মৃত মানুষের প্রতি জীবিতদের কীরূপ শব্দাচারণ হওয়া উচিত, তা নিয়ে একটি বিতর্ক লক্ষ করছি বিভক্ত ঢাকার একাংশের মেয়র আনিসুল হকের মৃত্যুর পর। উল্লেখ্য, তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে মেয়র হয়েছিলেন।
তো, বরাবরের মতোই আওয়ামী লীগের প্রতি সহানুভূতিশীলেরা ঠিক এই মুহূর্তে বলছেন, মৃতব্যক্তির নামে নেতিবাচক কিছু বলা উচিত নয় এবং আওয়ামী-বিরোধীরা বলছেন, জীবত অবস্থায় ব্যক্তি যে অপকর্ম করে, মরে গেলে সে প্রশংসাযোগ্য হতে পারে না।
যুদ্ধাপরাধে সাজাপ্রাপ্ত গোলাম আযমের মৃত্যুর পর তার মরদেহের প্রতি এক ব্যক্তির জুতো নিক্ষেপ, অন্যদের থুথু নিক্ষেপ-সহ নানা রকম ঘৃণাপ্রকাশক আচরণ প্রকাশিত হতে দেখেছি। বিষয়টি অনেকেরই হয়তো মনে থেকে থাকবে।
গোলাম আযমকে আমি ১৯৭১ সালে বাঙালী জাতির বিরুদ্ধে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের জন্যে দায়ী করি এবং প্রত্যাখ্যান করি। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি তার মরদেহের প্রতি জুতোনিক্ষেপ সমর্থন করিনি। কারণ, মরদেহের প্রতি জুতোনিক্ষেপের মধ্য দিয়ে যে-সংস্কৃতির প্রকাশ ঘটে, আমি শতোভাগ সেক্যুলার বাঙালী হিসেবে আমার জাতির জন্যে সে-সংস্কৃতি চাই না।
তাই, জুতোনিক্ষেপের সমালোচনা করে একটি লেখা লিখেছিলাম, যা তখন 'প্রগতিশীল' ব্যক্তিদের কাছে খুবই না-পসন্দ হয়েছিলো। শুধু তাই নয়, সেজন্যে আমাকে প্রচুর গালাগাল শুনতেও হয়েছিলো।
আমার হায়ারার্কি অফ রুলস গভার্নিং হিউম্যান বিহেইভিয়ার (পিরামিড রুলস) তত্ত্বে আমি এই মর্মে সূত্রায়ন করেছি যে, মানুষের সাংস্কৃতি তার আদর্শের চেয়ে শক্তিশালী। তাই, কমিউনিষ্ট ও ইসলামিষ্ট কিংবা আওয়ামী ও বিএনপি নির্বিশেষে সবার সংস্কৃতির মধ্যে একটা কমোনালিটি বা সাধারণত্ব আছে। সেই সংস্কৃতির অংশ হিসেবেই বস্তুতঃ একেক ব্যক্তির মৃত্যুর পর একেক গোষ্ঠী একেক প্রকারের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে।
মাইক্রো-বিশ্লেষণে মনে হতে পারে প্রতিক্রিয়া ব্যক্তকারীরা বুঝি বা 'ইনকনসিষ্টেণ্ট' বা অস্থির প্রকৃতির। কিন্তু ম্যাক্রো-বিশ্লেষণ দেখা যাবে তারা আসলে তা নয় - যথেষ্ট 'কনসিষ্টেণ্ট'। প্রশ্ন হতে পারে, আজ যিনি মৃতের প্রতি অসম্মানের বিপক্ষে, গতকাল তিনি পক্ষে থাকার পরও কীভাবে কনসিষ্টেণ্ট থাকলেন?
উত্তর হচ্ছে এই যে, তিনি শুধু মৃতের প্রতি নয়, নিজের প্রতিও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন বলে মৃত ব্যক্তি সাথে তিনি একাত্মতা বোধ করলে তার প্রতি সম্মান দেখান, আর শত্রুতা বোধ করলে অসম্মান করেন।
উপরে বর্ণিত নীতি বরাবর অক্ষুন্ন ও স্থির রেখেই সর্বপ্রকারের আদর্শবাদী মৃতের প্রতি শব্দাচরণ করেন। এটি সংস্কৃতি, যা 'কাটস এ্যাক্রস অল ফেইথস এ্যাণ্ড আইডিওলজিস' - অর্থাৎ এটি বিশ্বাস ও আদর্শের সীমান্ত সহজেই অতিক্রম করে অস্তিত্বমান থাকে।
আমি আমার জাতির লোকদেরকে আদর্শের আগেও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে উন্নত হতে বলি এবং সেই লক্ষে কাজ করি আমার ক্ষুদ্র সামর্থ্য দিয়ে। আমার কাজের ফৌক্যাল পয়েণ্ট হচ্ছে জাতিগত আত্মপরিচিতি ও আত্ম্মর্য্যাদাবোধ।
আমি মনে করি, যতোদিন না পর্যন্ত অবিভাজ্য বাঙালী আত্মপরিচিত ও অনমনীয় আত্মমর্য্যাদা আমাদের সংস্কৃতির অংশ হয়ে বিকশিত হচ্ছে, বিশ্বের কোনো আদর্শই আমাদের কাজে লাগবে না। একমাত্র আত্মমর্য্যাদাশীলরা নিজের মর্য্যাদাবোধের কারণেই মৃত কিংবা জীবিত কাউকেই অমর্য্যাদা যেমন করতে পারেন না, তেমনি মিথ্যা প্রশংসাও করতে পারেন না।
EmoticonEmoticon