বৃহস্পতিবার, ১৪ জুন, ২০১৮

কমরেড জাহেদুল হক মিলুর মৃত্যুতে শোকাহত (ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ)

প্রতিদিন তাঁর অবস্থার কথা জেনে জেনে ভেবেছিলাম তিনি সুস্থু হবেন। তাঁর মৃত্যু সংবাদে বুকটা ভারী হয় আসছে। কৈশোর থেকে তাঁকে পরিবারের একজন জেনে আসছিলাম। জীবনের নানা পর্যায়ে কখনো ছিলাম তাঁর খুব কাছে কখনো দূরে কিন্তু কখনোই হ্রদয়ে দূরত্ব তৈরী হয়নি। তাঁর মৃত্যৃতে পরিবারের একজনকে হারালাম।

শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্টার আকাঙ্খায় সমগ্রজীবনব্যাপী নিরন্তর সংগ্রামী একজন মানুষ ছিলেন কমরেড জাহেদুল হক মিলু। আজকের দিনে কোন এক মহান উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করে সাধনা করার মানুষ তেমন নেই বললেই চলে। স্বাধীনতা পরবর্তীতে রাজনৈতিক অস্থিরতা, মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং স্বাধীনতার-ব্যর্থতাবোধ ও স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণাকাতর বিপন্ন মানুষ দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনে যেখানে হা-পিত্যেশ করে ফেরে সেখানে নতুন করে সমাজ-বিনির্মাণের তাগিদে ষোলকোটির মাঝে উজানস্রোতের যাত্রী হাতে গোণা কিছু মানুষের অন্যতম ছিলেন মিলু ভাই।

' দলের রাজনৈতিক আদর্শই জীবনাদর্শ এবং তার দ্বারা নেতা-কর্মির জীবন গড়ে ওঠে । বিপ্লবী জীবনের চেয়ে ব্যক্তিমানুষের জীবন বড় হতে পারে না। সমগ্র জীবনব্যাপী মানুষের মুক্তির সংগ্রামে নিজেকে নিয়োজিত করার চেয়ে বড় জীবন আর কি হতে পারে?'
আমার বাবার সাথে যুক্তি-তর্কের সময় কথাগুলো বলেছিলেন কমরেড মিলু ভাই। বয়সে তাঁরা কাছাকাছি। আমি সেসময় দলের ছাত্রসংগঠনের সাথে যুক্ত হয়েছি। সবে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। সেকারণে আমার বাবা তাঁর কাছে দল সম্পর্কে জানার জন্যই নানা প্রশ্ন করেন। প্রথম যেদিন তিনি আমাদের বাড়ি যান সেদিন এসব কথা হয়।

এরপর অনেক দিনই আমার বাবা-মার সাথে মিলু ভাইয়ের তর্ক-বিতর্ক হয়। এই যুক্তি-তর্কের ফলাফল স্বরূপ আমরা সব ভাইবোন ছাত্রজীবনেই দলের সাথে যুক্ত হয়ে যাই। আমার মা এলাকার সব কমরেডদের মায়ের মতো হয়ে যান। আমাদের এলাকায় কয়েকজন পার্টি মায়ের মধ্যে আমার মা একজন। এটি সম্ভব হয়েছিল মিলু ভাইয়ের ধীরস্বভাব এবং প্রবল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও আদর্শের কারণে।

যখন ইন্টারমিডিয়েট পড়ি সে সময় আমি ছিলাম কলেজের পাশাপাশি। মিলু ভাই প্রায়ই পার্টির কাজে কুড়িগ্রাম থেকে রৌমারী আসতেন। আমার বেডেও অনেকবার ঘুমিয়েছেন । আমার বেডটি ছিল কম প্রশস্ত এবং শক্ত। একরাতে তাঁর ভালো ঘুম হয়নি। সকালে আমাকে বললেন, ' তুমি ঘুমোও কিভাবে? '
কুড়িগ্রাম আর রৌমারীর মাঝখানে বিশাল নদ ব্রক্ষপুত্র, তিন ঘন্টার নৌপথ। আসার সময় তাঁর হোন্ডা মোটরসাইকেলটা সাথে আনতেন। রৌমারীর পথঘাট সেসময় কোথাও পাকা ছিল না। ছিল যেখানে-সেখানে ভাঙা কিংবা বালুময়।

ওই এলাকার মানুষ সেসময় সবকাজই শারীরিক পরিশ্রম দ্বারাই করতো। কারো ঘরে খাবার-দাবারও পর্যাপ্ত ছিল না। নব্বইয়ের দশকের সেই উত্তাল স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় মিলু ভাই নিদারুণ কষ্টে রৌমারীতে পার্টি গড়ে তোলেন। কোন একটা এলাকায় নতুন কাজ গড়ে তোলা কতটা পরিশ্রমের এবং ত্যাগের তা মিলু ভাইকে দেখে অনুভব করতাম । খেয়ে না খেয়ে মাইলের পর মাইল রাস্তা পাড়ি দিয়ে রাজনীতি গড়ে তুলেছিলেন। আমরা ছিলাম তাঁর তুলনায় ননীর পুতুল। কত প্রোগ্রামে যেতে আমরা ক্লান্ত হতাম কিন্তু তাঁকে কখনো ক্লান্ত হতে দেখিনি।

শুধু আমাদের এলাকায় নয় কুড়িগ্রামের নয়টি থানার প্রায় প্রত্যেকটিতে তিনি যেতেন পার্টির কাজে এবং এসব এলাকার অধিকাংশতে তিনি পার্টি গড়ে তোলেন। রাজনীতির শুরুর দিকে যতবার আমাদের এলাকায় আসতেন প্রায় সময়ই একটা করে বই পড়তে দিয়ে যেতেন। পড়ার পর তিনি জানতে চাইতেন কতটা বুঝেছি আর বোঝার ঘাটতি থাকলে আলোচনা করতেন। রাজনৈতিক বইপুস্তক পড়ার অভ্যাস গড়ে দিয়েছিলেন তিনি।

রাজনীতি যে লেখাপড়ারই আরেকটি দিক এবং শিক্ষাজীবনকে পরিপূর্ণরূপে গড়ে তুলতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে, ছাত্রজীবনে প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকার অর্থ যে একই সাথে আরেকটি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগ্রহন করা আমাদেরকে সেই সচেতনতা দিয়েছিলেন মিলু ভাই। বছর শেষ হলেই তিনি রেজাল্ট জানতে চাইতেন। যাদের রেজাল্ট খারাপ হতো তাদের তিনি সরাসরি বলতেন, ' তোমার রাজনীতি করার দরকার নেই। অন্যভাবে সময় নষ্ট করে রেজাল্ট খারাপ করবে আর সব দোষ এসে পড়বে রাজনীতির ওপর। তোমার জন্যই আরো দশজন রাজনীতি থেকে বিমুখ হবে। '
তাঁর এসব কথায় কেউ কেউ কেঁদে ফেলতেন। তিনি অন্যসময় তাকে কাছে ডেকে বোঝাতেন এবং ভালোভাবে লেখাপড়া করার তাগিদ দিতেন। বলতেন 'দলের বিকাশের জন্যই তোমাদের ভালোভাবে পড়াশোনা করা প্রয়োজন। ' আমরা যারা স্কুল জীবনেই দলের সাথে যুক্ত হয়েছিলাম তাদের অধিকাংশই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সফলভাবে সম্পন্ন করি। আমাদের তারুণ্যদীপ্ত সময়ের একজন দক্ষ শিক্ষক ছিলেন তিনি।

মিলু ভাই কাজের বাইরে বাকী সময়ে পড়তেন। তিনি যেসব বই পড়তে দিতেন প্রত্যেকটিতে দেখতাম নানামাত্রিক দাগ। এক্ষেত্রে মিলু ভাই সারাজীবনই ছিলেন একজন প্রাতিষ্ঠানিক ছাত্র। পার্টিজীবনের ডিসিপ্লিনে থেকে সমগ্রজীবনব্যাপী যে আদর্শিক পথ নির্মাণ করে গেলেন তিনি তা বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মকে প্রগতিশীল পথ চলতে সহায়তা করবে।

লাল সালাম কমরেড।


EmoticonEmoticon