আমার বয়স যখন ৯ বা ১০, তখন দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো। সবসময় বলি, আমার ছেলেবেলার উচ্ছলতা চুরি হয়েছিল ১৯৭১ সালে, পাকিস্তানিদের বর্বরতার কারণে। তখন আমাদের বয়সী সবার কাছ থেকে হঠাৎ যেন শৈশব হারিয়ে গিয়েছিল। শৈশবে তো কারই লাশ দেখার কথা নয়। ‘রেপ্ড’ শব্দের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার কথা নয়। অথবা গণহত্যা দেখার কথা নয়। মনে হয়, ওইখানেই কোথায় যেন শৈশবটা হারিয়ে গেছে! হঠাৎ যেন আমরা সবাই বড় হয়ে গিয়েছিলাম।
বুবা(বাবা গোলাম মুস্তফা) তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অনেক বড় তারকা ছিলেন। তখন পরিচিত লোকদের ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করত পাকিস্তানিরা। এ কারণে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার এক পর্যায়ে বুবা আমাদের সঙ্গে থাকতেন না। অনেকদিন পরপর তিনি আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। যুদ্ধের একসময় বাবার ওই লুকোচুরির জটটা একটু একটু করে খুলতে থাকল। কিন্তু তখন নতুন এক ঝামেলা হলো। বিভিন্ন মাধ্যমের পরিচিত মানুষদের ধরে নিয়ে গিয়ে রেডিওতে অনুষ্ঠান করাত এ দেশের অনেকেই। আমি তাদের রাজাকার বলি। মনে আছে, জুনের প্রচ- গরমেও মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি আর গলায় মাফলার জড়িয়ে রাখতে দেখেছি। কারণ তার ঠোঁটে ক্যান্সার হয়েছে। [!] মর্মে তিনি চিকিৎসকদের কাছ থেকে একটি মিথ্যা সনদপত্র নিয়ে এসেছিলেন। তাই কথা বলা বারণ। এ কাজটি তিনি করেছিলেন, যাতে রেডিওতে যেতে না হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা যখন এলিফ্যান্ট রোডের বাড়িতে থাকতাম, তখন চলচ্চিত্র শিল্পে অচলাবস্থা। একরকম বন্ধই বলা যায়। এ কারণে তখন বুবার কোনো কাজ ছিল না। রেডিওতে যাচ্ছেন না। টিভিতেও না। তখন মা বাড়ির সামনে ও পেছনের খোলা জায়গায় সবজি চাষ আর মুরগি পুষতে শুরু করেছিলেন।
তখন পাকিস্তান টিভিতে যে অনুষ্ঠানগুলো প্রচার হতো, তা আমাদের দেখতে দিতেন না বুবা। কেননা, তাতে প্রচুর মিথ্যা কথা থাকত। আমাকে ছোটবেলায় এত মিথ্যা শুনতে দিতে চাননি তিনি। সে সময় আমরা যারা বেড়ে উঠছিলাম, তাদের প্রত্যেকেরই মনে থাকার কথা কীভাবে আমাদের দিনগুলো কেটেছে। আমাদের কাছে বুবা ১৯৭১ সালের কোনো কিছুই লুকাননি। যুদ্ধের আগে ‘মিশর কুমারী’ নামে একটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন। চলচ্চিত্রটির সেট থেকে একটি বড় মাটির ভাস্কর্য বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন। ২৬ মার্চের পর হানাদার বাহিনীর আক্রোশে পড়ার ভয়ে সেটি টুকরো টুকরো করে ভেঙে ফেলা হয়েছিল। এরপর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হলো। তখন আমাদের একটি রেকর্ড প্লেয়ার ছিল। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শুরু হলে বসার ঘরে অনেক জোরে গান বাজিয়ে আম্মার ঘরে লেপ-মুড়ি দিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতারের অনুষ্ঠান শুনতাম। যখন দেশ স্বাধীন হলো, তখন আমাদের মধ্যে ‘বড় হয়ে গেছি’ ধরনের একটা মনোভাব হলো।
স্বাধীনতার পর আমরা অটো প্রমোশন নিয়ে নতুন ক্লাসে ভর্তি হলাম। জীবনের প্রথম রিকশা চড়ে একা স্কুলে আশা-যাওয়া করতাম। এলিফ্যান্ট রোড থেকে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের রিকশা ভাড়া ছিল ৫ সিকি। সে সময় বুবার এক বন্ধু [নূরুল কাদের খান] আমাকে কোকাকোলা আর চকবার আইসক্রিম খাইয়েছিলেন। তখন গ্রিন রোডে ইকবাল স্টোর নামে একটি দোকান ছিল। বুবার সঙ্গে প্রায়ই সেই দোকানে যাওয়া হতো। সেই দোকানে গেলে দোকানদার একটা না একটা জিনিস আমার হাতে তুলে দিতেন। অনেক বছর পর গুলশানে একটি দোকানে সেই দোকানদারের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। সেখান থেকেও কী যেন কিনেছিলাম। ছোটবেলার মতো বড়বেলাতেও তিনি আমার হাতে একটা বস্তু ধরিয়ে দিলেন। তাকে বললাম, এসবের মানে কী? তিনি জানালেন, এসব তো তুমি এমনিতেই পাও।
স্বাধীনতার আগে ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্রী ছিলাম। কিন্তু যুদ্ধের পর অটো প্রমোশনের পাশাপাশি স্কুলে বাংলা মাধ্যমে লেখাপড়া শুরু হলো। এ কারণে আমার অনেক বন্ধু পুরনো স্কুল পরিবর্তন করে নতুন স্কুলে ভর্তি হয়েছিল। আমার আর স্কুল পরিবর্তন করা হলো না। বুবা তখন স্কুলের শিক্ষকদের কাছে গিয়ে বললেন, বাংলাতেই পড়ূক না। অসুবিধা কী? অন্য বাচ্চাদের যেটুকু অসুবিধা হবে ওরও সেটুকু হোক। তখন আমি বাংলা লিখতে ও পড়তে পারতাম। তবে ইতিহাস নিয়ে অনেক অসুবিধা হতো। কারণ এত কিছু বাংলায় পারতাম না। আম্মা আমাদের পড়ালেখার তদারকি করতেন। মনে আছে, তখন পড়া ফাঁকি দেওয়ার বুদ্ধিও কম ছিল। স্কুলের পরীক্ষা ছিল। ইতিহাস পরীক্ষার আগের দিন আম্মাকে বললাম, ইতিহাসের পরীক্ষা হবে না। আম্মা স্কুলে ফোন করে জানলেন পরের দিন পরীক্ষা হবে। পরে মা শাস্তি হিসেবে আমাকে সারারাত ইতিহাস পড়িয়েছিলেন। স্কুলের পরীক্ষা নিয়ে অনেক চালাকি করতাম। কিন্তু নিঁখুত বুদ্ধি ছিল না বলে বারে বারেই আম্মার কাছে ধরা খেয়ে যেতাম।
অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত অঙ্কে অনেক কাঁচা ছিলাম। স্কুলের একবার অঙ্ক পরীক্ষায় মাত্র ২ নম্বর পেয়েছিলাম। ঘরে গিয়ে অঙ্কের খাতা দেখাব কী করে এই ভেবে লজ্জিত হয়েছিলাম সেদিন! খাতায় লাল কালিতে আন্ডারলাইন করে ২ নম্বর দেওয়া হয়েছিল। পরে আমি ২-এর আগে ৯ লিখে ৯২ করেছিলাম। তখন এত বুদ্ধি না থাকায় কালো বা নীল রঙের কালি দিয়ে ৯ লিখেছিলাম বলে ধরা খেয়েছিলাম। আম্মা খাতা দেখেই ধরে ফেলেছিলেন।
এরপরই আমার জন্য গৃহশিক্ষক নিযুক্ত করা হলো। তিনি আমাকে অনেক হোমওয়ার্ক দিয়ে যেতেন। সেগুলো ছিঁড়ে ফেলে দিতাম। আবারও ধরা খেতাম। তিনি আমাকে অনেক বড় বড় ফিগারের অঙ্ক দিয়ে যেতেন। আমি সেগুলো ইরেজার দিয়ে মুছে ছোট করে ফেলতাম।
অনেক দুষ্টু প্রকৃতির মেয়ে ছিলাম আমি। পরিবারের সব দুষ্টুমি আমিই করতাম। একবার স্কুলের একটি আবৃত্তি অনুষ্ঠানে নাম লিখিয়েছিলাম। বাড়ির কাউকে বলিনি সেই কথা। কীভাবে যেন অনুষ্ঠানের জন্য চূড়ান্তও হয়ে গিয়েছিলাম! বুবা কীভাবে যেন জানতে পেরেছিলেন বিষয়টি। তিনি বললেন, কী আশ্চর্য! কাউকে কিছু না বলে তুই একটা প্রতিযোগিতায় নাম লিখিয়ে দিলি! অনেকটা ছবির গল্পের মতোই ‘ছাড়পত্র’ কবিতা পাঠ করলাম। সেই প্রতিযোগিতায় আমি প্রথম হয়েছিলাম। কিন্তু তখন এত ত্যাদোড় ছিলাম যে, সে কথা বাড়িতে এসে কাউকে বলিনি। সেদিন স্কুল থেকে শিক্ষকরা আমাদের বাড়িতে এলেন। কারণ আমি প্রথম হওয়ার ট্রফিটি নিয়ে আসিনি। বুবা তখনও বুঝতে পারেননি ঘটনা কী হয়েছে। যখন জানলেন, তখন বুবার মুখটা দেখার মতো ছিল। বুবা অদ্ভুত হাসিমুখে বলেছিলেন, ‘আমি তো আগে থেকেই জানি এমন একটা কিছু হবে।’
আমার অভিনয়ের শুরুটা আম্মার হাত ধরেই। আম্মা রেডিওর প্রযোজক ছিলেন। তখন তিনি খেলাঘর নামে একটি অনুষ্ঠান প্রযোজনা করতেন। মাঝেমধ্যে ওই অনুষ্ঠানে তিনি বাচ্চাদের নিয়ে নাটক করতেন। আমিও অন্য আট-দশটা শিশুর মতো সেখানে অভিনয় করতাম।
আমার কিশোরীবেলার গল্পগুলো অনেক। একটু পেছনের দিকে তাকালেই শৈশবের অনেক কথাই মনে পড়ে। তখন অনেক আনন্দ আর বিস্ময় আমার চোখে ঝিলিক দিয়ে ওঠে।
আমার কিশোরীবেলার গল্পগুলো অনেক। একটু পেছনের দিকে তাকালেই শৈশবের অনেক কথাই মনে পড়ে। তখন অনেক আনন্দ আর বিস্ময় আমার চোখে ঝিলিক দিয়ে ওঠে।
এভাবেই নিজের শৈশবকে তুলে আনেন সুবর্ণা মোস্তফা। তারপর বাকিটা ইতিহাস
১৯৬৮ সালে শিশুশিল্পী হিসেবে টিভি নাটকে প্রথম অভিনয় করেন আজকের কিংবদন্তী অভিনেত্রী সুবর্ণা মোস্তফা। মোহাম্মদ জাকারিয়া প্রযোজিত সেই নাটকের নাম ছিলো - একটি মুখোশ ও একটি মোমবাতি। তারপর শুধু এগিয়ে চলা, সাফল্যের জয়মালা গলায় নিয়ে। মঞ্চ, টিভি, রেডিও এবং চলচ্চিত্রে অভিনয় প্রতিভার দ্বীপ্ত স্বাক্ষর রেখেছেন, ৫০ বছর ধরে। তার পাশাপাশি অনেক অভিনেত্রীর আগমন ঘটেছে, আবার কালের গর্বে হারিয়েও গেছে। কিন্তু সততা ও মানুষের ভালোবাসা নিয়ে সুবর্ণা মোস্তফা ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন।
৭০ এর দশকে এই জুটির কাজ শুরু হলেও জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠে ৮০ এর দশকে। সেই জনপ্রিয়তা এখনও মানুষকে নষ্টালজিক করে তোলে। এমনকি এই মূহুর্তেও আফজাল-সূবর্ণা জুটি নিয়ে নাটক তৈরী হয় এবং সেটাতে আগের প্রজন্মের দর্শকদের সাথে সাথে বর্তমান প্রজন্মের দর্শকদেরও আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়।
সেই কালজয়ী জুটির একজন হচ্ছেন সূবর্ণা মোস্তফা।
মঞ্চ, নাটক, সিনেমা - প্রতিটি ক্ষেত্রেই দাপটের সাথে অভিনয় করে গিয়েছেন এবং এখনো করে যাচ্ছেন।
সেই মোহনীয় নারী সুবর্ণা মোস্তফার জন্মদিন ২রা ডিসেম্বর।
মঞ্চ, নাটক, সিনেমা - প্রতিটি ক্ষেত্রেই দাপটের সাথে অভিনয় করে গিয়েছেন এবং এখনো করে যাচ্ছেন।
সেই মোহনীয় নারী সুবর্ণা মোস্তফার জন্মদিন ২রা ডিসেম্বর।
জন্মদিনে শুভেচ্ছা সুন্দরীতমা
EmoticonEmoticon