শুক্রবার, ১৭ মে, ২০১৯

শ্রেণী সংগ্রাম তত্ত্বঃ বিশ্ব-রাজনীতি বুঝার জন্যে অপর্যাপ্ত

ইতিহাসকে শুধু শ্রেণী সংগ্রামের আলোকে বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা করে বুঝতে চাইলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে উপলব্ধি বাদ পড়ে যায়।

শ্রেণী সংগ্রামের তত্ত্ব খুবই সাধারণীকৃত (generalised) তত্ত্ব, যার মধ্যে একটি সাধারণ সত্য আছে, যা একটি জাতির অভ্যন্তরীণ আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতি চিত্র বুঝতে সাহায্য করে, কিন্তু জাতিময় ও জাতিবিভক্ত বিশ্বের জটিল ডাইনামিক্স বুঝার ক্ষেত্রে তা পর্যাপ্ত নয়।

যুগে-যুগে নানা দেশের নানা জাতির যে উত্থান এবং বিশ্বজোড়া সাম্রাজ্য গঠন, বর্ধন ও পরিচালনের প্রক্রিয়ায় যুদ্ধ, হত্যা, ধ্বংস, আবিষ্কার, নির্মাণ ইত্যাদি না বুঝে সবকিছুকে শ্রেণী সংগ্রামের তত্ত্বে সাধারণীকৃত করে দেখলে বস্তুতঃ ইতিহাস সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ জ্ঞান গড়ে তোলা যায় না।

এই মুহূর্তে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের বিরুদ্ধে আরব-ইসরায়েল-মার্কিন শক্তির যুদ্ধ-হুমকি এবং তুরষ্ক, রাশিয়া, চীন ও ইউরোপীয় শক্তিসমূহের নানা প্রকারের ভূমিকার যাবতীয় হিসেব-নিকেশ বুঝে বস্তুনিষ্ঠ ধারণা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে শ্রেণী সংগ্রামের তত্ত্ব শোচনীয়ভাবে পরাজিত। আর সে-কারণেই মার্ক্সবাদীরা বর্তমান বিশ্বের গতি-প্রকৃতি বুঝতে ও সে-অনুসারে ক্রিয়া করতে ব্যর্থ।

‘বিশ্ব দুই ভাগে বিভক্ত - শোষক ও শোষিতে বিভক্ত’ এই জাতীয় লেন্স দিয়ে বিশ্বের পরিস্থিতি দেখলে কিছুই বুঝা যাবে না। এখানে বিবেচনা করতে হবে প্রতিটি দেশ বা জাতির ইতিহাস ও স্মৃতি, তার বর্তমান ও ভবিষ্যত স্বার্থ, তার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব (এখানে শ্রেণী সংগ্রাম প্রাসঙ্গিক) এবং বহির্বিশ্বের সাথে প্রতিযোগিতা ও সহজযোগিতার জটিল সম্পর্ক।

বাংলাদেশে দীর্ঘ কয়েক যুগ ধরে মেধাবী লোকেরা মার্ক্সবাদের প্রতি আকৃষ্ট ও আসক্ত হয়ে থাকার কারণে বর্তমান বিশ্ব-পরিস্থিতিতে তারা নির্বোধ নিষ্ক্রিয়তায় পতিত হয়ে মাঝে-মাঝে সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদ বিরোধী ছকে বাঁধা বিবৃতি দিচ্ছেন।

এরা বিশ্ব-পরিস্থিতি বুঝতে পারছে না, কারণ বাস্তব পরিস্থিতির সাথে শ্রেণী সংগ্রামের তত্ত্ব ফিট করছে না। আবার, আদর্শবোধের কারণে, এর বাইরে ভাবতেও পারছে না; ভাবতে গেলে একটা আদর্শচ্যুতির পাপবোধ তাড়া করে।

মাঝে-মাঝে মনে হয়, তাদের জন্যে আমার অনেক কিছু বলার ছিলো, এবং সম্ভবতঃ অনেক কিছু দেওয়ার ছিলো। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ ধর্মীয় মৌলবাদীদের মতোই তারা বিশ্বাসিত ‘আদর্শ’র নামে প্রাপ্ত জ্ঞানের বাইরে কোনো কিছুই শুনতে রাজি নন।

তারা তাদের আদর্শকে ‘সকল বিজ্ঞানের বিজ্ঞান’ হিসেবে বিশ্বাস করে ‘ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে’ একদিন সাম্যবাদ আসবে। আর, সে-আশাতেই তারা বুকে বেঁধে ‘ঈমান’ রক্ষা করে চলেছেন।

কিন্তু সে-‘ঈমান’ও ঠিক রাখা যাচ্ছে না। কয়েক বছর পর-পরই তারা দু’ভাগে ভাগ হয়ে পরস্পরের বিরুদ্ধে ঈমানের দূর্বলতা, ঈমানহীনতা, কিনংবাব বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ এনে নিজেদের শক্তিক্ষয় করে চলছে।

মাজার বিষয় হলো এই যে, তারা তাদের ভাঙ্গনকে মোটেও শক্তিক্ষয় মনে করে না। তারা মনে করে এটি হচ্ছে বিকাশের ‘ক্ষুদ্র হলেও খাঁটি’ হওয়া।


EmoticonEmoticon