রবিবার, ৯ জুন, ২০১৯

বাঙালী মুসলমানের পশ্চাৎপদতাঃ সেনগুপ্ত ও হাণ্টারের ভাষ্য

বিশ্বের ইতিহাসে 'বাঙ্গালা' নামের প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন শামসুদ্দিন ইয়াসয়াস শাহ ১৩৪২-১৩৫২ খ্রিষ্টাব্দে দিল্লির কেন্দ্রীয় মুসলিম সাম্রাজ্যিক শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। সকল ইতিহাসবিদের মতো বাঙালী ইতিহাসবিদ নীতিশ সেনগুপ্তও বলেন,  সে-সময় থেকেই বাঙালী জাতি আত্মপরিচয় ও বাংলাভাষার রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে।

আজ যে-বাঙলী মুসলমান বাঙালীত্বকে 'হিন্দুয়ানী' বলে অস্বীকার করতে চায়, তারা তাদের ঐতিহাসিক অজ্ঞতার কারণে জানে না যে, বাঙালীত্ব আসলে হিন্দুর নয় বরং মুসলমানের অবদান। আদিতে মুসলমানেরা বাঙালীত্বকে প্রমৌট করতো। তাই, ‘বাঙ্গালা সালতানাৎ’ নামে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ নিজেকে ‘সুলতান-ই-বাঙ্গালা’ বলে ঘোষণা করেন। তিনি ও তাঁর পরবর্তী সুলতানগণ নিজদেরকে বাঙালী বলেই প্রতিষ্ঠিত করেন।

যারা বলেন, সুলতানেরা বহিরাগত মুসলমান, তারা এটি জানেন না বা জানলেও বলেন না যে, তাদের আগে বাংলায় প্রতিষ্ঠিত সেন সাম্রাজ্যের সেন শাসকগণ ছিলেন বহিরাগত হিন্দু, যারা বাঙালী বৌদ্ধ পাল-সাম্রাজ্যকে পরাস্ত করে বাংলাকে প্রায়-বৌদ্ধশূন্য করে দু’শো বছর শাসন করার পর নিজেরাই বহিরাগত মুসলমানদের কাছে পরাস্ত হয়।

হিন্দু বর্ণবাদী সেন সাম্রাজ্যের পতনের পর বাংলার নিপীড়িত মানুষ তত্ত্বগত ও আইনতঃ সমান মর্য্যাদা পাওয়ার যৌক্তিক লক্ষ্যে ব্যাপক হারে মুসলমান হয়।  হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্ম থেকে মুসলমান হওয়া বাঙালী তখন থেকে তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাতে শুরু করে। সন্দেহ নেই যে, তার পেছেন রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য ছিলো।

সাধারণভাবে, ১২০৪ থেকে ১৭৫৭ সাল পর্যন্ত বাংলায় মসুলিম শাসন থাকার কারণে বাঙালী মসুলমানেরা হিন্দুদের চেয়ে অনেক এগিয়ে যায় শিক্ষা-সংস্কৃতি, জ্ঞান-গরিমায়, বিষয়-বিত্তে ও প্রভাব-প্রতিপত্তিতে। কিন্তু ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরজয়ের পর বাংলার শাসন-ক্ষমতা কার্যতঃ ব্রিটিশদের হাতে চলে আসে, এবং ১৮৭৫ সালে তা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অংশ হয় যায়, যা সমাপ্তি ঘটে ১৯৪৭ সালে ভারতের সাথে-সাথে বাংলার বিভক্তির মধ্যে দিয়ে।

বাংলার মসুলমানদের অবস্থার অবনতি ঘটে ১৭৫৭ থেকে ১৯৪৭ সালের মধ্যে। তার আগে বাংলার মুসলমানের অবস্থা কী ছিলো? সে-কথা পাঠকদের জানাতে আমার আজকের এই লেখা। আশাকরি পাঠক ধৈর্য্য ধরে পড়বেন।

বাংলায় মসুলমানদের পশ্চাৎপদতা ব্রিটিশ আমলের ঘটনা। ব্রিটিশদের কাছে ক্ষমতা হারানোর পর বাংলার মুসলমান ভারতের অন্যান্য মুসলমান সম্প্রদায়ের চেয়ে বেশি ক্ষুব্ধ ও অভিমানী ছিলো, এবং সে-কারণে বেশি ব্রিটিশ-বিরোধী ছিলো। মুসলমানদের তুলনায় হিন্দুর অবস্থা কী ছিলো, তা পাঠ করুন বাঙালী হিন্দু ঐতিহাসিক নীতিশ সেনগুপ্তের লেখায়।

বাঙালী ইতিহাসবিদ নীতিশ সেনগুপ্ত তাঁর বিখ্যাত 'The History of Bengali Speaking People' গ্রন্থে একত্রিশ নম্বর অধ্যায়ের শিরোনাম দিয়েছেন 'Beginning of Muslim Separatism: The Unmaking of a Nation', যা তিনি শুরু করেছেন নিম্নলিখিতভাবেঃ

"The roots of Muslim separatism in Bengal lay in the near-wholesale political, economic, social and educational downgrading that the Bengal Muslim suffered on the advent of the British rule. Not only did they lose political power and the privileges and patronage that went with it, but the 1793 Permanent Settlement drastically reduced the number of Muslim zamindars and other large landholders. Without much exposure to commerce historically, the Muslims in Bengal could not take advantage of the economic opportunities the era offered. Inherently suspicious and conservative, they also denied themselves the new English education, thereby leaving the stage free for the Hindu Bengalees who dominated in government jobs and professions like law, medicine, and teaching,. Slowly they withdrew themselves into the cocoon having little to do with the British and with things modern. Interestingly, Muslims in other parts of the country, including Bihar, did not quite share this experience. Nowhere else in the subcontinent were Muslim as worse off as in Bengal just as, paradoxically, few other communities derived as much benefit from the British rule as the Bengali Hindus."

অর্থাৎ, “বাংলা মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবাদের শেকড় প্রোথিত রয়েছে ব্রিটিশ শাসনের আগমে বাংলা মুসলমানদের প্রায়-পাইকারিভাবে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও শৈক্ষিক অধঃগমন। তারা শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতা, সুবিধা ও পৃষ্ঠপোষকতা হারায়নি, ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত [আইন] মুসলমান জমিদার ও ভূস্বামীদের সংখ্যা কঠোরভাবে কমিয়ে আনে। ঐতিহাসিকভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রতি ততো উন্মুক্ত না-থাকা বাংলার মুসলমানেরা নতুন যুগের আনীত অর্থনৈতিক সুযোগ-সমূহের কোনো সুবিধা নিতে পারেনি। ঐতিহ্যগতভাবে সন্দিগ্ধ ও রক্ষণশীল মুসলমানেরা নিজেদেরকে নতুন ইংরেজী শিক্ষা থেকে দূরে রাখার মধ্য দিয়ে মঞ্চ ছেড়ে দেয় হিন্দু বাঙালীদের জন্যে, যারা সরকারী চাকুরি এবং আইন, চিকিৎসা ও শিক্ষকতার মতো পেশাগুলোতে প্রাধান্যে চলে আসে। তারা ধীরে-ধীরে নিজেদেরকে প্রত্যাহার করে ব্রিটিশ ও আধুনিক বিষয়াদির সাথে সংস্রবহীন একটি গুটির মধ্যে গুটিয়ে আনে। মজার বিষয় হলো, বিহার-সহ দেশের [ভারত] অন্যান্য অংশে মুসলমানেরা [বাংলার মুসলমানদের] এই অভিজ্ঞতার শরিক হয়নি। [ভারতীয়] উপমহাদেশের অন্য কোথাও মুসলমানেরা বাংলার মুসলমানদের মতো এতো দুরবস্থায় ছিলো না, এবং বিপরীতক্রমে বাঙালী হিন্দুর মতো [ভারতে] কম সম্প্রদায়ই আছে যারা ব্রিটিশ শাসন থেকে এতো বেশি সুবিধা ভোগ করেছে।”

নীতিশ সেনগুপ্ত তাঁর দাবীর পক্ষে ১৮৭০ সালে ব্রিটিশ বেসামরিক ব্যক্তি স্যার উইলিয়াম হাণ্টারের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘Indian Musalman’ গ্রন্থ থেকে নিম্নলিখিত উদ্ধৃতি দিয়েছেনঃ 

“My remarks apply only to lower Bengal, the province with which I am best acquainted and in which so far as I can learn, the Muhammadans have suffered most severely under British rule. I should be sorry to believe or to convey to the readers the belief that the flowing remarks were predictable of all the Muhammadans of India. If ever a people stood in need of a career, it is the Muslim aristocracy of Bengal. The administration of the imperial taxes was the first source of income in Bengal and the Musalman aristocracy monopolised it. The police was another great source of income and the police was officered by Muhammadans. The courts of law were a third great source of income and the Musalmans monopolised them. Above all there was the army, an army not officered by gentlemen who make little more than bank interest on the price of their commission, but a great confederation of conquerors who enrolled their peasantry into troops, and drew pay from the state for them as soldiers. A hundred and seventy years ago, it was almost impossible for a well-born Muslim in Bengal to become poor. At present it is almost impossible for him to be continue to rich.”

অর্থাৎ, “আমার মন্তব্য প্রযোজ্য শুধু নিম্ন বাংলায়, যে প্রদেশটির সাথে আমি সবচেয়ে বেশি পরিচিত এবং যেখান আমি এ-পর্যন্ত জেনেছি, ব্রিটিশ শাসনের অধীনে মুসলমানেরা ভূগেছে সবচেয়ে সাংঘাতিকভাবে। আমি ক্ষমাপ্রার্থী হবো, যদি আমি এই প্রত্যয় গঠন করি কিংবা এই বিশ্বাস পাঠকের কাছে পৌঁছাই যে, [আমার] নিম্নলিখিত মন্তব্য ভারতের সকল মুসলমানের ক্ষেত্রেও সম্ভব। কখনও পেশার প্রয়োজনে যদি কোনো জাতি এগিয়ে এসে থাকে, সে হচ্ছে বাংলার মুসলমান সম্প্রদায়। বাংলায় প্রথম আয়ের উৎস ছিলো সাম্রাজ্যিক কর উত্তোলন পরিচালনা এবং এতে একাধিপত্য ছিলো মুসলমান অভিজাতদের। অন্য আরেকটি বিশাল আয়ের উৎস ছিলো পুলিস [আইন শৃঙ্খলা] এবং পুলিসের কর্মকর্তারা ছিলো মুসলমান। আইনের আদলতগুলো ছিলো বিশাল আয়ের তৃতীয় উৎস এবং এতে মুসলমানদের ছিলো একাধিপত্য। সর্বোপরি, সেখানে ছিলো সেনাবাহিনী, যেটি এমন একটি সেনাবাহিনী নয় যার অফিসারগণ ছিলো তাদের কমিশনের মূল্যের ওপর ব্যাঙ্কের সুদের হারের চেয়ে স্বল্প লভ্যাংশভোগী ভদ্রলোক, বরং সেটি ছিলো দিগ্ববিজয়ীদের একটি যৌথ সংস্থা যাঁরা সেনা সংগ্রহ করতেন কৃষকদের মধ্য থেকে এবং বেতন সংগ্রহ করতেন সৈনিক হিসেবে রাষ্ট্র থেকে। একশো সত্তর বছর আগে [১৮৭০ থেকে] বাংলায় কোনো সুজাত মুসলমানের পক্ষে দরিদ্র হওয়া ছিলো অসম্ভব-প্রায়। বর্তমানে [১৮৭০ সালে] তাঁর পক্ষে বিত্তশালী থাকা প্রায় অসম্ভব।” 


EmoticonEmoticon