আমার ধারণা, বাংলাদেশে নির্বাচনোত্তর এই নতুন বছরটিতে অধিকাংশ মানুষ প্রবেশ করেছে ভগ্নহৃদয় ও বেদনার্ত মন নিয়ে। বিষয়টি এমন নয় যে, এরা অত্যাবশকীয়ভাবে কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য বা সমর্থক।
আমি গত ক'দিন ধরে দেশে-বিদেশে স্বজাতির অগণিত মানুষের সাথে কথা বলে বুঝেছি, বাংলাদেশের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যেভাবে জনগণের ভৌটাধিকার হত্যা করা হলো সুপরিকল্পিতরূপে প্রত্যক্ষভাবে রাষ্ট্রের প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, নির্বাচন কমিশন এবং এমনকি পরোক্ষভাবে সেনাবাহিনীকে কাজে লাগিয়ে, তাতে মানুষ সাংঘাতিকভাবে অরক্ষিত ও অসহায় বোধ করেছে।
জনগণের মধ্যে বোধিত এই অসহায়ত্বের কারণ হচ্ছে, তাদের প্রত্যক্ষণ সীমানার মধ্যে তাদের পক্ষে দাঁড়াবার ও লড়বার প্রকৃত গণতান্ত্রিক দল বা শক্তির অনুপস্থিতি। বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দলের ওপরই জনগণের কোনো ভরসা নেই। কারণ, জনগণ খুবই তিক্ত অভিজ্ঞতা দিয়ে জানে যে, শেষপর্যন্ত এগুলোর একটিও প্রকৃত অর্থে জনগণের গণতান্ত্রিক দল নয়।
গণতান্ত্রিক দলের বস্তুনিষ্ঠ বৈশিষ্ট্য কী, তা নিয়ে আমি অতীতে আলোচনা করেছি এবং আবার করবো। তবে বর্তমান আলোচনার প্রয়োজনে আমি গণতন্ত্রের রাজনৈতিক বোধটি কী, তা বুঝাতে এক বাক্যে বলবোঃ
বিজ্ঞানাশ্রিত যুক্তি-তর্ক ও বস্তুনিষ্ঠ প্রমাণ-যাচাইয়ের ভিত্তিতে জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের তৈরি আইনে রাষ্ট্র পরিচালনায় ও সর্বজনীন মানবাধিকার-সহ জনগণের সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসীরা হচ্ছে গণতন্ত্রী।
ধর্মবাদী দলসমূহ সংজ্ঞানুসারে গণতান্ত্রিক নয়। করণ, তারা জনগণের সার্বভৌমত্বে ও মানুষের তৈরি আইনে বিশ্বাস করে না। অন্যান্যের মধ্যে যারা বংশানুক্রমিক পূর্বনির্ধারিত নেতৃত্বের বিশ্বাসী, তারাও সংজ্ঞানুসারে গণতান্ত্রিক নয়, কারণ নেতৃত্ব বিষয়ক তাদের ধারণা রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার মতো।
আমাদের বুঝতে হবে, আধুনিক রাষ্ট্রের রূপ হচ্ছে রিপাবলিক বা জনতন্ত্র। এই জনতন্ত্রের উদ্ভব ঘটেছে রাজতান্ত্রিক, সাম্রাজ্যিক, ঔপনিবেশিক ইত্যাদি রাষ্ট্র ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে, সার্বভৌম ক্ষমতা বংশানুক্রমিক রাজা বা সম্রাটের কাছ হাত থেকে সমগ্র জাতি তথা জনগণের হাতে আনার মাধ্যমে।
তাই, একটি রিপাবলিক বা জনতন্ত্র পরিচালনাত করতে গেলে প্রয়োজন যে ব্যবস্থা-পদ্ধতির প্রয়োজন, তা হচ্ছে গণতন্ত্র। আর, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা-পদ্ধতিতে একটি রিপাবলিক পরিচালনা করতে পারে গণতান্ত্রিক কাঠামো ও পদ্ধতিতে সংগঠিত বহুর মধ্যে সর্বজনপ্রিয় এক বা একাধিক রাজনৈতিক দল।
কিন্তু, যে রাজনৈতিক দল নিজেই গণতান্ত্রিক নয়, তার পক্ষে একটি গণতান্ত্রিক সরকার গঠন করা সম্ভব নয় এবং একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিচালনা করা সম্ভব নয়। নৌকার দাড়ি-মাঝির পক্ষে যেমন জাহাজ চালানো সম্ভব নয়, রূপতঃ তেমনিভাবে অগণতান্ত্রিক দল দিয়ে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিচালনা করা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশে রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টি ইত্যাদি দলগুলো গণতান্ত্রিক দল নয়। তাই, জনগণ যদি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্যে এই দলগুলোর ওপর নির্ভর করে, তাদের সে-আশা ততোদিন পর্যন্ত পূরিত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই, যতোদিন পর্যন্ত এই দলগুলো খোদ গণতান্ত্রিক না হচ্ছে।
এর বাইরে কারা আছে? এর বাইরে আছে বামপন্থী বলে পরিচিত কিছু দল, যারা মার্ক্সবাদী দর্শনের বিশ্বাসী এবং সে-কারণে তারা শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কত্বে বিশ্বাসী, যা বাস্তবে শ্রমিক শ্রেণীর প্রতিনিধি হিসেবে দাবী করা দল ও তার শীর্ষনেতার একনায়কত্বে পর্যবসিত হয় বলে ইতিহাসে দেখতে পাই।
আমি বলতে চাইছি, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে প্রকৃত অর্থে জনগণের কোনো গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল নেই। যারা বাংলাদেশে রাজনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা দেখতে চান, তাদেরকে অস্তিত্বশীল দলসমূহের বাইরে নিজেদের উদ্যোগে ও সমন্বয়ে কাঠামো ও পদ্ধতিগতভাবে একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল গড়ে তুলতে হবে।
উপরোক্ত দলটিকে গড়ে উঠতে হবে জনগণের কাছে রাষ্ট্র পরিচালনার একটি গণতান্ত্রিকে শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থা, একটি কল্যাণধর্মী জাতীয় অর্থনৈতিক রূপরেখা, শিক্ষা-চিকিৎসা-বাসস্থান-নিরাপত্তা, আইনের শাসন, ন্যায়বিচার, জাতীয় প্রতিরক্ষা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও ভূমিকা সহ যাবতীয় বিষয়ে সুনির্দিষ্ট ও স্পষ্ট লক্ষ্য ও কর্মসূচি প্রণয়ন করার মধ্য দিয়ে।
অভ্যন্তরীণভাবে, এই দলে মানুষের মূল্য হবে তার জন্ম দিয়ে নয়, কর্ম দিয়ে। অর্থাৎ, এই দলটির কোনো পর্যায়েই কোনো ব্যক্তিই তার পিতা-মাতা-ভ্রাতা-ভগ্নি কিংবা স্বামী-স্ত্রী-শ্বশুর-ভাশুরের কারণে ন্যুনতম কোনো 'গ্রেইস' বা আশির্বাদ পাবেন না। প্রতিটি ব্যক্তি সদস্য হিসেবে সমান অধিকার নিয়ে নিজের যোগ্যতা ও কর্মের ভিত্তিতে উপযুক্ত স্থান পাবেন।
প্রস্তাবিত জনগণের নতুন গণতান্ত্রিক দলটির 'কৌর ভ্যালু' বা অন্তর-মূল্যবোধ হবে বাঙালী জাতির স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রতিশ্রুত তিন মন্ত্রঃ সাম্য, মনুষ্য মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার। অর্থাৎ, সংজ্ঞানুসারে প্রতিটি মানুষ সমান, প্রত্যেকে সমান মনুষ্য মর্য্যাদার অধিকারী এবং সকলের প্রতি একই ন্যায়বিচারের নীতি প্রযোজ্য।
২০১৯ সালকে প্রস্তুতি-কাল ধরে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের মানুষের সামনে স্বৈরতন্ত্রের বিপরীতে জনগণের প্রকৃত গণতান্ত্রিক দল হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করলে মানুষের মধ্যে দেশ-জাতি-রাজনীতি বিষয়ে নতুন আশাবাদ তৈরি হবে বলে ধারণা করা যায়।
যারা জীবন বিষয়ে আশাবাদী, তাদরকে হতাশ হলে চলবে না। পরিস্থিতির বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ ও সঠিক উপলব্ধির ভিত্তিতে লক্ষ্য নির্ধারণ করে তা অর্জনে যতো প্রয়াস ও সময়ই লাগুক না কেনো, তা যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব শুরু করতে হবে।
আমি আশা করবো, উৎসাহী পাঠক আমার কথাগুলো বিবেচনা করবেন এবং সমমনা বন্ধুদের সাথে সহভাগ করে আলোচনা করবেন।
EmoticonEmoticon