বাঙালী মুসলমানেরা ভারত বিভাগ চেয়েছে ঠিক, কিন্তু বাংলার বিভাগ চায়নি; চাওয়ার কোনো কারণ ছিলো না। ১৯৪৭ সালে অখণ্ড স্বাধীন বাংলা না হওয়ার পেছেনে হিন্দুদের মধ্যে কাজ করেছে সরকারে ও প্রশাসনে দীর্ঘ প্রতিষ্ঠিত হিন্দু আধিপত্য হারানোর ভীতি।
ব্রিটিশ ভারতে ১৯৩৭ সালে প্রাদেশিক নির্বাচিত সরকার ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত বাংলার চীফ মিনিষ্টারগণ - ফজলুল হক, খাজা নাজিমুদ্দিন ও শহীদ সহোরাওয়ার্দি - সকলেই মুসলিম ছিলেন। এটি হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে এই বার্তা দিয়েছিলো যে, অখণ্ড বাংলা স্বাধীন হলে, ব্রিটিশ আমলে পিছিয়ে পড়া মুসলমানগণ প্রাক-ব্রিটিশ আমলের মতো আবার নিরঙ্কুশ রাষ্ট্রীয় আধিপত্যে চলে আসবে, যেটি ছিলো বঙ্কিমচন্দ্রীয় বাঙালী জাতীয়তাবাদ তথা হিন্দু-পুনরুজ্জীবনিক বাঙালী জাতীয়তাবাদের সাথে সাংঘর্ষিক।
যে-গণতন্ত্র দীর্ঘ প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রিক ও প্রশাসনিক আধিপত্য নিশ্চিত ধ্বংস করবে বলে প্রত্যক্ষিত হয়েছিলো, সে-গণতন্ত্র সারা বাংলায় সামগ্রিকভাবে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিলো না; এর চেয়ে শ্রেয় ছিলো বাংলা ভাগ করা, যা প্রতিষ্ঠিত আধিপত্যের নিশ্চায়ক ছিলো।
১৯৪৭ সালে বাংলার বিভক্তি রোখার শেষ চেষ্টা হিসেবে, শরৎ বসু ও আব্দুল হাশিমের মতো বাঙালী নেতারা অবিভক্ত স্বাধীন বাংলার প্রস্তাব করেছিলেন এবং সেখানে মসুলমি প্রধানমন্ত্রী ও হিন্দু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী রাখার সাংবিধানি বিধির নিশ্চিয়তা ছিলো। আমার ধারণা, এটি হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে আকর্ষণীয় প্রস্তাব ছিলো না।
আমি মনে করি, তখনকার বাঙালী জাতীয়তাদীদের উচিত ছিলো একটা হিন্দু-মুসলিম ভারসাম্য নিশ্চায়ক সংবিধান প্রস্তাব করা। তাদের প্রস্তাব করা উচিত ছিলো 'রিপাবলিক অফ বেঙ্গল' নামের রাষ্ট্রে মুসলিম রাষ্ট্র-প্রধান ও হিন্দু সরকার-প্রধান থাকবে। আমার ধারণা, এ-প্রস্তাব অধিক গ্রহণযোগ্য হতো।
ভবিষ্যতে যদি বাঙালী জাতির অখণ্ড বাংলায় অভিন্ন জাতিরাষ্ট্র 'রিপাবলিক অফ বেঙ্গল' প্রতিষ্ঠা করতে হয়, সেখানে একটি ঐতিহাসিক কাল (২৫, ৫০ বা ১০০ বছর) পর্যন্ত মুসলিম ব্যাকগ্রাউণ্ডের রাষ্ট্র-প্রধান, হিন্দু ব্যাকগ্রাউণ্ডের সরকার-প্রধান এবং এই দুই ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বাইরে একজন স্পীকার সাংবিধানিকভাবে নিশ্চিত করতে হবে। লেবাননে অনেকটা এরকম ব্যবস্থা আছে।
বিকল্প হিসেবে, এই পদ তিনটিতে সম্প্রদায়গত রোটেশন ব্যবস্থাও রাখা যেতে পারে। অর্থাৎ, প্রথম রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হবে এবং সেখানে যে ধর্মীয় ব্যাকগ্রাউণ্ডের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবেন, পার্লামেণ্টারী নির্বাচনের পর প্রধানমন্ত্রী হবেন অন্য সম্প্রদায়ের। আর, স্পীকার হবেন এই দুয়ের বাইরে তৃতীয় কোনো ব্যাকগ্রাউণ্ডের।
০৭/০৯/২০১৭
লণ্ডন, ইংল্যাণ্ড
EmoticonEmoticon