মঙ্গলবার, ৮ আগস্ট, ২০১৭

যে সূর্য আলো দেখে নিঃ

বয়স আমার ৭ মাস।আর মাত্র কয়েক মাস পরেই আমার ছুটি। হুর..রে..! তখন আর আমাকে পাই কে? মা'কে বলেছিলাম- আমি যখন তোমার কোলে আসবো,কি করবে তুমি? কেমন লাগবে তোমার?
মা বললো- "তুই এলে আমি সারারাত ঐ আকাশের তারার আলোয় তোকে দেখবো,গান শোনাবো,তুই যখন কাদঁবি - তখন দোল দিবো।আয় সোনা! তুই আয়... আমি যে তোর অপেক্ষায়।''

মা আমার দারুণ ব্যস্ত। সারাদিন ছুটোছুটি,এদিক ওদিক যায়। তাই রাত ছাড়া তার কথা বলার সময়ই যেন হয় না। আমিও সারাদিন একা একাই থাকি।জানি আমাকে নিয়ে মা'র অনেক কষ্ট হয়।আর বাবা? তাকে তো এখনো দেখিই নি।তবে শুনেছি সে নাকি অনেক বড় নেতা! মিছিল- মিটিং, আলোচনা, বক্তৃতা এসব করে।মা'কেও সময় দিতে পারে না।
সে থাক! পরে দেখা যাবে। আর তো ক'টা দিন।মা'র সাথে আমার কত কথা যে জমে আছে!!
মা একদিন বললো- বড় হয়ে তোকেও অনেক কাজ করতে হবে।দেশের কথা ভাবতে হবে,পড়ালেখা জানতে হবে।
মা'কে জিজ্ঞেস করলাম- পড়ালেখা কি?
মা বললো- পড়ালেখা হচ্ছে, ঐ সূর্যের মতো।আলো ছড়ায়, সেটা না থাকলে যেমন কোনকিছু দেখা যায় না তেমনি পড়ালেখা না জানলে মানুষকে জানা যায় না,ভালোবাসা যায় না, সমাজকে পাল্টানো যায় না।
মা'কে বললাম - মা! আমি সূর্য হবো।
আমার কথা শুনে মা হেসে বললো- "ওরে আমার লক্ষীসোনা, চাদেঁর কণা! আয়, আমি যে তোর অপেক্ষায়..."

"চাঁদ কি মা?" আমার কথার উত্তর দিতে দিতে মা যেন আরো ক্লান্ত হয়ে পড়ে।তবু সে আমার গায়ে হাত বুলোতে বুলোতে বলে- "এই যে তুই বাঁকা হয়ে,গোল হয়ে আমার শরীরে লেপ্টে আছিস, চাঁদ হচ্ছে তোর মতন- অন্ধকারে পথ দেখায়, আকাশের গায়ে লেপ্টে থাকে।
মা'কে বললাম- মা! আমি আকাশ হবো। পুরো দুনিয়াকে জড়িয়ে রাখবো।
মা বললো- "ওরে আমার ময়নাপাখি, আয়, আমি যে তোর অপেক্ষায়..."

আমি আবারো বললাম-"পাখি কি মা?" মা বললো- "আহ আর বকবক করিস না তো! এলেই সব দেখবি!"
আমার মন খারাপ হয়েছে বুঝতে পেরে আদর করে বলে- " পাখি হচ্ছে তোর মতন যার দুটো হাতের মতো ডানা আছে- সে ঐ আকাশে উড়ে বেড়ায়।সন্ধ্যে হলে চাঁদের আলোয় গান শোনায়..
আমি বললাম- " মা আমি পাখি হবো।তোমায় নিয়ে উড়ে বেড়াবো, তোমায় গান শোনাবো।
মা বললো- আয়, তুই আয়! আমি তোর অপেক্ষায়... বলতে বলতে মা ঘুমিয়ে পড়ে।

কয়েকদিন ধরে মা'র সাথে কথা হচ্ছে না। আর মাত্র ক'টা দিন বাকি।তাকে কিছু জিজ্ঞেস করলে- হু হা, বলে এড়িয়ে যায়।বুঝলাম নিশ্চয় তার কোন সমস্যা হয়েছে।হঠাৎ একদিন শুনলাম কার সাথে জানি মা'র খুব তর্ক হচ্ছে। বিভিন্ন শব্দ শুনলামঃ আদর্শ, উন্নত সংস্কৃতি, সংগ্রাম, মিছিল, মিটিং, সংশোধনবাদ, ব্যক্তিবাদ...আরো কত কি! একটু পর মায়ের কান্না! সাইরেনের আওয়াজ! বুঝলাম কোন একটা গন্ডগোল হচ্ছে।

হাসপাতালে আমি আর মা শুয়ে আছি। ফিসফিসিয়ে তার সাথে কথা বলতে লাগলাম- মা! ও মা! কিন্তু সে যেন কোনকিছু শুনছে না। একটু পর নার্স কি যেন দিয়ে গেলো...
একি! কি হচ্ছে এসব! আমার পুরো শরীর যেন জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে! ভয়ে মা'কে জড়িয়ে ধরতে চাইলাম-কিন্তু সে আমাকে এক ঝটকায় সরিয়ে দিলো।আমি চিৎকার করে বললাম- মা আমাকে কি করছো? আমাকে তোমার কাছে আসতে দাও মা! সে বললো- না তোকে আসতে হবে না!
আমি বললাম- কেন মা? তুমি না বলেছিলে তুৃমি আমার অপেক্ষায় আছো? চেচিঁয়ে উঠে সে বললো- না, আমার অনেক কাজ বাকি আছে। তোকে আমি নিতে পারবো না। তোর বাবাকে আরো অনেক বড় নেতা হতে হবে।তার অনেক দায়িত্ব!
'' তাহলে আমার কি হবে? আমি তো কোন দোষ করি নি? তোমরা চেয়েছিলে বলেই না আমি এসেছিলাম।"- কান্নায় আমার গলা ধরে এলো।
মা বললো- আমাকে তুই ক্ষমা করে দিস,বাচা!
আমি বলতে গেলাম- মা! আমি তোমার সূর্য হতে চেয়েছিলাম! আমি এই পৃথিবীর আকাশ হতে চেয়েছিলাম! আমি আকাশে ডানা মেলে উড়তে চেয়েছিলাম! আমি তোমার মতন একজন মানুষ হতে...
কিন্তু পারলাম না!
সূর্য ডুবে সব অন্ধকার হয়ে এলো।


EmoticonEmoticon