মঙ্গলবার, ২৯ আগস্ট, ২০১৭

আরাকানে বাঙালি উপনিবেশঃ অভিবাসনের চার স্রোত !

সমগ্র বাংলাকে নিয়ে 'বাঙ্গালা' নামের সালতানাৎ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো ১৩৫২ সালে দিল্লির কেন্দ্রীয় তুর্কী শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। বাঙ্গালা রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আফগান বংশোদ্ভূত শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ।

শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ ও তাঁর পরবর্তী সুলতানেরা নিজেদেরকে সুলতান-ই-বাঙালা বলে পরিচয় দিতেন। তখন থেকেই বাঙ্গালী একটি রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে বিকশিত ও পরিচিত হতে থাকে। সুলতানী আমলেই বাংলাভাষা রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও মর্য্যাদা লাভ করে।

বাংলার সুলতানী শাসনের মাঝে দু'বার রাজা গণেশ ক্ষমতায় আসেন। তাঁর পুত্র ইসলামে দীক্ষিত হয়ে সুলতান জালাল উদ্দিন নাম ধারণ করেন এবং তিনি ১৪০৪ সালে রাখাইন বা আরাকানের বিতাড়িত রাজা মিন সাউ মন ওরফে নারামীখলাকে বাঙ্গালায় আশ্রয় ও সামরিক চাকুরি দেন।

১৪৩০ সালে সুলতান জালাল উদ্দিন এক সামরিক অভিযানের মাধ্যমে রাজা নারামীখলাকে আরাকান রাজ্য পুনরুদ্ধার করে দেন। তখন থেকে আরকান বাঙ্গালার একটি করদ-রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং পরবর্তীতে ম্রুয়াক-উ রাজ্য নাম ধারণ করে।

রাজা নারামীখলা বৌদ্ধ হলেও বাঙ্গালার প্রথা অনুসারে সুলেইমান শাহ নাম ধারণ করে। তাঁর সময়েই প্রথম ম্রুয়াক-উ বা আরাকানে বাঙ্গালা থেকে প্রথমবারের মতো বিশাল সংখ্যক অভিবাসন ঘটে, যারা তখন আরাকানকে একটি শক্তিশালী রাজ্য হিসেবে গড়ে উঠতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলো। আর তখন থেকেই আরাকানের সাথে বাঙ্গালা ও বাঙ্গালীর সংযোগের লিপিবদ্ধ ইতিহাসের শুরু।

বাঙ্গালা ও বাঙ্গালীর দুর্ভাগ্য ডেকে আনে বাঙ্গালা-সুলতানাৎয়ের ক্রমঃদুর্বলতা ও পতন এবং শেষপর্যন্ত দিল্লির মুঘলদের কাছে স্বাধীনতা হারানো। বাঙ্গালা সুলতানাৎয়ের দুর্বল হওয়ার সুযোগ নিয়ে পরবর্তীতে ম্রুয়াক-উ রাজ্যের পরবর্তী রাজাগণ অতীতের উপকার ভুলে গিয়ে বাঙ্গালায় হানা দেওয়া শুরু করে, যে-সময়টা বাঙ্গালার ইতিহাসে মগের মুল্লুক নামে জনমনে পরিচিত লাভ করে, যা ১৬৬৬ সাল পর্যন্ত সমগ্র বাঙ্গালা মুঘলদের অধীনে আসার পূর্বপর্যন্ত চলতে থাকে।

দীর্ঘকাল ধরে মগের মুল্লুক চলা-কালে বাঙ্গালা থেকে যে-ব্যাপক সংখ্যক বাঙ্গালী ধরে নিয়ে গিয়ে গিয়ে ম্রুয়াক-উ রাজ্যে কৃষি ও শিল্পের কাজে নিয়োজিত করা হয়। আর এভাবে শুরু হয় আরাকানে বাঙ্গালীর দ্বিতীয় অভিবাসন। কিন্তু প্র্রথমবারের সাথে দ্বিতীয় বাঙ্গালী অভিবাসনের পার্থক্য হলো এই যে, প্রথমবার বাঙালী ছিলো বিজয়ী, আর দ্বিতীয়বারে ছিলো বিজিত।

আরাকানে বাঙ্গালীর তৃতীয় অভিবাসন ঘটে বার্মায় ইংরেজ বিজয়ের পর। বাঙ্গালা তথা ভারতের ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসকেরা বাঙ্গালা থেকে বার্মা আক্রমণ করে ১৮২৪ সালে, যার ফলে বার্মা ব্রিটিশ ভারতের একটি প্রদেশ হিসেবে উপনিবেশিত হয়। সে-সময় ইংরেজ শাসকেরা বাঙ্গালা থেকে প্রচুর বাঙ্গালী কৃষক, কারিগর, কর্মচারী, প্রশাসক ও ব্যবসায়ীর অভিবাসন ঘটায়।

আরাকানে বাঙালীর (বানানে পরিবর্তণ লক্ষণীয়, যদিও তখনও বাঙ্গালী লিখা হতো) তৃতীয় অভিবাসন ঘটে ১৯৭১ সালে, বাংলা দেশের (তখন এক শব্দে বাংলাদেশ লিখা হতো না) স্বাধীনতা যুদ্ধকালে। সে-বছরের ২৫শে মার্চ রাতে বাঙালীর ওপর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর গণহত্যা শুরু হলে, আশ্রয়ের জন্যে যারা দেশত্যাগ করে, তাদের একটি অংশ আরাকানে আশ্রয় লাভ করে। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর অধিংকাশ শরণার্থী ভারত ও বার্মা থেকে ফেরত এলেও দু'দেশেই অনেকেই স্থায়ীভাবে বাস করতে শুরু করে।

১৯৮২ সালে বার্মার সামরিক জান্তা নতুন সংবিধান প্রণয়ন করার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রটির নাগরিকত্বের বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে। সেই বৈশিষ্ট্য অনুসারে, ১৮২৩ সালের পূর্বে যারা বার্মায় বসতি স্থাপন করেছে, একমাত্র তারাই বার্মার নাগরিক হিসবে গণ্য হবে, তারপরের কেউ নয়। অর্থাৎ, ১৮২৪ সাল থেকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকগণ বার্মায় যে ভারতীয় তথা বাঙ্গালী অভিবাসন ঘটিয়েছে, তাকে বার্মার সামরিক জান্তা প্রত্যাখ্যান করছে।

বার্মায় বাঙ্গালী-বিরোধী যে-আন্দোলন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কালে শুরু হয়েছিলো ব্রিটিশ-খেদাও আন্দোলনের অংশ হিসেবে, তা-ই জাপানের বার্মা-দখল, ব্রিটিশদের পশ্চাদাপসরণ ও পুনর্দখল এবং শেষ পর্যন্ত ১৯৪৮ সালে বার্মার স্বাধীনতা লাভের প্রেক্ষিতে বাঙ্গালীর সাথে রাখাইন জনগোষ্ঠীর সম্পর্কের অবনতি ও একের ওপর অন্যের গণহত্যার ঘটনা ঘটে। বিষয়টি সরল নয়, জটিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-কালে বাঙ্গালীর সাথে রাখাইন-সহ বার্মার মূল জাতিসত্তাগুলোর সম্পর্কের অবনতি ঘটে সংঘর্ষের সূচনা হয়, তার প্রধান হোতা ছিলেন আজকের নোবেল শান্তি পুরষ্কার প্রাপ্তা বর্মী নেত্রী অং সান সু কীর পিতা অং সান। এ-বিষয়ে বিস্তারিত কাহিনী আমি লিখবো অন্য কখনও।

২৯/০৮/২০১৭
লণ্ডন, ইংল্যাণ্ড


EmoticonEmoticon