লক্ষ করলাম, বিতর্ক চলছে ইসলাম সম্পর্কিত সন্ত্রাসবাদের সম্ভাব্য উৎস নিয়ে। কেউ বলছেন, এটি ইসলামী সন্ত্রাসবাদ, যার উৎস হচ্ছে ইসলামিক পুস্তকাদি। আবার কেউ বলছেন এতে ইসলাম ধর্মের কোনো দোষ নেই, দোষ হচ্ছে 'খুনী স্বভাব' সম্পন্ন ব্যক্তিদের, যারা ইসলামের নাম ব্যবহার করছে মাত্র।
আমার মতে, তাত্ত্বিকভাবে এ-দু'টো ধারণাই 'রিডাকশনিষ্ট' বা হ্রাসবাদী, যা একটি সামাজিক ফেনোমেননকে পুস্তক কিংবা ব্যক্তিত্বের মধ্যে 'রিডিউস' বা হ্রাস করে বুঝতে ও বুঝাতে চায়। এ-প্রকারের হ্রাসবাদী তত্ত্ব দিয়ে আলোচ্য সন্ত্রাসবাদকে যৌক্তিকভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না।
ধর্মের নাম সন্ত্রাসবাদ যদি কেবলই পুস্তক বা ব্যক্তিত্বের ব্যাপার হতো, আলোচ্য সন্ত্রাসবাদ সাম্প্রতিক না হয়ে বরং হাজার বছর ধরে চলতে থাকা একটি নিত্য ঘটনা হতো। কারণ, যে ইসলামিক গ্রন্থাদির কথা বলা হচ্ছে, সেগুলো যেমন হাজার বছর ধরে রয়েছে, তেমনি মানুষের খুনী স্বভাবের কথা বলা হচ্ছে, তাও স্মরণাতীত কাল থেকে রয়েছে। ফলে, উপরে বর্ণিত হ্রাসবাদী দাবী দু'টো সঠিক হতে পারে না।
ধর্মের নামে ঘটমান সন্ত্রাসবাদ একটি বৈশ্বিক ঘটনা, যার রয়েছে জটিল ঐতিহাসিক, দার্শনিক-আধ্যাত্মিক, সমাজ-মনোস্তাত্ত্বিক ও ভূ-রাজনৈতিক মাত্রা, এবং যা শেষপর্যন্ত স্থানীয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সম্পদ ও ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের প্রতিযোগিতায় আইডেণ্টিটি বা আত্মপরিচয়ের সাথে আপেক্ষিক বঞ্চনা-বোধের মিলনে সৃষ্ট একটি ষ্ট্যাটাস্কৌ-পরিবর্তনের প্রকল্প বাস্তবায়নের রণনীতি ও রণকৌশল।
খুব সংক্ষেপে, প্রকল্পটি হচ্ছে একটি অভিন্ন বৈশ্বিক মুসলিম জাতি ও ইসলামিক রাষ্ট্র বা খিলাফাত গঠন। এটি অনেকটা কার্ল মার্ক্সের শ্রেণীহীন, জাতিহীন ও রাষ্ট্রহীন কমিউনিষ্ট বিশ্ব গড়ে তোমার মতোই একটি ইউটোপিয়া। বস্তুতঃ গত শতকের শেষ দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্য দিয়ে কমিউনিষ্ট ইউটোপিয়া ভেঙ্গে পড়ার পরই বঞ্চনাবোধ-ক্লিষ্ট মুসলিমদের মধ্যে এই ইসলামিক ইউটোপিয়া ক্রমশঃ জনপ্রিয় হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে।
তবে, এই প্রকল্পের জনপ্রিয়তা সাম্প্রতিক হলেও, এর প্রস্তাবনা বেশ প্রাচীন, যা নতুন করে প্রাণ পেয়েছে উপযুক্ত পরিবেশ পেয়ে। বস্তুতঃ সপ্তম শতক থেকে শুরু করে বিশ শতকের প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত ইসলাম ধর্মাবলম্বী আরব, ইরানী, তুর্কী, তাতার, আফগানী, হিন্দুস্থানী-সহ নানা জাতির মুসলমান যে ‘মুসলিম সাম্রাজ্য’ শাসন বা উপভোগ করার স্মৃতি ও গর্ব ধারণ করে, তার আলোকে হৃত-সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারের আকাঙ্ক্ষার এক জটিল মনোস্তাত্ত্বিক জমিনের ওপরই কর্ষিত হচ্ছে নতুন করে একটি মুসলিম জাতি ও ইসলামিক খিলাফাত গড়ে তোলার।
অবশ্য, কমিউনিষ্ট ইউটোপিয়ার মতোই, ইসলামিক এই ইউটোপিয়ার রয়েছে একাধিক নেতৃত্বাদানকারী জাতি, একাধিক তত্ত্ব ও একাধিক চর্চা। আর, সে-কারণে এদের তুমুল প্রতিযোগিতাও লক্ষণীয়।
উপরে আমি শুধু আমার ব্যাখ্যার একটি প্রাথমিক রূপরেখা উপস্থাপন করলাম, যার তাত্ত্বিক ভিত্তি হচ্ছে একাধিক সমাজ-মনোবৈজ্ঞানিক ও রাজনৈতিক তত্ত্ব, যার আলোকে বিষয়টি সবিস্তারে বুঝার দাবী রাখে।
EmoticonEmoticon