প্রতিদিন শিপইয়ার্ডের সাইরেন শুনে আম্মা ও দাদীমা ইফতারি করতেন সাথে আমরা চার ভাইবোন। তখন ইফতার কালে গ্রামে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতো। সাইরেনের বেশ পরে আযান শুনতে পেতাম। কান্দরের ওপার থেকে, গ্রামের একমাত্র জুম্মাঘর থেকে আযান ক্ষিণস্বরে ভেসে আসতো। তখন মাইক ছিলনা। খালি গলার আযান বাতাসের গতিপ্রবাহে উঠানামা করতো। আবার অনেকসময় ভর সন্ধ্যায় শিয়ালের ডাকে আর আযান কর্ণগোচর হতোনা। তবে শিপইয়ারর্ডের সাইরেন সবকিছু ছাপিয়ে আমাদের গ্রামে এসে পৌছাতো। কয়েকদিন আগে আব্বার একটা পোস্টকার্ডের চিঠি মাবুদ কাকা হাট ফিরতি পথে আমাদের বাড়িতে দিয়ে যান। পোস্টকার্ডটি তিনি গদ্দাসকাঠি পোস্ট অফিসের পিওনের কাছ থেকে নিয়ে এসেছিলেন। প্রতি বুধবার হাটবারে পিওন হাটে একটা শিরিষগাছের নীচে বসে বিভিন্ন গ্রামের লোকদের ডেকে ডেকে চিঠি বিলি করতেন। আব্বার পোস্টকার্ড প্রতি হাটবারেই আমাদের বাড়িতে এসে পৌছাতো। এটা একটা নিয়ম হয়ে দাড়িয়েছিলো।
রোজার প্রায় শেষদিকে আব্বার চিঠিটা ইফতারির পরে আমি খাটের উপর হারিকেনের আলোয় খুব জোরে জোরে পড়েছিলাম। আম্মা আমাকে জড়িয়ে ধরে বসে ছিলেন। সামনে দাদিমা ও আমার ছোট দুই ভাই। সব চেয়ে ছোট বোনটি বছর দুই বয়স, সে ঘুমিয়ে ছিলো।
আব্বা ঈদের দুইদিন আগে দিনাজপুর থেকে বাড়ি এসে পৌছাবেন। ম্যালেরিয়া হয়ে আব্বার শরীর দুর্বল হয়ে পড়েছে। আমি ম্যালেরিয়ার অংশটুকু পড়লামনা। কারন তাতে আমার দাদীমা তার ছেলের জন্য কান্না জুড়ে দিবে। আর মায়ের মনের কথা ভাবছিলাম। পরে হয়তো আম্মা পোস্টকার্ড পড়ে জানতে পারবেন। আব্বা বাড়ি এসেই সবার শাড়ী, কাপড়জামা কিনবেন।
আব্বা খুব সকালে এসে বাড়ি পৌছালেন। আমরা দৌড়ে তার কাছে চলে এলাম। কেউ কোলে কেউ তার কাঁধে। কিন্তু আব্বা তার একমাত্র কন্যা বেবিকে কোলে নিয়ে মায়ের সাথে পূকুরঘাটে চলে গেলেন। গোসল করে ফিরে আব্বা প্যান্টজামা পরে ফিতে দিয়ে আমাদের মাপ নিলেন। ঝাঁটার কাঠি দিয়ে আমাদের পায়ের মাপ নিলেন। তারপর মা ও দাদীমার সাথে কথা বলে একটা ফর্দ তৈরি করলেন। তারপর আমাদের জ্ঞাতি চাচা সামায়ুনকে নিয়ে খুলনা সাহেবের হাটে রওয়ানা দিলেন। তখন আমি ক্লাস ফোরে পড়ি। ইশকুল একমাস দশদিন বন্ধ। ভাদ্রমাস পথঘাট কর্দমাক্ত কিন্তু বৃষ্টি নেই। আমি আর আমার পরের ভাই জামাল দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত নতুন জামা কাপড়ের স্বপ্নে পুলকিত মনে ইশকুল মাঠে ফুটবল খেলে সরকারি পুকুরে ঘন্টাখানেক ডুবসাঁতার দিয়ে প্যান্ট গেঞ্জি নিংড়ে উদোম হয়ে দৌড়ে বাড়ি চলে আসি। নাংলার বিল পাড়ি দিয়ে ম্যাদামারা সুর্য তখন বড় গাঙএ ঝাঁপ দিতে উদ্যত।
বাড়ি এসে দেখি উঠানে আমার জ্ঞাতি চাচা, চাচী, ভাইবোনেরা ঝাঁকবেধে আছে। আমার দাদীমা ঢেকিঘরের সামনে একটা জলচৌকিতে বসে কাঁদছেন আর আমার ছোট কাকীমা তাকে পাখার বাতাস করছেন। আব্বা বড় ঘরের বারান্দায় একটা হাতাওয়ালা চেয়ারে লুঙ্গি পরে উদোম গায় বসে আছেন। আমার ছোটকাকা ও আরো কয়েকজন আব্বাকে প্রস্ন করে কিসব জানতে চাচ্ছে। মনে হচ্ছে আব্বা খুবি বিরক্ত। পাশের বাড়ির রাংগা দাদী চিৎকার করে গালিগালাজ শুরু করেন।
হারামজাদা চোরভাতারী তোগে বংশ নিব্বংশ হবে। রোযা রমজানের দিন চুরি এরিছিস তোগে মাথায় টাডা পড়বে। কত দুরিরতে ছুয়ালডা রেলের গাড়ি ঠেঙায়ে বাড়ি আইছে।
আব্বা এবার চেঁচিয়ে বলেন, যা হওয়ার তা হইছে আল্লার মাল আল্লাহ নিছে। তোমরা সব যার যার বাড়ি যাও। ইফতারির সময় হচ্ছে।
এতক্ষণ আমরা ল্যাংটা হয়ে নির্বাকভাবে উঠানের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম। সে দিকে আমার খেয়াল ছিলনা। আব্বা আমাদের ল্যাংটা থাকা একদম পছন্দ করেননা। কিন্তু আমরা এই পরিবেশে হতবাক ও ভয়ে দিকবিদিক হয়ে পড়েছি।
মায়ের ডাকে সম্বিত ফিরে আমরা ঘরে যেয়ে হাফপ্যান্ট পরে ফেলি। এখনো কোন ঘটনা আমি বুঝতে পারিনি। মায়ের ব্যাথামাখা মুখ দেখে আমি কিছু জিজ্ঞেস করার উৎসাহ পাইনি। ইফতারির জন্য আমরা সবাই মাদুর পেতে বসেছি। প্রতিদিন আমরা ইফতারি করি ছোলামুড়ি, চালমাখা বা চিড়ে মাখা, গাছের আমড়া কুচি, আখের গুড়ের সরবত। আজ তার ব্যতিক্রম। আব্বা আসলে প্রতিবার এরকম হয়। আজ ইফতারিতে রয়েছে জিলিপি, পিয়াজু, বেগুনি, সিক কাবাব। আব্বা প্রতিবার বাড়ি আসলে খুলনা থেকে আশিআনা হোটেলের শিককাবাব আনেন।
এখন ইফতারিতে দাদীমাকে দেখছিনা। সে তার ঘরে শুয়ে আছে। আব্বা ডাকতে গেলেও তিনি আসেননি। কয়েকবছর থেকে দাদীমা রোজা রাখতে পারেননা। আম্মা একটা হেরিকেন ও ইফতার দাদীমার ঘরে দিয়ে আসলেন।
আমি সরবত খেয়ে সবকিছু বাদ দিয়ে কাবাব খেতে শুরু করেছি। তখন আব্বা আসল কথাটি পাড়লেন। বাজারে শাড়ি, আমাদের প্যান্ট জামা কিনে সামায়ুন কাকার কাছে একটা নতুনচটের ব্যাগে ভরে তাকে আব্বার এক পরিচিত দোকানে বসিয়ে রেখে, তিনি আমাদের জুতা স্যান্ডেল কিনতে যান। তিনি জুতা স্যান্ডেল কিনে ফিরে এসে দেখেন, সামায়ুন কাকার পায়ের কাছ থেকে কাপড়ের ব্যাগ গায়েব। অনেক খোঁজাখুঁজি করে কোনো হদীস করতে পারেননি। তাই এবার আমাদের পুরানো প্যান্ট পাঞ্জাবী দিয়ে ঈদ করতে হবে। তবে আমাদের নুতন জুতা কিনেছেন। আম্মা আমাদের শান্তনা দিয়ে বললেলন তোমাদের আব্বা যে জান নিয়ে ফিরে আসতি পারিছে, সেইডাই আল্লার কাছে শোকর। ইতোমধ্যে খবর রটে গেলো রেডিওতে বলেছে চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে চাঁদ দেখা গিয়েছে। তাই আগামীকাল ঈদ।
আমাদের তিন ভাইয়ের পাঞ্জাবী আম্মা কেঁচে ভাতের ফ্যানের মাড় ও নীল দিয়ে রেখেছিলেন। আমরা নতুন জুতা পায়ে গলিয়ে দাদীর ঘরে তার বিশাল আসমানতাঁরা খাটে উঠে পাঞ্জাবী ভাজকরে হাত দিয়ে মেজে সমান করে বালিশের নীচে রেখে দাদিমাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ি। দাদীমা তার বিয়ের পরে দাদার সাথে প্রথম ঈদের গল্প শুরু করেন। তখন নাকি ঈদের নামাজ পড়ার ঈমাম কুমিল্লা থেকে আনতে হয়েছিলো। তখন এতল্লাটে ঈদের নামাজ জানা কোন মৌলভী ছিলনা। দূর থেকে বনবিড়াল ডাকতে থাকে, আমরা দাদীজানকে জোরে আঁকড়ে ধরি। নতুন জুতার গন্ধে চাঁদ রাতে আমরা ঘুমিয়ে পড়ি।
EmoticonEmoticon