জাতি বিষয়ে আমার তত্ত্ব হচ্ছে, একটি জাতির বস্তুগত ও ভাবগত - দু'টি দিক আছে; প্রথমটি তার হার্ডওয়্যার বা কঠিনাধার, আর দ্বিতীয়টি সফটওয়্যার বা কোমলাধার। প্রথমটি অচেতন ও প্রাকৃতিকভাবে প্রাপ্ত; দ্বিতীয়টি সচেতন ও ঐতিহাসিকভাবে রপ্ত।
একটি জাতি যখন তার অচেতন দিকটি সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে, তখন সে তার প্রকৃত আত্মপরিচয় লাভ করে। কিন্তু কোনো কোনো জাতির ফলস কনশাসনেস বা ভ্রান্ত সচেতনতা হতে পারে এবং এর ফলে সে নিজেকে যা-নয়-তা ভাবতে পারে।
বাঙালী জাতির ইতিহাস আমার এই তত্ত্বের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বাঙালী জাতির সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ১৯৪৭ সালে নিজেদের জাতিপরিচয় বাঙালীত্বের বদলে মুসলমানত্ব বলে দিয়েছিলো, যা ঘটেছিলো জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে এবং এর ফলে বাঙালী জাতি ও তাদের দেশ বিভক্ত হয়েছিলো।
১৯৪৮ সাল থেকে দ্বিজাতি তত্ত্ব ভিত্তিক ফলস কনশাসনেস ভাঙ্গতে শুরু করে এবং ১৯৭১ সালে এই জনগোষ্ঠী জাতিপরিচয় মুসলমানত্বকে পাশে ঠেলে বাঙালীত্বকে ধারণ করে। আপনাকে এই ডাইনামিক্সটা বুঝতে হবে।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর 'শ্রীকান্ত' উপন্যাসে বাংলার মুসলমানকে বাঙালী বলে স্বীকার করেননি। সম্ভবতঃ এটি তাঁর দোষ নয়। কারণ, তখন মুসলমানেরা নিজেদেরকে বাঙালী বলে পরিচয় দিতো খুব কমই। কিন্তু আজকের বাস্তবতা হলো এই যে, বাঙালী বলতে প্রধানতঃ মুসলমানই।
যে-প্রক্রিয়ায় বাংলার বাঙালী মুসলমান নিজেদের বাঙালী আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠা করেছে, সে-প্রক্রিয়ায় আরাকানের বাঙালীরা অংশগ্রহণ করতে পারেনি ১৯৪৭ সালের পর বাংলার সাথে আরাকানের বিচ্ছেদের পর। ১৯৫২ সালে পূর্ববংলায় যখন বাঙালী আত্মপরিচয় জাগতে শুরু করে, পূর্ববাংলার সাথে যোগদানে ব্যর্থ আরাকানের বাঙালীরা তখন 'রোহিঙ্গা' আত্মপরিচয় আবিষ্কার করে।
আমি বলতে চাইছি, একই অবস্থান থেকে শুরু করে পূর্ববাংলার বাঙালী বাঙালী হয়ে ওঠে, আর আরাকানের বাঙালী রোহিঙ্গা হয়ে ওঠে। বলাই বাহুল্য, পশ্চিম বাংলার বাঙালী তাদের স্বাভাবিক বাঙালীত্ব থেকে অধিকহারে হিন্দুস্থানী হয়ে ওঠে।
২৯/০৮/২০১৭
লণ্ডন, ইংল্যাণ্ড
EmoticonEmoticon