ইউরোপে জাতীয়তাবাদী বুর্জোয়া বিপ্লবের যুগ শেষ হয়েছে অষ্টাদশ এবং উনবিংশ শতাব্দীতে। বিংশ শতাব্দী ছিল ইউরোপের জন্য সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের যুগ। ১৮৪৮ সালে কমিউনিস্ট ইস্তেহার প্রকাশের মধ্য দিয়ে ইউরোপ তথা গোটা বিশ্বে বিপ্লবী রাজনীতির নতুন অধ্যায় সূচিত হয়। যার হাত দিয়ে প্যারি কমিউন এর জন্ম হয়। যদিও ৭২ দিন স্থায়ী হলেও প্যারি কমিউন বিশ্বকে জানান দেয় শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে রাষ্ট্র পরিচালনা সম্ভব যেখানে শোষণের চাকাকে রধ করিয়ে দেওয়া যায়। তারপর মার্ক্স এঙ্গেলস এর মৃত্যুর পর ইউরোপে বিপ্লবী রাজনীতি কমরেড লেনিনের নেতৃত্বে নতুন মোড় নেয়। রুশ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে নতুন সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার হাতছানি দেয় রুশ বিপ্লব। যদিও পশ্চাদপদ একটি পুঁজিবাদী দেশ রুশ সাম্রাজ্যে সরাসরি সমাজতন্ত্র গড়ে তোলা কঠিন ছিল। ফলে সমাজতন্ত্রের পূর্ণাঙ্গ আয়োজন না থাকলেও একটি সফলতা ছিল বলা যায়। ভুল ত্রুটি সীমাবদ্ধতা সত্বেও এটিই দুনিয়ার বুকে প্যারি কমিউনের পর সফল শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে একটি ব্যবস্থা। যদিও পার্টি আমলাতন্ত্র, ব্যক্তিবাদ এগুলো চরমভাবে সেখানে উপস্থিত ছিল তারপরও প্রথম ব্যবহারিক ব্যবস্থা হিসেবে এর সফলতা কম নয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের সহযোগীতায় এবং কমরেড মাও সে তুং এর নেতৃত্বে গণচীনে সফল বিপ্লবের মধ্য দিয়ে চীনে সমাজতন্ত্রে পথচলা শুরু হয়েছিল। কিন্তু পশ্চাদপদ একটি কৃষি প্রধান দেশে সমাজতন্ত্র নির্মাণ করতে হলে একটি অন্তঃবর্তীকালীন ধাপ সেখানে অতিবাহিত করতে হয়েছে। ফলে পুঁজিবাদী শিল্পায়ন সেখানে রাষ্ট্রীয় উদ্দ্যোগে শুরু হয়েছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত ক্ষমতা আর শ্রমিক শ্রেণীর হাতে না থেকে পার্টির অভ্যন্তরে বুর্জোয়া অংশের হাতে ক্ষমতা চলে যায়। ফলে চীন বাজার অর্থনীতির পথে হাঁটতে শুরু করে। যার ফলে আজকের চীন একটি সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদী দেশ। আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পূর্ব ইউরোপ এবং পূর্ব জার্মানিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ধাচের সমাজতন্ত্র শুরু হয়েছিল। যদিও এর সফল পরিসমাপ্তি হয়নি। সমাজতান্ত্রিক শিবিরে নানা দ্বন্দ্ব ভুল ভ্রান্তির ফলে সমাজতন্ত্র উল্টোপথে হাঁটা শুরু করে। যার পরিণতি এর পতন ঘটে। সাথে সাথে ইউরোপে বিপ্লবী রাজনীতি মার খেতে থাকে। নানা ভ্রান্তি সুবিধাবাদ এর মধ্য দিয়ে বিপ্লবী রাজনীতি পথ হারায়। অন্যদিকে ইউরোপীয় বুর্জোয়া শ্রেণী শ্রমিক অভ্যুত্থানের ভয়ে অনেকটা সামাজিক সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করে। যার হাত ধরে ইউরপের বিভিন্ন দেশে স্যোসাল ড্রেমক্রেসি ব্যবস্থার জন্ম হয়। ফলে সাময়িক কালের জন্য সেখানে শ্রমিক বিপ্লব, শ্রমিক অভ্যুত্থান পথ হারায়।
২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দার কবলে পড়ে ইউরোপের শিল্পোন্নত পুঁজিবাদী অর্থনীতর ধ্বস নামতে থাকে। যার রেশ ইউরোপের কয়েকটি দেশে মারাত্মক সংকটের মুখে পড়ে। ফলে গ্রীস ইতালি স্পেন পর্তুগাল ঋণের ঝালে আটকা পড়ে যায়। এই সংকট থেকে উত্তোরণের জন্য ইউরোপের বুর্জোয়ারা সফল কোন পথ বাহির করতে পারেনি। আবার সেখানে শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লবী রাজনীতি অনুপস্থিতির কারণে কোন দেশেই শ্রেণী সংগ্রাম গড়ে উঠেনি। কিন্তু এই সংকট থেকে নতুন করে চরম জাতীয়তাবাদী ডানপন্থী রাজনীতির বিকাশ ঘটেছে। স্পেনের কাতালানদের স্বাধীনতার আন্দোলন হল এই ডানপন্থী রাজনীতি বিকাশের ফল। এটি কোনভাবেই একটি প্রগতিশীল আন্দোলন নয়। কাতালান হল স্পেনের সবচেয়ে শিপ্লোন্নত এলাকা যার রাজধানী বার্সেলোনা। এই বার্সেলোনা একটি পর্যটন নগরী ও। এটি স্পেনের একটি সায়ত্বশাসিত অঞ্চল। সেখানে এখন আঞ্চলিক ক্ষমতায় আছে একটি ডানপন্থী আঞ্চলিক দল যারা বর্তমানে স্পেন থেকে আলাদা হওয়ার দাবি জানাচ্ছে। এই আলাদা হওয়ার কারণ হল স্পেনের অর্থনৈতিক সংকটের কারণে বেকারত্বের যে ঢেউ লেগেছে সেখান থেকে কাতালান মুক্ত নয়। ফলে সম্পদশালী কাতালানরা মনে করে স্পেন থেকে আলাদা হলে তারা এককভাবে এইসব ভোগ করবে যা বর্তমানে সারাদেশে ভাগ হয়ে যায়। এটা একটি সংকীর্ণবাদী চিন্তা যে আমরা আমাদেরটা ভোগ করবো অন্যদের ভোগ করতে দিব না। ফলে সেখানকার ডানপন্থী বুর্জোয়া এবং পেটিবুর্জোয়া শ্রেণী চায় স্পেন থেকে আলাদা হতে। কিন্তু বার্সেলোনায় কাজ করে স্পেনের অন্যান্য এলাকার শ্রমিকরা। যা কাতালান ভাগ হলে তাঁদের একটা সংকটে পড়তে হবে। আবার বৃহত্তর স্পেনে যেভাবে শ্রমিক শ্রেণী ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সুযোগ পাবে কাতালান ভাগ হলে শ্রমিকদের মধ্যে ঐক্যের ক্ষতি হবে। আবার কাতালান ভাগ হলে কাতালান বুর্জোয়াদের দ্বারা কাতালান শ্রমিকরা শোষণের স্বীকার হবে। ফলে বিশ্ব মানচিত্রে নতুন একটি বুর্জোয়া রাষ্ট্রের উৎপত্তি ছাড়া কাতালান স্বাধীন হলে নতুন করে কিছুই হচ্ছে না।
আবার তাতেও মস্ত বাঁধা আছে। যে গণভোট হয়েছে যা আইনকে পাশ কাটিয়ে কাতালান সরকারের নিজস্ব উদ্দ্যোগে হয়েছে যা স্পেনের কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমতি ছিল না, ছিল হাইকোর্টের বিধিনিষেধ। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং জাতিসংঘের অনুমোদন ছিল না। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এটি দমনপীড়ন এর স্বীকার হয়েছে। আবার একটি বৈধ্য গণভোট হতে হলে স্পেনের সংবিধান সংশোধন করতে হবে। যা করতে পার্লামেন্টে দুই তৃতীয়াংশ ভোট লাগবে। আবার দমন পীড়ন এর সংকটে পড়ে কাতালানদের স্বাধীনতার আন্দোলন দীর্ঘস্থায়ী হবে। আবার ইউরোপীয় ইউনিয়ন এর অনুমোদনহীন হলে একলা চলা কাতালানদের জন্য কঠিন হবে। ফলে কাতালান স্বাধীনতার আন্দোলন দীর্ঘস্থায়ী সংকটে পড়া ছাড়া নতুন কিছু দেখছি না।
কিছুদিন আগে ব্রিটেন থেকে স্কটিশদের বের হয়ে যাওয়ার গণভোট হয়েছিল। কিন্তু না ভোটের কারণে স্কটিশরা স্বাধীন হতে পারেনি। কিন্তু এই যে ডানপন্থী জাতীয়তাবাদের উত্থান ইউরোপে কোনভাবেই একটি প্রগতিশীল আন্দোলন নয় বরং শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লবী রাজনীতির অনুপস্থিতির প্রতিক্রিয়া হিসেবে এইসব ডানপন্তার বিকাশ হচ্ছে যা বাস্তবে একটি প্রতিক্রিয়াশীল আন্দোলন।
অনেকেই লেনিনের জাতির আত্মনিয়ন্ত্রের অধিকারের লেখাকে ভুলভাবে উপস্থাপন করে যে কোন জাতির ভাগ হওয়াকে যৌক্তিক মনে করছেন। কিন্তু লেনিনের এই বক্তব্য কোন সময় কোন বাস্থবতায় প্রদান কিরেছিলেন ভুলে যান। লেনিন যখন জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রবন্ধ লেখেন তখন দুনিয়ার দুই তৃতীয়াংশ এলাকা উপনিবেশ ছিল। ফলে মূল বক্তব্য ছিল এইসব উপনিবেশ থেকে যেন জাতিগুলো আলাদা হতে পারে। যা কোনভাবেই একই দেশের মধ্যে একাধিক জাতির ভাগ ভাটোরা বুঝায় না। ফলে লেনিনের এই বক্তব্যকে অনেকে ভুলভাবে উপস্থাপন করছেন।
EmoticonEmoticon