যাবে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায়। বাংলাদেশেও আছে ওইসব বুদ্ধিজীবী যাদের কিছুদিন আগেই দেখা গিয়েছে বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্যাট্রিসিয়া বিউটেনিসের বিদায়ী সম্বর্ধনায়। এটা বলাই যথেষ্ট নয়। আসলে গত ছত্রিশ বছরে বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, সেই সংস্কৃতিই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে সত্যিকার অর্থে শুধু প্রশ্নাতীত করেই রাখে নি, বরঞ্চ তার সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক লেনদেনের প্রায়-নিরবচ্ছিন্ন ইতিহাস তৈরী করে রেখেছে।
এও বলা দরকার যে, ১১ই সেপ্টেম্বরের আগে একদল ‘উত্তর-বাদী’ (পোস্ট-অল্) তাত্ত্বিক, অর্থাৎ উত্তর-কাঠামোবাদী ও উত্তর-আধুনিকতাবাদী তাত্ত্বিক, সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসী চেহারাকে প্রচ্ছন্ন করার উদ্দেশ্যেই ‘উত্তর-সাম্রাজ্যবাদ’ বা ইংরেজিতে ‘পোস্ট-ইম্পিরিয়ালিজম’ বর্গটি চালু রেখেছিলেন। কিন্তু, না, শেষ পর্যন্ত ওই বর্গটি ধোপে টেকে নি, কেননা সামপ্রতিক সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেই নিজেকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করতে দ্বিধাবোধ করছে না মোটেই। মার্কিন মার্কসবাদী তাত্ত্বিক জন্ বেলামি ফস্টারের মতে ‘নগ্ন সাম্রাজ্যবাদ’-এর ধারণাটিই এখন সবচাইতে যুৎসই ধারণা হিসেবে উপস্থিত হয়েছে অনেকের কাছে। এ-বিষয়টি তলিয়ে দেখা বর্তমান রচনার একটি উদ্দেশ্য, যদিও একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু তার আগে জুবায়ের বিন তালেবের ওই ফর্দের তাৎপর্য নিয়ে কিছু বলা দরকার।
সাম্রাজ্যবাদকে বিভিন্ন বিশেষণে বিশেষিত করার ব্যাপারটি একাধিক ইঙ্গিতকেই সামনে আনে। প্রথমত, সাম্রাজ্যবাদের যুগ শেষ হয়ে যাওয়া তো দূরের কথা, বরঞ্চ সাম্রাজ্যবাদ আরো আগ্রাসী হয়ে তার উপস্থিতি সরবে ঘোষণা করছে এমনভাবে যে, খোদ মার্কিনীদের মধ্যেই যারা একসময় সাম্রাজ্যবাদকে সেকেলে রেটোরিক বলে উড়িয়ে দিত, এমনকি তারাও সাম্রাজ্যবাদকে ওই সাম্রাজ্যবাদ নামেই ডাকতে বাধ্য হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, ওই ফর্দ আরো নির্দেশ করে যে, সাম্রাজ্যবাদের চেহারা একটি নয়, একাধিক। অথবা বলা যায়, সাম্রাজ্যবাদ বিভিন্ন বেশে বিভিন্নভাবেই উপস্থিত হওয়ার ক্ষমতা অর্জন করেছে। বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন কায়দায় বিভিন্ন ধরনের অসম ক্ষমতা-সম্পর্ক তৈরী করে তাকে বিভিন্ন পরিসরে বিকীরিত করে চলেছে আজকের সাম্রাজ্যবাদ। এই সাম্রাজ্যবাদ একই সঙ্গে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক, সামরিক, সাংস্কৃতিক, মতাদর্শিক এবং পরিবেশগতও। সাম্রাজ্যবাদের বিভিন্ন কিন্তু পরষ্পর-সম্পর্কিত চেহারা ও চরিত্র নিয়ে আলোচনা করাও বর্তমান রচনার একটি উদ্দেশ্য।
সাম্রাজ্যবাদ বিভিন্ন বেশে ও চেহারায় বিভিন্ন পরিসরে বা পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় উপস্থিত, প্রভাবশালী ও আগ্রাসী হওয়ার অভূতপূর্ব মতা অর্জন করলেও সাম্রাজ্যবাদ নির্দিষ্ট নামে এবং নির্দিষ্ট জাতীয় পতাকা নিয়েই উপস্থিত হয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে, ইরাকে ও আফগানিস্তানে তো বটেই। এই সাম্রাজ্যবাদের নাম মার্কিন সাম্রাজ্যবাদই, কেননা কোথাও নিজের পতাকা লুকিয়ে ফেলার এখন কোনো ইচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেই। শুধু নিজের দেশের সুপারমার্কেটগুলোতে বিভিন্ন পণ্যের গায়েগায়েই যে মার্কিন পতাকা লেপ্টে থাকে তা নয়, এখন সারাপৃথিবীতেই তৈরী-করা তার প্রায় ৭০০টি সামরিক ঘাঁটিতে পতপত করে উড়ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা। ইউরোপসহ এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় তৈরী-করা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রায় ৭০০টি সামরিক ঘাঁটি কোনো অদৃশ্য, বায়বীয়, ভূতুড়ে জায়গা নয় মোটেই। সারা পৃথিবীকে একলা শাসন করবে বলেই এই ঘাঁটিগুলো তৈরী করা হয়েছে। নিঃসন্দেহে বিষয়টি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের এক অভূতপূর্ব সামরিকায়নকেই নির্দেশ করে বটে। এ-অবস্থায় সাম্রাজ্যবাদ এমনকি ঈশ্বরের মতো সব©ময় ক্ষমতার অধিকারী হতে চাইলেও চূড়ান্ত দৃষ্টান্তে সে বিভিন্ন ক্ষেত্রেরই দৃশ্যমান। শুধু দৃশ্যমানই নয়, সে কেন্দ্রীয় অবস্থানেই দৃশ্যমান বটে।
এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার জনগণের চলমান সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনগুলো থেকে উঠে-আসা যুক্তি ও তত্ত্বগুলো সরাসরিই বলে দেয় যে, আমরা এখন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সামপ্রতিকতম স্তরেই বাস করছি। বছর কয়েক আগে ক্যারিবীয় অঞ্চলে-বিশেষ করে গ্রানাডায়-একাধিক যুদ্ধবিরোধী সমাবেশে গ্রানাডার বিপ্লবী মরিস বিশপের ওই কথাটা নিঃশ্বাসের মতো অনিবার্য হয়ে বারবারই উচ্চারিত হয়েছে : ‘আমাদের সময়ের প্রধান ও প্রাথমিক সমস্যা হলো মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ।’ দুটো বিকল্প বৈশ্বিক মিডিয়া-‘ইন্ডি-মিডিয়া’ ও ‘জি-নেট’-গত কয়েক বছরে ইরাকের প্রায় শতাধিক ছোটো-বড়ো সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন ও তৎপরতার খবর আমাদেরকে দিয়েছে। ওইসব তৎপরতা বুড়ো আঙুল দেখিয়েই চিনে নিয়েছে সাম্রাজ্যবাদকে-যে-সাম্রাজ্যবাদের নাম মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ।
সেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘থিংক-ট্যাংকে’র আলোচনা এবং এমনকি কিছু সরকারি পলিসি-সংক্রান্ত আলোচনা সাম্রাজ্যবাদ কথাটাকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রেরই ব্যবহার করেছে নির্দ্বিধায়। অর্থাৎ ৱায়ুযুদ্ধ চলাকালীন পর্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেখানে ছদ্মবেশে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসেবেই হাজির থেকেছে, সেখানে আজ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ পরিত্যাগ করেছে তার সকল ছদ্মবেশ, এমনকি খুলে ফেলেছে তার সমস্ত বসন। জন বেলামি ফস্টার একেই বলেছেন ‘নগ্ন সাম্রাজ্যবাদ।’ তিনি তাঁর সমপ্রতি প্রকাশিত গ্রন্থ নেকেড ইম্পিরিয়ালিজম-এ অসংখ্য প্রমাণ হাজির করেছেন ওই নগ্ন সাম্রাজ্যবাদের ধারণাকে পরিষ্কার করার জন্যই।
জন বেলামি ফস্টারের নেকেড ইম্পিরিয়ালিজম প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাঠক মহলে তা বেশ সাড়া জাগায়। শুধু তাই নয়, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করে বইটি। বইটির মূল বক্তব্য সংক্ষেপে এভাবে পেশ করা যায় : যদিও ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বরের পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক তৎপরতা অনেকের কাছে ‘নতুন সামরিকবাদ’ ও ‘নতুন সাম্রাজ্যবাদ’-এর আকারে হাজির হয়েছে, আসলে সামরিকবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে মোটেই নতুন কোনো বিষয় নয়, কেননা তার জন্মলগ্ন থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভৌগোলিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবেই তার আধিপত্য বৈশ্বিক পরিসরে বিস্তৃত করতে চেয়েছে (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই সাম্রাজ্যবাদী আকাঙা ঊনিশ শতকে সাংস্কৃতিক বৈধতাও লাভ করে এমনি এক মাত্রায় যে, গণতান্ত্রিক, মহৎ, মানবতাবাদী কবি ব’লে বিশ্বখ্যাত ওয়ল্ট্ হুইটম্যানও তাঁর কিছু কিছু কবিতায় সে আকাঙা সরাসরি প্রকাশ করেন।) কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সামরিকবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ নতুন কোনো বিষয় না হলেও তাদের ইতিহাস কি কেবল স্থিরই থেকেছে? উত্তরে ফস্টার ‘না’ বলেছেন অবশ্যই। তবে, ফস্টারের মতে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের চেহারায় যে পরিবর্তন লক্ষণীয়, তা হচ্ছে তার নগ্ন বর্বরতা বা বর্বর নগ্নতার অভূতপূর্ব প্রকাশ, যে-নগ্নতার প্রমাণ বাস্তব পৃথিবীতে তো বটেই, এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘অফিসিয়াল রেটোরিক’-এ পাওয়া যায়। এখানে কয়েকটি প্রমাণ হাজির করা যাক।
২০০০ সাল। তখন রিচার্ড হাস্ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় প্রতিরক্ষা কাউন্সিলের একজন প্রভাবশালী সদস্য। শুধু তাই নয়, প্রথম বুশের একজন বিশেষ সহকারীও সে, যাকে পরবর্তী সময়ে নব্য-নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রতি জর্জ ডাব্লিউ বুশের স্বরাষ্ট্র বিভাগের নীতি প্রণয়ন ও পরিকল্পনার পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। সেই রিচার্ড হাস্ ২০০০ সালের ১১ই নভেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ‘পলিসি-পেপার’ পেশ করেন, যার শিরোনাম ‘ইম্পিরিয়াল আমেরিকা’। শিরোনাম নিজেই তাৎপর্যপূর্ণ বটে। নীতিমালা প্রণয়ন-সংক্রান্ত ওই রচনায় পরিষ্কারভাবে বলা হয় যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই ‘সনাতন জাতি-রাষ্ট্রের ভূমিকা পালনের পরিবর্তে সরাসরি সাম্রাজ্যের শক্তির চেহারা নিয়ে উপস্থিত হতে হবে, (নেকেড ইমপিরিয়ালিজম, পৃ ১৭)। ফস্টার নিজেই ওই রচনাকে এভাবে উদ্ধৃত করেন :
সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্র নীতির জন্য প্রয়োজন এমন এক নীতি যা কতোগুলো বিশেষ কৌশলে পৃথিবীর পুনর্বিন্যাসে সহায়তা করবে…এক্ষেত্রের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা হবে ঊনবিংশ শতাব্দীর গ্রেট ব্রিটেনের মতোই। (পৃ ১৭) ঊনবিংশ শতাব্দীর গ্রেট ব্রিটেনের মতো? হ্যাঁ, জোরেশোরেই সেই তুলনাটাকে সামনে এনেছেন রিচার্ড হাস্। দরকার হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ফিরে যাবে ধ্রুপদী উপনিবেশবাদের যুগেই; দরকার হলে সে জোর করেই দখল ও শাসন করবে অন্যের ভূমি। না, এখানে ছদ্মবেশ ধারণ করার কোনো অবকাশ নেই। হাসের বক্তব্য অনুসারে সাম্রাজ্যের কৌশল প্রয়োগই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এখন অনিবার্য মিশন। আমরা তো জানিই যে, ১১টি ভার্জিন আইল্যান্ডসহ পুর্তোরিকো এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি উপনিবেশ। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক ও আফগানিস্তান দখল এবং সে-সব অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি শারীরিক উপস্থিতি হার্ট-ও-নেগ্রি-কথিত অবয়বহীন ভূতুড়ে সাম্রাজ্যের উত্তর-আধুনিকতাবাদী ধারণাকে নিমেষেই অকেজো প্রমাণ করে এবং এমনকি যাকে মার্কসবাদী রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ ও ভূগোলবিদ ডেভিড হারভি তাঁর সমপ্রতি প্রকাশিত দ্য নিউ ইম্পিরিয়ালিজম গ্রন্থে সাম্রাজ্যবাদের ‘টেরিটোরিয়াল লজিক’ বলেছেন, তারই প্রাসঙ্গিকতাকে প্রমাণ করে।
ডেভিড হারভি’র দ্য নিউ ইম্পিরিয়ালিজম দু’টো পরস্পর-সম্পর্কিত সাম্রাজ্যবাদী ‘লজিক’-এর ধারণাকে সামনে আনে : একটি হচ্ছে ক্ষমতার পুঁজিবাদী রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ‘লজিক’ এবং অপরটি মতার ‘টেরিটোরিয়াল’ বা ভূগোল-ও-ভূমি-সংক্রান্ত লজিক। পরের লজিকের মোদ্দা কথাটা হচ্ছে এই : আজকের মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ কেবল অনানুষ্ঠানিক ও পুরো অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শাসনকে বা আধিপত্যকেই নির্দেশ করে না; পুঁজিবাদের বিকাশের ও পুঁজির সংবর্ধনের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক তাগিদেই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে সরাসরি ভূমিদখল, ভূমিদস্যুতা বা ভূমিলুণ্ঠন, যে-কাজটি করার জন্য মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ তার সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে এসেছে নিদেনপ সেই ঊনিশ শতক থেকেই। আজ সেই ভূমিদখল বা ভূমিলুণ্ঠন পেয়েছে আরো তীব্রতা। আসলে শুধু ধ্রুপদী উপনিবেশবাদের ক্ষেত্রেরই নয়, আজকের মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের চেহারা ও চরিত্র বোঝার জন্যই ভূমি-প্রশ্ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হিসেবে হাজির হয়।
‘ভূমিতেই সাম্রাজ্যবাদ সবচাইতে দৃশ্যমান ও নগ্ন হয়’-কথাটা একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল ক্যাস্ত্রো। ভূমি যে সাম্রাজ্যবাদের জন্য-বিশেষ করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের জন্য-ঐতিহাসিকভাবে কতটা জরুরী হয়ে উঠেছে, তা নিয়ে ক্যাস্ত্রোর একটি চমৎকার আলোচনা আছে তার সামপ্রতিক গ্রন্থ ওয়ার, রেইসিজম্ এ্যান্ড একোনমিক ইনজাস্টিস-এ। সেখানে ক্যাস্ত্রো আমাদের জানাচ্ছেন যে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ইতিহাস এবং তার ভূমিদখলের ও ভূমিদস্যুতার ইতিহাস কেবল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর কালেই সীমাবদ্ধ নয়। ক্যাস্ত্রোর মতে সেই ইতিহাসের জন্য আমাদেরকে যেতে হবে ঊনিশ শতকেই। তিনি তিনটি গরুত্বপূর্ণ সনের ওপর জোর দেন। এগুলো হচ্ছে ১৮২৩, ১৮৪৮ এবং ১৮৯৮। হ্যাঁ, ১৮২৩ সালে সরবে ঘোষিত হয় ‘মনরো ডকট্রিন।’ তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতির নামাঙ্কিত এই মতবাদ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ভূমিদস্যুতার একটি মতাদর্শিক ভিত্তি তৈরি করার তাগিদেই প্রচার করে যে, ইউরোপীয় উপনিবেশবাদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যই লাতিন আমেরিকাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হেফাজতে রাখা জরুরী। রাষ্ট্রপতি মনরো নিজেই একটি রূপক চালু করেন : ‘লাতিন আমেরিকা হচ্ছে আমাদের বাড়ীর পশ্চাদ্ভাগের উঠোন।’ কিন্তু মতবাদ ও রূপকের চেয়ে আরো সত্য ও বাস্তব হয়ে থাকে ইতিহাসে মূর্ত-হয়ে-ওঠা ঘটনা। ১৮৪৮ সালে মেঙিকোর অর্ধেকেরও বেশি ভূমি ছিনিয়ে নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার ভৌগোলিক সীমানা সমপ্রসারিত করে। এভাবে নিজের দেশেই পরবাসী হয়ে ওঠেন অসংখ্য মেঙিকান। এরপর ১৮৯৮ সালে উঠতি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ভূমিদখলের ও ভূমিদস্যুতার চেহারা আরো নগ্ন হয় : কিউবা, পুর্তো-রিকো, গুয়াম, হাওয়াই এবং ফিলিপাইনস্ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি উপনিবেশে রূপান্তরিত হয়। মার্কিন সামরিক ইতিহাসবিদ উইলিয়াম ব্লামের গবেষণা-মোতাবেক ভূমিদখলের জন্য বিংশ শতাব্দীতে কেবল লাতিন আমেরিকাতেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় শতাধিক ছোটো-বড়ো ও প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সামরিক যুদ্ধ পরিচালিত হয়।
এই ইতিহাস থেকে আজকের নগ্ন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অপতৎপরতাকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না মোটেই। এমনকি মার্কিন সরকারের ভাড়াটে বুদ্ধিজীবীসহ সরকার-প্রভাবিত বা নিয়ন্ত্রিত পত্রিকাগুলো ওই ইতিহাসকেই স্মরণে রেখে আজকের মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে সরাসরি মতাদর্শিক বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করেছে ইতিমধ্যেই। ফস্টার নিজেই নগ্ন সাম্রাজ্যবাদের ধারণাকে পরিষ্কার করার জন্য উদাহরণ জড়ো করেছেন একের পর এক। যেমন ধরা যাক, ‘কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশানস’-এর কথা এবং তার সিনিয়র ফেলো ম্যাকস্ বুটের একটি রচনার কথা। ২০০৩ সালে ৬ই মে ইউ.এস.এ টুডে নামের একটি প্রধান পত্রিকায় ম্যাকস্ বুট-এর যে প্রবন্ধটি ছাপা হয়, তার শিরোনামই চট করে বলে দেয় ওই প্রবন্ধের মূল কথাটাই। শিরোনামটি হচ্ছে ‘আমেরিক্যান ইম্পিরিয়ালিজম? : নো নীড টু রান ফ্রম দি লেবেল।’ ম্যাকস্ বুটের মতে সাম্রাজ্যবাদকে গালি হিসেবে বিবেচনা না ক’রে বরঞ্চ ঐতিহাসিকভাবে কার্যকর তাবৎ সাম্রাজ্যবাদী কলাকৌশল ও অনুশীলনকে যথাযথভাবে ব্যবহার করাই হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাজ। ওই ২০০৩ সালেই এ্যান্ড্রু বেইস্ভিচের সম্পাদনায় বের হয় একটি প্রবন্ধ-সংকলন, যার শিরোনাম দ্যা ইম্পিরিয়াল টেনস্। সেখানে দীপক লাল নামের আরেক ভাড়াটে বুদ্ধিজীবীর একটি প্রবন্ধ আছে। ওই প্রবন্ধটির শিরোনামই বলে দেয় লালের বক্তব্যটা কি। শিরোনামটি হচ্ছে ‘ইন ডিফেন্স অব এম্পায়ারস্।’ সেখানে লাল বলছেন : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাথমিক কাজ হবে মধ্যপ্রাচ্যে একটি নতুন ব্যবস্থা তৈরী করা। অনেকেই দোষারোপ করে বলেন যে, স্থিতাবস্থার এ-ধরনের পুনর্বিন্যাস সাম্রাজ্যবাদের কাজ হিসেবে বিবেচিত হবে, যা মধ্যপ্রাচ্যের তেল নিয়ন্ত্রণের আকাঙাকেই নির্দেশ করবে। কিন্তু আপত্তিকর হওয়া তো দূরের কথা, সাম্রাজ্যবাদই এখন জরুরী, ওই মধ্যপ্রাচ্যে একটি ব্যবস্থা নির্মাণের স্বার্থেই (নেকেড ইম্পিরিয়ালিজম-এ উদ্ধৃত, পৃ ৭) লক্ষণীয় যে, বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অনেক অঞ্চলেই যেখানে উদারনৈতিক বুদ্ধিজীবীরা বড়ো জোর আভাসে-ইঙ্গিতে ইনিয়ে-বিনিয়ে সাম্রাজ্যবাদের কথা বলেন, বা যেখানে তাঁরা সাম্রাজ্যবাদ শব্দটিই উচ্চারণ করতে নারাজ, সেখানে কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভাড়াটে বুদ্ধিজীবীদের আলোচনায় বা সরকারী আলোচনায় ‘সাম্রাজ্যবাদ’ বর্গটি কেবল স্পষ্টোচ্চারণেরই বিষয় থাকছে না, বরঞ্চ তা লাভ করেছে এক অভূতপূর্ব মতাদর্শিক বৈধতা। আবারও ওই ২০০৩ সালের ৫ জানুয়ারী নিউ ইয়র্ক টাইমস্ ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদেই মুদ্রিত হয়েছে এই পঙ্ক্তিটি-‘আমেরিকান এম্পায়ার : গেট ইউজড্ টু ইট।’ অর্থাৎ পত্রিকাটি ডাক দিচ্ছে আমাদেরকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদে অভ্যস্ত হওয়ার জন্য। আমাদের প্রাত্যহিক অনুশীলনে বা আমাদের জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতায়, অনুষঙ্গে, অনুপুঙে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ লাভ করুক প্রশ্নাতীত স্বাভাবিকতা, এই লক্ষেও তো কাজ করে চলেছে মার্কিন রাষ্ট্রসহ তার মতাদর্শিক ও দমনমূলক সব ‘এ্যাপারেটাস্’, বিশেষ ক’রে তার সামরিক বাহিনী, মিডিয়া ও ভাড়াটে বা তাঁবেদার বুদ্ধিজীবীদের দল, যাদের আবার জাতীয় সংস্করণ পাওয়া যাবে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায়। বাংলাদেশেও আছে ওইসব বুদ্ধিজীবী যাদের কিছুদিন আগেই দেখা গিয়েছে বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্যাট্রিসিয়া বিউটেনিসের বিদায়ী সম্বর্ধনায়। এটা বলাই যথেষ্ট নয়। আসলে গত ছত্রিশ বছরে বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, সেই সংস্কৃতিই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে সত্যিকার অর্থে শুধু প্রশ্নাতীত করেই রাখে নি, বরঞ্চ তার সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক লেনদেনের প্রায়-নিরবচ্ছিন্ন ইতিহাস তৈরী করে রেখেছে।
EmoticonEmoticon