[দু'বছর আগে ঈদ/ইদ বানান বিতর্ক নিয়ে আমি একটি নৌট লিখেছিলাম ফেইসবুকে, যা প্রথম আলোও প্রকাশ করে, কিন্তু তাদের নিজেদের বানান-রীতিতে লেখটি প্রকাশ করে অনেক ক্ষেত্রেই অর্থের বিভ্রাট ঘটায়। তারা আমার লেখার শিরোনামের অন্তর্ভুক্ত 'দীর্ঘস্বরের কী ভাগ্য' স্থলে 'দীর্ঘস্বরের কি ভাগ্য' লিখে কথাটার অর্থই পাল্টে দেয়। যাক, লেখাটি আমি পুনরায় প্রকাশ করছি।]
‘ঈদ’ নয় ‘ইদ’ বানান সঠিক - এই দাবীটির পিছনে যুক্তিটি কী? ‘ঈদ’-এর বিরুদ্ধে ও ‘ইদ’-এর পক্ষে প্রকাশিত একটি লেখা পেলাম ২২শে জুনের ‘প্রথম আলো’তে ‘ঈদ করব না ইদ করব’ শিরোনামে সঙ্কলিত তিনটি নিবন্ধের দ্বিতীয়টিতে, যা লিখেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম। ‘ঈদ’ নয় ‘ইদ’ই টিকে যাবে’ উপ-শিরোনামে তাঁর লেখাটির তিনটি অনুচ্ছেদ, যেখানে তিনি ঈ-বিরোধী যুক্তি তুলে ধরেছেন। আমি মনোযোগের সাথে লেখকের লেখাটি পাঠ করে, তাঁর যুক্তিগুলো বুঝতে চেষ্টা করেছি, যার ভিত্তিতে আমি বর্তমান লেখাটি প্রকাশ করছি।
এক
মোহাম্মদ আজম তাঁর লেখার প্রথম অনুচ্ছেদে ‘ঈদ’ বানানের বিরুদ্ধে এবং ইদ বানানের পক্ষে একটি ঘনীভুত সারসংক্ষপে উপস্থান করেছেন। তাঁর সারসংক্ষেপ নিম্নরূপঃ
“বাংলা বানানের বর্তমান রীতি ও প্রবণতা অনুযায়ী ‘ঈদ’ না লিখে ‘ইদ’ লেখা উচিত। ‘ঈদ’ লেখা যেতে পারে কেবল প্রচলনের অনুরোধে। কোনো যুক্তিতে নয়। যাঁরা এরূপ যুক্তি তালাশ করেন, তাঁরা সাধারণত মূল উচ্চারণের দীর্ঘস্বরের যুক্তি দেখান। এই ‘যুক্তি’তেই একসময় বানানটি প্রচলিত হয়েছিল। কিন্তু এটি আসলে একটি অপযুক্তি। তার কারণ, বাংলায় কোনো নিয়মিত দীর্ঘস্বর না থাকায় আপনি ‘ঈদ’ বা ‘ইদ’ যা-ই লিখেন না কেন, ‘ইদ’ই উচ্চারণ করবেন। যেমন, আপনি বাঙালী/বাঙালি কিংবা গ্রীক/গ্রিক-যা-ই লিখেন না কেন, আসলে বাংলার নিয়মে হ্রস্বস্বরই উচ্চারণ করেন। কাজেই ‘ঈ’ দিয়ে মূল আরবির স্বর বাংলায় উচ্চারণ করানো সম্ভব নয়। যারা দীর্ঘস্বর উচ্চারণ করেন, তারা মূল শব্দটি জানেন বলেই এ রকম উচ্চারণ করেন, বাংলা বানান দেখে নয়।”
প্রথমতঃ তিনি বলেছেন, ‘ঈদ’ শব্দটির মূল উচ্চারণ দীর্ঘস্বরের; আর এ-কারণে এই শব্দটিকে বাংলায় দীর্ঘ-ঈ দিয়ে লিখার যুক্তি প্রচলিত ছিলো। কিন্তু তাঁর মতে সেটি ‘অপযুক্তি’। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগেঃ দীর্ঘস্বরের জন্যে দীর্ঘ স্বরবর্ণের ব্যবহার করার যুক্তি কীকরে ‘অপযুক্তি’ হয়?
স্বরবর্ণ যেহেতু স্বরধ্বনির প্রতীক, দীর্ঘস্বরের উচ্চারণের জন্যে দীর্ঘ স্বরবর্ণ লাগবে, এটিই তো যৌক্তিক। নয় কি? রূপক দিয়ে বললে বলা যায়, দীর্ঘ পায়ের জন্যে যেমন দীর্ঘ পাজামা লাগবে, দীর্ঘ স্বরের জন্যেও তেমনিভাবে দীর্ঘ স্বরবর্ণ লাগবে। খোটো বা হ্রস্ব পাজামায় যেমন দীর্ঘ পা ধারণ করা যায় না, করতে গেলে তা হবে অপচেষ্টা না হলেও ব্যর্থচেষ্টা হতে বাধ্য; তেমনি দীর্ঘস্বর ধারণ করতে দীর্ঘ স্বরবর্ণ লাগবেই। স্পষ্টতঃ মোহাম্মদ আজম দীর্ঘস্বরের সাথে দীর্ঘ স্বরধ্বনির সঠিক ও যৌক্তিক সাযুজ্যের দাবীকে অহেতুক ‘অপযুক্তি’ বলেছেন, যা তাঁর পক্ষ থেকে একটি অযৌক্তিক ভর্ৎসনা বলেই প্রতীয়মান হয়।
দ্বিতীয়তঃ মোহাম্মদ আজম বলেছেন, বাংলায় “নিয়মিত দীর্ঘস্বর” নেই। এই দাবীর দ্বারা তিনি কোনো প্রাকারের অনিয়মিত দীর্ঘস্বরের অস্তিত্ব নির্দেশ করছেন, নাকি দীর্ঘস্বরের পুরো অস্তিত্বই বাতিল করেছেন, তা স্পষ্ট নয়।
বাংলায় যদি দীর্ঘস্বর না-ই থাকবে, এই দীর্ঘ-ঈ, দীর্ঘ-ঊ বর্ণ দু’টি এবং তাদের সংশ্লিষ্ট ঈ-কার ও ঊ-কার দু’টি আছে কেনো? সঠিকভাবে মাতৃভাষায় শিক্ষাপ্রাপ্ত প্রতিটি বাঙালী জানেন যে, হ্রস্ব-ই উচ্চারিত হয় ধ্বনির হ্রস্ব বা ক্ষুদ্র বিস্তারে, আর দীর্ঘ-ঈ উচ্চারিত হয় দীর্ঘ বিস্তারে। একই কথা সত্য হ্রস্ব-উ ও দীর্ঘ-ঊ উচ্চারণের ক্ষেত্রে।
বাংলার এই তথাকথিত দারিদ্রের দাবী মোহাম্মদ আজম শুরু করেননি। এই দাবী সম্ভবতঃ প্রথম করেছেন প্রয়াত ভাষাবিদ অধ্যাপক মুহম্মদ আব্দুল হাই গত শতকের পঞ্চাশের দশকে। মোহাম্মদ আজম সম্ভবতঃ মুহম্মদ আব্দুল হাইয়ের অনুসারী।
কিন্তু, প্রশ্ন হচ্ছে এই দাবী কি সত্য? পরীক্ষা করা যাক। পাঠক, চোখ বন্ধ করে নিজের স্বরযন্ত্রের তৎপরতা উপলব্দি করা চেষ্টা করুন ‘দিকে’ ও ‘ধীরে’ শব্দ দু’টির উচ্চারণে। বুঝতে চেষ্টা করুন আপনার জিভের সরণে ও কানের শ্রুতিতে হ্রস্বস্বর ও দীর্ঘস্বর উপলব্ধিত হয় কিনা।
প্রথম উচ্চারণ করুন ‘দিকে’ শব্দটি। শুরুতেই ‘দ’ উচ্চারণ করতে আপনার জিভের অগ্রভাগ আপনার উপরের পাটির সম্মুখ দাঁতের পশ্চাৎ-মূল স্পর্শ করে। এবার ‘দ’ কে ‘দি’তে সমৃদ্ধ করে ‘কে’ উচ্চারণ করুন সাথেসাথে। লক্ষ করুন, আপনার জিভের অগ্রভাগ ‘দি’ উচ্চারণের পর তার স্বাভাবিক স্থানে ফিরে আসে এবং সাথে-সাথে জিভের মূল থেকে উচ্চারিত ‘ক’র সাথে ‘এ’ ধ্বনি যুক্ত হয়ে ‘কে’ উচ্চারিত হয় এবং আপনি ‘দিকে’ শুনতে পান। ঠিক?
এখন উচ্চারণ করুন ‘ধীরে’ শব্দটি। আবার অনুভব করুন, ‘ধ’ উচ্চারণ করতে আপনাকে জিভের অগ্রভাগ দিয়ে উপরের সম্মুখ দাঁতের পশ্চাৎ-মূল স্পর্শ করতে হচ্ছে। এবার লক্ষ করুনঃ ক্ষুদ্র বিস্তারের ‘ই’ নাকি দীর্ঘ বিস্তারের ‘ঈ’ উচ্চারণ করে উপরের সম্মুখ দাঁতের পশ্চাৎ-মূল থেকে আপনার জিভের অগ্রভাগ দিয়ে তালু স্পর্শ করে ‘রে’ উচ্চারণ করছে। স্পষ্টতঃ ‘ধীরে’ উচ্চারণ করতে জিভ যে-পথ পরিভ্রমণ করে, তা ‘দিকে’ উচ্চারণ-কালে জিভের পরিভ্রমণের চেয়ে দীর্ঘতর। তাই ‘ধীরে’ বানানটি দীর্ঘ ঈ-কার দিয়ে লিখতে হবে।
একই কথা প্রযোজ্য হবে ‘দুই’ ও ‘দূরে’ উচ্চারণের ক্ষেত্রে। ‘দুই’ উচ্চারণে ‘দ’ ব্যঞ্জন ধ্বনির সাথে ‘উ’ স্বরধ্বনি ক্ষুদ্রবিস্তারের বলে, তার বানানে হ্রস্ব উ-কার লাগবে। কিন্তু, ‘দূরে’ উচ্চারণ করতে ‘দ’ ব্যঞ্জন ধ্বনির সাথে দীর্ঘ বিস্তারের ‘ঊ’ স্বরধ্বনি অত্যাবশ্যক বলে বানানে দীর্ঘ ঊ-কার লাগবে। ফলে, এ-দাবী ঠিক নয়, বাস্তব নয় এবং সত্য নয় যে, বাংলাভাষায় দীর্ঘস্বর নেই। বাংলাভাষাতে আলবৎ হ্রস্বস্বরের সাথে দীর্ঘস্বরও আছে। আর, আছে বলেই বাংলা বর্ণমালায় হ্রস্ব-ই ও হ্রস্ব-উ বর্ণের পাশাপাশি দীর্ঘ-ঈ ও দীর্ঘ-ঈ এবং তাদের নিজ-নিজ ই-কার, ঈ-কার, উ-কার ও ঊ-কার আছে।
তৃতীয়তঃ মোহাম্মদ আজম বলেছেন, আপনি বা আমি যদি “ঈদ” উচ্চারণ করতে যাই, সেটি নাকি ‘ইদ’ হয়ে যাবে। কেনো হবে? দীর্ঘস্বরের ‘ঈদ’ উচ্চারণ করতে গেলে, তা হ্রস্বস্বরের ‘ইদ’ হয়ে যাবে কেনো? এর কোনো যুক্তি তিনি দিতে পারেননি। তাঁর কল্পিত আমাদের দীর্ঘস্বরের ‘ঈ’ উচ্চারণের অক্ষমতা হচ্ছে আমাদের ওপর তাঁর অযৌক্তিক দোষারোপ। কারণ, আমি-আপনি-সকলেই দীর্ঘস্বরের ‘ঈ’ ধ্বনি দিয়ে ‘ঈদ’ উচ্চারণ করি, যা মোটেও হ্রস্বস্বরের ‘ইদ’ নয়। এটি সত্য এবং দিবালোকের মতো স্পষ্ট।
মজার বিষয় হচ্ছে, আমাদের ওপর দীর্ঘস্বর উচ্চারণের অক্ষমতার দোষারোপ মোহাম্মদ আজম তাঁর লেখার একই অনুচ্ছেদে নিজেই বাতিল করে বলেছেন, যারা দীর্ঘস্বরের ‘ঈদ’ উচ্চারণ করেন, তারা নাকি মূল শব্দটি জানেন বলেই, তা দীর্ঘস্বরে উচ্চারণ করেন। তিনি এখানে মূল শব্দ বলতে আরবি শব্দ বুঝিয়েছেন।
অর্থাৎ, তিনি প্রথমে বলেছেন আমরা ‘ঈদ’ উচ্চারণ করতে চাইলে, তা ‘ইদ’ উচ্চারণ করে ফেলবো; আবার পরক্ষণেই স্ববিরোধিতা করে বলেছেন, যারা মূল আরবি শব্দটি জানেন, তারা ঈদ উচ্চারণ করতে পারবেন। এটি হচ্ছে স্ববিরোধিতা, যেখানে পরস্পর-বিরোধী দাবী দু’টি পরস্পরকে বাতিল করে দেয়।
চতুর্থতঃ ‘যুক্তি’র এই পর্যায়ে, আজম শুধু স্ববিরোধিতাই করেননি, তিনি তাঁর উপসংহার টেনেছেন এই ধারণার ওপর ভিত্তি করে যে, যারা দীর্ঘস্বরের ঈদ উচ্চারণ করেন (আমি মনে করি সবাই করেন), তারা সবাই মূল শব্দটি – অর্থাৎ আরবি শব্দটি - জানেন। এই কথার অর্থ হচ্ছে এই যে, যারা দীর্ঘস্বরের ‘ঈদ’ উচ্চারণ করেন, তারা বাংলায় ঈদ শেখার আগে আরবিতে দীর্ঘস্বরের ঈদ উচ্চারণ শেখেন, এবং এই কারণে তারা বাংলায় ‘ঈদ’ দেখলে তাকে দীর্ঘস্বরে পড়েন, নইলে তারা দীর্ঘ-ঈ দিয়ে লেখা ‘ঈদ’কে ‘ইদ’ পড়তেন।
মোহাম্মদ আজমের তত্ত্ব যদি ঠিক হয় এবং আমরা যদি ধরে নিই যে, বাঙালী মুসলমান মাত্রই আরবি স্বরধ্বনির সাথে পরিচিত, আমরা এই হাইপোথেসিস বা প্রকল্প গঠন করে পূর্বোক্তি করতে পারি যে, বাঙালী হিন্দুদেরকে “ঈদ” পড়তে দিলে, তারা ‘ইদ’ পড়বেন, কিন্তু এর বিপরীতে মুসলমানেরা ‘ঈদ’কে ‘ঈদ’ই পড়বেন।
অবশ্য, আমার ধারণা, উপরের প্রকল্প ভুল প্রমাণিত হবে; দেখা যাবে, হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষ সকলেই ‘ঈদ’কে দীর্ঘস্বরে ‘ঈদ’ই পড়বেন। লক্ষ করছি, হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষ প্রায় সকল বাঙালীই ‘ঈদ’-এর পক্ষে ও ‘ইদ’-এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন।
দুই
“কিন্তু বহু দশক ধরে, বিশেষত আমাদের ছাপা হরফের ব্যাপক প্রচলনের সময়জুড়ে, আমরা ‘ঈদ’ই লিখে আসছি। এর একটা ইতিহাস আছে। সেটা মনে করিয়ে দেওয়া সম্ভবত কাজের হবে। উনিশ-বিশ শতকে যাঁরা সংস্কৃতের অনুসরণে বাংলা বানানরীতি নির্ধারণ করেছিলেন, তাঁরা এমন বহু শব্দেও ‘ঈ’ লিখছিলেন, যেগুলো তৎসম শব্দ নয়। ফলে বিশৃঙ্খলা বাড়ছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরোক্ষ নেতৃত্বে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বানান কমিটি এ ব্যাপারে একটি ফয়সালা করেছিল। সেটা এ রকম : তৎসম শব্দের বানানে সংস্কৃত নিয়ম অনুযায়ী ‘ঈ’ লেখা হবে, কিন্তু অ-তৎসম শব্দের বানানে ‘ঈ’ চলবে না। এ নিয়ম তখন থেকে মোটের ওপর কার্যকর আছে। কিন্তু বিশ শতকের তৃতীয় বা চতুর্থ দশক থেকে ‘মুসলমানপক্ষ’ বলা শুরু করে, যদি সংস্কৃতসম শব্দগুলো ‘মূল’ বানান অনুযায়ী লেখা হতে পারে, তাহলে আরবিসম বা ফারসিসম শব্দগুলো কেন নয়? এ যুক্তিতেই আসলে প্রচুর ‘মুসলমানি’ শব্দে ‘ঈ’, ‘য’ ইত্যাদি লেখা হয়েছিল। কিন্তু আগেই বলেছি, এটি অপযুক্তি মাত্র। কারণ, কোনো ঋণ-করা শব্দই হুবহু ভাষায় আসে না, ঋণী ভাষার ধ্বনিতত্ত্ব মেনেই গৃহীত হয়। ফলে ‘ঈদ’ সংস্কারপন্থীদের দুর্বল সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় প্রস্তুত অনুকরণমূলক বানানমাত্র।”
উপরে উদ্ধৃত পাঠটি হচ্ছে মোহাম্মদ আজমের লেখার দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ, যেখানে তিনি প্রথমে বাংলা বানান সংস্কারে প্রবর্তিত নতুন বিধির কথা বলেছেন, এবং সেই সাথে তৎসম শব্দের বানান বিধির সাথে সাম্য রক্ষা করে ‘আরবিসম’ ও ‘ফারসিসম’ শব্দের বানানে মূল উচ্চারণ রক্ষার দাবীকে নাকচ করেছেন। আমি নিচে কয়েকটি অনুচ্ছদে এবিষয়ে তর্ক তুলবো।
প্রথমতঃ রবীন্দ্রনাথের পরোক্ষ নেতৃত্বেই হোক, কিংবা প্রত্যক্ষ নেতৃত্বেই হোক, ‘কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বানান কমিটি’ যে বিধানই দিয়ে থাকুক, তার যুক্তি থাকা চাই। আমি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বানান কমিটি প্রণীত ও আরোপিত বিধি নিয়ে নিশ্চয় প্রশ্ন করার অধিকার রাখি।
ভালো কথা যে, তারা বিধান দিয়েছেন বাংলায় তৎসম – অর্থাৎ সংস্কৃত – শব্দের বানান তাদের উচ্চারণের দীর্ঘস্বর অনুযায়ী দীর্ঘ স্বরবর্ণ বা দীর্ঘ কার দিয়ে লিখা হবে। স্পষ্টতঃ এই নীতি হচ্ছে ফোনিম বা ধ্বনির সাথে গ্রামিফ বা বর্ণের সাযুজ্য নিশ্চিতিকরণের যৌক্তিক বিধান। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই ন্যায্য বিধান তৎসম বা সংস্কৃত শব্দের বেলায় প্রযোজ্য হলে, অন্যান্য ভাষা থেকে আগত শব্দের বানানে অনুসৃত হবে না কেনো? কী যুক্তি আছে এখানে? কী নীতি আছে এখানে?
যারা বানানের বিধান বলে বানান শাসন করতে চান, তাদের বিধানের প্রতিই আমাদের প্রশ্নঃ বিধানের যৌক্তিকতা, বৈজ্ঞানিকতা ও বৈধতা কী? আগে বিধানকে ভাষাবৈজ্ঞানিক যুক্তি দিয়ে সিদ্ধ করে বৈধ হতে হবে, তার পর সেই বিধানের উল্লেখ করে বানানের সঠিকতা-বেঠিকতা নিয়ে বিচার করা যাবে। তার আগে পর্যন্ত, শব্দের উচ্চারণ ও লিখনের মধ্যে সযুজ্য রক্ষা করেই ভাষার পঠন-লিখন করতে হবে।
গায়ের জোরে বলা যেতে পারেঃ বাংলাদেশে ভারতীয় নাগরিক ছাড়া অন্য কোনো বিদেশী নাগরিক বাস করতে চান, তাদের দীর্ঘ চুল রাখা চলবে না, চুল কেটে হ্রস্ব করতে হবে; কিন্তু তা যৌক্তিক বা নৈতিক হবে না। একইভাবে সংস্কারবাদীদের শুধু তৎসম শব্দ ছাড়া অন্য বিদেশী শব্দের বানান বাংলায় লিখতে হলে দীর্ঘস্বরে লিখা যাবে না, হ্রস্বস্বরে লিখতে হবে বলেই হবে না। এখানে ভাষাতাত্ত্বিক বৈজ্ঞানিক যুক্তি দিতে হবে। আর, মোহাম্মদ আজমের কথিত “মুসলমান পক্ষ” যদি তৎসম শব্দের স্বরধ্বনি বাংলা বানানে অক্ষুণ্নতার রাখার বিধির সম্প্রসারণ ‘আরবিসম’ ও ‘ফার্সিসম’ কিংবা ‘ইংরেজিসম’ শব্দের ক্ষেত্র দাবী করে থাকেন, তাকে অপযুক্তি বলা কার্যতঃ রেগে গিয়ে হিংসাবশে গাল দেওয়ারই নামান্তর।
তিন
“আজ যে অনেকে ‘ইদ’ বানানে শব্দটি লিখতে চাচ্ছেন, তার কারণ, বাংলা বানানের রীতি ও বিধি ক্রমশ অধিক হারে ‘ই’ এবং ‘ই-কারে’র দিকে চলছে। বাংলা বানানের প্রতিষ্ঠিত বিধিগুলো, যেগুলো দিয়ে আমরা আর দশ বানান লিখে থাকি, সেগুলো ‘ইদ’ বানানের পক্ষেই। কিন্তু বানানের ক্ষেত্রে ‘প্রচলন’ নিয়মের মতোই শক্তিশালী। সে কারণেই যাঁরা দুই বানানের একটিকে ‘ভুল’ বলে সাব্যস্ত করছেন, তাঁরা ঠিক কাজ করছেন না। বলা দরকার, এটি বা ওটি অধিকতর গ্রহণযোগ্য। লেখার বাজারে দুটিই আরও কিছুদিন একত্রে থাকবে। অভিধানে অবশ্য প্রাধান্য পাবে ‘ইদ’ বানানটি। সঙ্গে দ্বিতীয় ভুক্তি হিসেবে থাকতে পারে ‘ঈদ’। কিন্তু পাঠ্যপুস্তকে লিখতে হবে ‘ইদ’। তা না হলে বানানের প্রচলিত নিয়মের সঙ্গে বিরোধ তৈরি হবে। দু-এক প্রজন্ম পরেই এ বানান নিয়ে কেউ আর কথা তুলবে না, যেমন ঘটেছে আরও বহু বাংলা বানানের ক্ষেত্রে।”
মোহাম্মদ আজম তাঁর লেখার তৃতীয় ও শেষ অনুচ্ছেদে রীতি ও বিধি কথা বলেছেন এবং ভবিষ্যতবাণী করেছে ঈদের বিলীন ও ইদের টিকে থাকা নির্দেশ করে। আমি তাঁর ভবিষ্যতবাণী নিয়ে কথা বলতে চাই না; কারণ ভবিষ্যতবাণীর ভুল বা সঠিকতা ভবিষ্যত ছাড়া আর কেউ প্রমাণ করতে পারে না। আমি বরং তার উল্লেখিত রীতি ও বিধির ওপরই আলোকপাত করবো।
রীতি ও বিধির মধ্যে পার্থক্য আছে। রীতি হচ্ছে আচরণের কনভেশন বা প্রথা; আর বিধি হচ্ছে শাসনের কনষ্টিটিউশন বা আইন। এটি ঠিক যে, নির্বাহী ক্ষমতার জোরে একটি বিধি বহুকাল বহাল থাকলে তা বিকৃত রীতি হিসেবে গৃহীত হয়ে যেতে পারে।
বিধি তৈরি করার ক্ষমতা যাদের হাতে, তাঁরা যদি রীতির স্বরূপ উপলব্ধি করার মতো যোগ্য না হন, তারা যদি বিধি পেছেন যুক্তির প্রয়োজনীয়তা বুঝতে অক্ষম কিংবা অনিচ্ছুক হন, তাদের প্রণীত বিধি মানুষ স্বাভাবিকভাবে আচরণের পর্যায়ে রীতি হিসেবে গ্রহণযোগ্য হয় না। কিন্তু, কোনো বিধি যদি জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়, আচরণে পর্যায়ে শৃঙ্খলার পরিবর্তে অধিকতর বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে।
আমি দ্বিতীয় অনুচ্ছেদের ব্যবচ্ছেদে বাংলার তথাকথিত নতুন বানান বিধির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেছি। এখানে আমি দেখাতে চাই, এই বিধি কীরূপে প্রকৃতি-বিরোধী। লেখার দৈর্ঘ্য সীমিত রাখার প্রয়োজনে আমি বিদেশী শব্দের বাংলা বানানে ঈ-কার ও মূর্ধন্য-ণ ব্যবহার না-করার বিধির ওপর আমার আলোকপাত সীমিত রাখবো।
বিদেশী ভাষার সাথে বাংলাভাষীদের সংযোগ ও আদানপ্রদান বিপুল পরিসরে বৃদ্ধি পেয়েছে। জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে ভিন্নভাষীদের সাথে বাঙালীর আদান-প্রদান হচ্ছে খোদ বাংলাদেশে বাস করেই। ফলে, বিদেশী শব্দের যতোটুকু সম্ভব সঠিক উচ্চারণ শুধু সৌজন্যতার কারণেই নয়, কার্যকর ও ফলপ্রসূ যোগাযোগের জন্যে অনিবার্য হয়ে পড়েছে।
আপনি বাংলাদেশে এই বিধি শিখেছেন যে, বিদেশী শব্দে দীর্ঘস্বর (ee = ঈ) থাকলেও, বাংলায় তাকে হ্রস্বস্বরে (i = ই) লিখতে হবে। প্রথমতঃ এটি তাৎক্ষণিকভাবে, ভাষাতাত্ত্বিক ফোনিম-গ্রাফিম বা ধ্বনি-বর্ণের মধ্যে প্রত্যাশিত স্বাভাবিক সাযুজ্যের পরিপন্থী। আপনি আপনার প্রয়োজনে ব্যবহৃত ধার করা শব্দকে তার ধ্বনিগত বৈশিষ্ট্য থেকে বঞ্চিত করতে পারেন না, যদি আপনার নিজ ধ্বনি ভাণ্ডারে সেই ধ্বনি থেকে থাকে। অধিকন্তু, আপনি যে সংস্কৃত শব্দের বেলায় তাদের ধ্বনিগত বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ণ রেখে অন্যান্য ভাষার শব্দকে বঞ্চিত করছে, তা হচ্ছে অনেকটা বর্ণবাদের মতো বৈষম্যবাদ।
উপরের ব্যাখ্যাত নীতিগত অসুবিধা ছাড়াও কতিপয় ব্যবহারিক অসুবিধার সৃষ্টি করে নতুন বানান-রীতির এই বৈষম্যবাদ। বিষয়টি ব্যাখ্যার জন্যে একটি সম্ভাব্য বাস্তব পরিস্থিতির বিবরণ দিচ্ছি।
আজকাল নাগরিক বাঙালীদের অনেকেই বিছানাকে ‘বেড’ (bed) ও বিছানার চাদরকে ‘বেড-শীট’ (bed-sheet) বলছেন। বাংলা বানানার রীতি অনুযায়ী ধ্বনির সাথে বর্ণের সাযুজ্য অনুসারে ‘bed-sheet’-এর বাংলা বানান হবে ‘বেড-শীট’। কিন্তু বাংলা বানানের তথাকথিত নতুন বিধি অনুসরণ করলে, লিখতে হবে ‘বেড-শিট’। এখানে আপনি বুঝতে চাইলেন না, যে ইংরজীতে ‘শিট’ (shit) মানে হচ্ছে প্রাণীর মল বা বিষ্ঠা।
তো, বিদেশী শব্দের প্রতি বাংলা বানান বিধির স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের ফলে আপনি ‘bed-sheet’ লিখতে ও বলতে গিয়ে শিখলেন বেড-শিট (bed-shit)। অর্থাৎ, বিছানার চাদরকে আপনি ইংরেজীতে ‘বিছানার গু’ বলতে শিখে শিক্ষিত হলেন! এহেন শিক্ষিত আপনি যখন বিদেশে গিয়ে বিছানায় চাদর পেতে দেওয়ার উদ্দেশে বিছানায় শিট (shit) বিছিয়ে দিতে বলবেন, তখন কী পরিস্থতি হবে? কিংবা, কী ভাববেন আপনার বন্ধু, যাঁকে আপনি ভালোবেসে বাংলার নকশী কাঁথা, অর্থাৎ একটি শিল্পকর্মকৃত চাদর, অর্থাৎ ‘আর্ট-ওয়ার্কড বেড-শিট’ উপহার দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন? তিনি আপনার ‘আর্ট-ওয়ার্কড বেড-শিট’ উপহারকে কিন্তু ‘শিল্পকর্মকৃত বিষ্ঠা’ উপহার দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ হিসেবেই শুনবেন। ভাবুন, কী বুঝাতে চেয়ে আপনি কী বুঝাবেন!
আমার কথা হচ্ছে, আমাদের বর্ণমালা যেখানে আমাদেরকে রীতি মেনে ‘শীট’ (sheet = চাদর) লিখতে ও বলতে দিচ্ছে, আমরা কেনো নির্বোধ বিধির স্বৈরশাসনে সেখানে ‘শিট’ (shit = গু) বলে বিভ্রাট তৈরি করবো? এই বিধির কোনো অর্থ আছে?
আমি বহু লোকের কাছে বহুবার শুনেছি বিদেশী শব্দের বাংলা বানানে মূর্ধন্য-ণ ব্যবহার করা যাবে না। কিন্তু কেনো? বর্ণ যদি ধ্বনির প্রতীক হয়, আর শব্দের উচ্চারণে যদি ‘ণ’ থাকে, কেনো তার বানানে ‘ণ’ লিখা যাবে না? আমি একাধিকবার একাধিক লেখায় দেখিয়েছি যে, কোনো মানুষের পক্ষে ন+ড উচ্চারণ করা সম্ভব নয়।
দন্ত্য-ন উচ্চারণের পর ত, থ, দ, ধ উচ্চারণ করা সম্ভব; কিন্তু ট-ঠ-ড-ঢ উচ্চারণ করা সম্ভব নয়। দাঁতের পশ্চাৎমূল থেকে দন্ত্য-ন উচ্চারণ করে ড উচ্চারণ করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। করতে গেলেই প্রাকৃতিক নিয়মে তা ‘ন্ত’ হয়ে যাবে। তাই, ‘ড’ উচ্চারণ অক্ষুণ্ণ রাখতে হলে দন্ত্য-ন নয়, বরং মূর্ধন্য-ণ যুক্ত করে ণ+ড=ণ্ড উচ্চারণ করতে হবে। আর, সে-কারণেই বাংলা বর্ণমালায় ট-ঠ-ড-ঢ-ণ এক বর্গভুক্ত এবং ত-থ-দ-ধ-ন অন্য বর্গভুক্ত।
বাংলায় যারা বিধি তৈরি করে বলেছেন বিদেশী শব্দের বাংলা বানানে ‘ণ’ করা যাবে না, তারা মূলতঃ বাংলা ধ্বনির সংযুক্তির প্রাকৃতিক বিধিই বুঝতে পারেননি। তাই তাঁরা ‘লণ্ডন’ স্থলে ‘লন্ডন’ লিখেন, ‘ইংল্যাণ্ড’ স্থলে ‘ইংল্যান্ড’ লিখেন, যার উচ্চারণ তার নিজেরাই করতে অক্ষম। আমি আবার বলছি, শব্দ দেশী হোক বা বিদেশীই হোক, তার বাংলা বানান উচ্চারণযোগ্য হওয়া চাই। বাংলায় ন+ড=ন্ড উচ্চারণযোগ্য নয় – কোনো মানুষের পক্ষেই নয়; লিখতে হবে ণ+ড=ণ্ড, যা অনায়াসে উচ্চারণযোগ্য।
উপসংহার
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বানান-বিধির কর্তারা বাংলাভাষা থেকে সংস্কৃত ভাষার প্রতি সুবিচার করতে গিয়ে অন্য ভাষার প্রতি বিচার-বোধ হারিয়ে কতিপয় অযৌক্তিক, অবৈজ্ঞানিক ও স্বৈরতান্ত্রিক বিধি তৈরি করে বাংলাভাষার ওপর দুঃশাসন প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আর, তাদের এই দুঃশাসনের সাম্প্রতিকতম শিকার হচ্ছে ঈদ, যাকে তারা ইদ করতে চাইছে।
বিদেশী শব্দের বাংলা বানানকে দীর্ঘস্বর বঞ্চিত করার পরিণতি কি আমারদেরকেই ভয়াবহভাবে বহন করতে হচ্ছে না? এটি কি নিজের নাক কেটে পরের যাত্রাভঙ্গের উদাহরণ নয়? পরের যাত্রাভঙ্গে হয়তো নিজের প্রত্যক্ষ অসুবিধা নেই; কিন্তু নিজের নাক কাটায় নিশ্চয় অসুবিধা আছে।
অর্থাৎ, আমি বলতে চাইছি, বিদেশী শব্দের বানানে দীর্ঘস্বর অস্বীকার করার যুক্তি হিসেবে যে-সকল পণ্ডিত বাংলায় দীর্ঘস্বর নেই বলে ভেবে নিয়ে ‘বাঙালী’কে ‘বাঙালি’ থেকে শুরু করে, সর্বসম্প্রতি ‘ঈদ’কে ‘ইদ’ করতে চাইছেন, তারা মূলতঃ বাংলাভাষার ওপর ধ্বনি-দারিদ্র আরোপ করছেন। আমার আশঙ্কার বিষয় এটিই।
EmoticonEmoticon