চরম দারিদ্র্যতার মধ্যে তাঁর শৈশব কেটেছিলো। সন্ধ্যায় রাস্তার আলোয় তিনি স্কুলের পড়া সারতেন। ঘরে আলো জ্বালানোর মত উপায় ছিল না।
রাস্তার মাইল স্টোন গুণে গুণে তিনি ইংরেজী সংখ্যা শিখেছিলেন ।
অথচ নিজের অধ্যাবসায় দিয়েই তিনি একদিন বিদ্যাসাগর হয়ে উঠেছিলেন । কি বিরাট মাপের হৃদয় ছিলো তাঁর - তা’ ভাষায় বর্ণনা সম্ভব নয় ।
তাঁর কাছে সাহায্য চাইতে গিয়ে কেউ খালি হাতে ফেরেনি কখনও। সেই অষ্টাদশ শতাব্দীতে তিনি অর্থকষ্টে থাকা মাইকেল মধুসূদনের কাছে ১৫০০ টাকা পাঠিয়েছিলেন। সেই সময়ের হিসাবে এর মূল্য যে কি তা’ অনুমান অসাধ্য।
বাঙালীর মুখের ভাষা তাঁর হাতেই পেয়েছে আক্ষরিক স্বরূপ, তাঁর লেখা বর্ণপরিচয় পড়েই বাঙালীর শৈশব আজও বাঙলা বর্ণ শিখে।
মেয়েদের জীবনে শিক্ষা ও সম্মানের আলো দিতে তিনি প্রথম বালিকা স্কুলের উদ্যোগ নেন-, তাঁর হাতেই প্রতিষ্ঠিত হয় অসংখ্য স্কুল । তাঁর নিজের খরচেই অনেক স্কুলের ব্যয়ভার নির্বাহ হতো!
কট্টর সংস্কৃত কলেজের দ্বার জাতিধর্ম নির্বিশেষে সবার জন্যে উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন তিনিই।
শৈশবেই বিধবা হয়ে যাওয়া মেয়েদের দু:খ ঘোচাতে শুধু কলম ধরেন নি, সর্বশক্তি দিয়ে বিধবা বিবাহ চালু করেছিলেন তৎকালীন সমাজের চোখরাঙানি উপেক্ষা করে । যার জন্যে তাঁকে একঘরে করা হয়েছিল । তাও তিনি অম্লানবদনে সহ্য করেছিলেন -মেয়েদের জীবনে আলো দিতেই।
তাঁর মাতৃভক্তি আজও কিংবদন্তী হয়ে আছে । মায়ের আদেশ রক্ষা করতে বর্ষার ভরা নদী দামোদর সাঁতরে বাড়ি যাবার সেই গল্প আমরা সকলেই ছোটবেলায় পড়ে অবাক হয়েছি। মা যে কি মহিমময়ী মানুষ -প্রতিটি মানুষেরই জীবনে তা বুঝতে শিখেছি।
অপরের উপকার করতে গিয়ে নিজে অর্থকষ্টে দিনাতিপাত করেছেন। আবার উপকার যার করেছেন - তার কাছ থেকেই অপমান পেতেও নিত্য অভ্যস্ত ছিলেন । সেসব অপমান উপেক্ষা করেও তাঁর উদার হাত অবারিত রেখেছিলেন।
অভুক্ত মানুষের খিদে না মিটিয়ে চোখ বুজে ঈশ্বর সাধনাকে তিনি অগ্রাহ্য করেছিলেন। সেই দরিদ্র মানুষগুলোর সেবা করাকেই তিনি ঈশ্বর সেবা জেনেছিলেন ।
তাঁর আদর্শের আলোতেই বাঙালী যথার্থ বাঙালী হয়ে ওঠার পথ চিনেছিল ।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ বিনম্র শ্রদ্ধায় তাঁর সম্পর্কে লিখেছিলেন -
"...বিদ্যাসাগর এই বঙ্গদেশে একক ছিলেন। এখানে যেন তাঁহার স্বজাতি-সোদর কেহ ছিল না। এ দেশে তিনি তাঁহার সমযোগ্য সহযোগীর অভাবে আমৃত্যুকাল নির্বাসন ভোগ করিয়া গিয়াছেন।
তিনি সুখী ছিলেন না। তিনি নিজের মধ্যে যে এক অকৃত্রিম মনুষ্যত্ব সর্বদাই অনুভব করিতেন চারি দিকের জনমণ্ডলীর মধ্যে তাহার অভাস দেখিতে পান নাই।
তিনি উপকার করিয়া কৃতঘ্নতা পাইয়াছেন, কার্যকালে সহায়তা প্রাপ্ত হন নাই।
তিনি প্রতিদিন দেখিয়াছেন–আমরা আরম্ভ করি, শেষ করি না; আড়ম্বর করি, কাজ করি না; যাহা অনুষ্ঠান করি তাহা বিশ্বাস করি না; যাহা বিশ্বাস করি তাহা পালন করি না; ভূরিপরিমাণ বাক্যরচনা করিতে পারি, তিলপরিমাণ আত্মত্যাগ করিতে পারি না; আমরা অহংকার দেখাইয়া পরিতৃপ্ত থাকি, যোগ্যতালাভের চেষ্টা করি না; আমরা সকল কাজেই পরের প্রত্যাশা করি, অথচ পরের ত্রুটি লইয়া আকাশ বিদীর্ণ করিতে থাকি; পরের অনুকরণে আমাদের গর্ব, পরের অনুগ্রহে আমাদের সম্মান, পরের চক্ষে ধূলিনিক্ষেপ করিয়া আমাদের পলিটিকস্, এবং নিজের বাক্চাতুর্যে নিজের প্রতি ভক্তিবিহ্বল হইয়া উঠাই আমাদের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য।
এই দুর্বল, ক্ষুদ্র, হৃদয়হীন, কর্মহীন, দাম্ভিক, তার্কিক জাতির প্রতি বিদ্যাসাগরের এক সুগভীর ধিক্কার ছিল।
কারণ, তিনি সর্ববিষয়েই ইহাদের বিপরীত ছিলেন। বৃহৎ বনস্পতি যেমন ক্ষুদ্র বনজঙ্গলের পরিবেষ্টন হইতে ক্রমেই শূন্য আকাশে মস্তক তুলিয়া উঠে বিদ্যাসাগর সেইরূপ বয়োবৃদ্ধি-সহকারে বঙ্গসমাজের সমস্ত অস্বাস্থ্যকর ক্ষুদ্রতাজাল হইতে ক্রমশই শব্দহীন সুদূর নির্জনে উত্থান করিয়াছিলেন, সেখান হইতে তিনি তাপিতকে ছায়া এবং ক্ষুধিতকে ফল দান করিতেন, কিন্তু আমাদের শতসহস্র ক্ষণজীবী সভাসমিতির ঝিল্লিঝংকার হইতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ছিলেন। "
[বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ (বিদ্যাসাগর চরিত)]
বাঙালীর সত্তায় সেই চির প্রণম্য মহামতি বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভেঙেছে নারকীয় উল্লাসে একদল বাঙলারই উন্মত্ত জনতা তাঁর জন্মভূমিতেই ! ওরা কি নিজেকে বাঙালী ভাবে ! বিশ্বাস হয় না !
ছি : !
EmoticonEmoticon