শুক্রবার, ২৭ এপ্রিল, ২০১৮

নজরুল প্রসঙ্গে

কাজী নজরুল ইসলাম বস্তুবাদী ছিলেন না। তবে তিনি অসাম্প্রদায়িক ছিলেন। নজরুল অসাম্প্রদায়িক হওয়ার পেছনের বাস্তবতা ছিল। কাজী পরিবারে জন্ম নেওয়া নজরুল ছোটবেলায় বাবাকে হারান। ফলে দারিদ্রতার মধ্যেই তাঁর ছোটবেলা অতিবাহিত হয়। লেটুর দলে গাণ গাওয়া বা রুটির দোকানে কাজ করা এগুলো তাঁকে করতে হয়েছে। নজরুল মানসে অসাম্প্রদায়িক হওয়ার যে সামাজিক বাস্তবতা ছিল তা সহায়ক ছিল। ব্রিটিশ ভারতে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা থাকলেও সম্প্রতির জায়গা ছিল যথেষ্ট। আবার পড়ালেখা করতে আগ্রহী নজরুলকে হিন্দু জমিদারের সহযোগিতা নিতে হয়েছে।  ময়মনসিংহ এর দরিরামপুর হাইস্কুলে  নজরুল একজন পুলিশ অফিসারের  সহায়তায় কিছুদিন পড়াশোনা করেছেন। তারপর তিনি চলে আসেন বর্ধমানের মাথরুন হাইস্কুলে। সেখানে মহারাজা মনীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর সহায়তা ছিল। সেখান থেকে চলে আসেন রাণীগঞ্জে। সেখানে তিনি শিয়ারশোল রাজ হাইস্কুলে বৃর্তি নিয়ে পড়ালেখা করতেন। সেখানেও হিন্দু জমিদারের সহযোগিতা ছিল। নজরুলের বন্ধুদের মধ্যে হিন্দুরাও ছিল। নজরুলের ঘনিষ্ঠ বাল্যবন্ধু ছিলেন শ্রী শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় । ফলে যে সামাজিক পরিবেশে তিনি বড় হয়েছেন সেখান থেকেই একটি অসাম্প্রদায়িক মানস গড়ে উঠেছে। পরবর্তীতে কলকাতায় অবস্থানকালে হিন্দু মুসলিম দুইপক্ষের সাথে তাঁর সখ্যতা ছিল। আবার রাজ হাইস্কুলে তিনি স্বশস্ত্র বিপ্লবীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। রাজ হাইস্কুলে থাকা অবস্থায় তাঁর সাহিত্য প্রতিভার বিকাশ ঘটে যা সৈনিক জীবনে অব্যাহত ছিল। দশম শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালে ১৯১৭ সালের দিকে তিনি ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্ট এ যোগ দেন। যদিও ব্রিটিশ শাসকদের প্রতি তাঁর একটা বিরোপ মনোভাব ছিল এবং তাঁদেরকে তাড়ানোর জন্য তিনি সৈন্য বাহিনীতে যোগ দেন।   বেঙ্গল রেজিমেন্ট গড়ে উঠেছিল ১ম বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে। ট্রেনিং এর জন্য নজরুলকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বর্তমান পাকিস্তানের প্রথমে পেশোয়ারে পরে করাচি সেনানিবাসে।  ট্রেনিং এর ফাঁকে অবসর সময়ে তিনি পড়াশোনা লেখিলেখি করতেন। সেখান থেকেই কলকাতার সাহিত্য পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন। বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির পত্রিকায় তাঁর লেখা ছাপা হতে লাগলো। সৈনিক অবস্থায় এই পত্রিকার গ্রাহক তিনি হয়েছিলেন। বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভেঙ্গে গেলে তিনি কলকাতায় চলে আসেন। সেখানেই তাঁর পরিচয় ঘটে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতাদের একজন কমরেড মোজাফফর আহমেদের সাথে। মোজাফফর আহমেদের সাথে পরিচয়ের ফলে মার্ক্সবাদের সাথে নজরুলের পরিচয় ঘটে। একদিকে ব্রিটিশ শাসনের প্রতি নজরুলের বিপ্পবী মনোভাব এর সাথে মার্ক্সবাদের হাতেখড়ি। দুই মিলে নজরুল হয়ে উঠেন বিদ্রোহী নজরুল। তখন একের পর এক বিদ্রোহী সাম্যবাদী কবিতা লিখে চলেছেন। মোজাফফর আহমেদের সাথে মিলে ফজলুল হকের মালিকানায় ‘নবযুগ' পত্রিকাও প্রকাশ করেছিলেন। তখনো উড়নচণ্ডী নজরুলের কোন কিছুতে স্থির হতে পারতেন না। মার্ক্সবাদের প্রতি আসক্তি তৈরি হলেও কঠোর নিয়মকানুনের ভেড়াজালে তিনি আটকে থাকতে পারেন নাই। আমরা জানি মার্ক্সবাদী রাজনীতি করতে হলে ব্যক্তিগত জীবনে কঠোর নিয়ম মেনে চলতে হয়। ফলে মার্ক্সবাদের সাথে কিছুটা পরিচয় ঘটলেও তিনি মার্ক্সবাদী ছিলেন না। তবে মার্ক্সবাদ তাঁর সাহিত্যের উপর চাপ ফেলেছিল। এজন্য আমরা তাঁর অনেকগুলো কবিতা পাই শ্রেণী অবস্থান থেকে। যেমন, ‘কুলি মজুর', ‘সাম্যবাদী’ সহ অনেকগুলো কবিতা এই সময়ের।

এখানে একটা জিনিস খেয়াল করলে দেখা যায় নজরুলের বিদ্রোহী সাম্যবাদী ধারার কবিতাগুলো এসেছে ২৯২০-১৯৩০ এর দশকে। তখন তিনি যুবক এবং যৌবনের শক্তি ছিল মনে। ফলে কবিতাগুলো এসেছে সেখান থেকে।
এরপর গ্রামোফোনের রেকডিং আসার ফলে তিনি সংগীতের দিকে ঝুকে পড়েন। কারণ তখন গ্রামোফোন থেকে নগদ কিছু টাকা পাওয়া যেত। যখন টাকা পেতেন দুহাতে খরচ করতেন আবার যখন নাই তখন অভাবী।
কুমিল্লায় প্রমীলা দেবীকে বিয়ে করার আরেক কাহিনী। তিনি গিয়েছিলেন আলী আকবর খানের সাথে কুমিল্লা ভেড়াতে। সেখানে তিনি ইন্দ্রকুমার সেনের  বাড়িতে অবস্থান করেছিলেন। ইন্দ্রকুমার ছিলেন আলী আকবরের বন্ধু বীরেন্দ্রকুমার এর বাবা। ইন্দ্রকুমার সেনের স্ত্রী বিরজাসুন্দরীকে তিনি মা ডেকেছিলেন। প্রমীলা ছিলেন বিরজাসুন্দরীর বিধবা জা গিরিবালা দেবীর মেয়ে। ইন্দ্রকুমারের বাড়িতে নজরুল বেশ জমিয়ে ফেলেছিলেন। সেখান থেকে চলে চলে যান আলী আকবরের  বাড়িতে। সেখানে অবস্থানকালে আলী আকবর তার ভাগিনী নার্গিসের সাথে বিবাহ ঠিক করেন। কিন্তু কোন কারণে বিবাহ ভেঙ্গে যায়। নজরুল সেখান থেকে চলে আসেন ইন্দ্রকুমারের বাড়িতে। সেই বাড়িতে অবস্থানকালে তাঁর প্রণয় ঘটে তরুণী প্রমীলার সাথে।

নজরুল ধর্মত্যাগ বা প্রমীলা নিজ ধর্ম ত্যাগ না করেই তাঁদের দাম্পত্য জীবন পরিচালিত হয়েছিল। এর মধ্যে নজরুল রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছিলেন। কৃষক প্রজা পার্টি থেকে তিনি নির্বাচন ও করেছিলেন।
নজরুলের জীবনে হিন্দু ধর্মের প্রভাব ছিল। ফলে একদিকে তিনি শ্যামা সঙ্গীত রচনা করেছেন আবার অন্যদিকে ইসলামী গজল গাণ রচনা করেছেন। এগুলো আসলে তাঁর কাব্য প্রতিভা। এর মধ্য দিয়ে নজরুলকে সাম্প্রদায়িক বলা যায় না। বরং তিনি অসাম্প্রদায়িক। তিনি হিন্দু মুসলমানের সম্মিলন চেয়েছেন, পারস্পারিক সমঝোতা সহযোগিতা চেয়েছেন। এটাই ছিল অসাম্প্রদায়িক নজরুলের চিন্তার ধারা। তাঁকে ঠিকমত বুঝতে না পারলে কারো কাছে মনে হবে তিনি সাম্প্রদায়িক, কারো কাছে মনে হবে তিনি অসাম্প্রদায়িক বা কারো কাছে মনে হবে তিনি নাস্তিক। নজরুল অসাম্প্রদায়িক ছিলেন তবে সচেতন বস্তুবাদী বা নাস্তিক তিনি ছিলেন না।


EmoticonEmoticon