১৭৮৪ খৃষ্টাব্দে বার্মার রাজা ভোদাপায়া যখন আরাকান আক্রমন কইরা দখল কইরা নিসিল তখন হাজার হাজার আরাকানী পালায়া সীমান্তবর্তী পাহাড়ে আশ্রয় নিসিল। বিদ্রোহী আরাকানীদের আশ্রয়স্থল এই পাহাড় ছিল তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাষনাধীন। এই বিদ্রোহী আরাকানীরা অস্ত্র-সস্ত্রে সুসজ্জিত হইয়া যখন অতর্কিত বর্মী বাহিনীর উপড় হামলা চালাইসিল তখন বার্মার রাজা এদের ধরায়া দেয়ার জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী রে চাপ দিসিল প্রচুর এমনকি বর্মী বাহিনী কোম্পানীর এলাকা আক্রমন করবে বইলা হুশিয়ারী দিসিল। সেই সময় ধূর্ত বৃটিশরা বার্মার সাথে সুস্পর্ক বজার রাখার জন্য তিনজন বিদ্রোহী রে ধইরা বার্মার কাছে হস্তান্তর করসিল। বার্মা সেই তিন বিদ্রোহীরে চোখ উপ্রায়া জ্বলন্ত আগুনে জীবন্ত পুড়ায়া মারসিল। সেই সময় সারা ভারত বৃটিশদের এমন ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরন রে চরম বর্বরতা বইলা উল্লেখ করসিল। তখনকার বিদ্রোহীদের নেতা ঘাথানডির মৃত্যুর পর তার ছেলে সিনপিয়া কিছুদিন পর তখনকার মগ বিদ্রোহীদের সুসংঘটিত কইরা একটা সুসংঘটিত বিদ্রোহী দল বানায়া বর্মী বাহিনীরে বিপর্যস্ত কইরা তুলসিল। এক পর্যায়ে সিনপিয়া রাজধানী ম্রোহং ছাড়াও গোটা আরাকান দখল কইরা নিসিল। সেই মহূর্তে সিনপিয়ার সেনাবাহিনীতে গোলাবারুদের তীব্র সংকট দেখা দিসিল। তখন যে কোনো শর্তে সিনপিয়া বৃটিশদের কাছে গোলাবারুদ সাহায্য চাইসিল। সিনপিয়া তার আবেদনে গৌড়ের সুলতানের সাহায্যের কথা স্মরণ করায়া দিসিল। গৌড়ের সুলতান কিভাবে সাহায্য করসিল সেইটা একটু উল্লেখ করা দরকার। এই ঘটনাটা মুসলমানদের আরাকানে আগমনের দ্বিতীয় কাল ১৪৩০ খ্রিষ্টব্দে স্বাধীন আরাকানের ম্রাউক-উ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা নরমিখলা ওরফে সোলাইমান শাহ্ ১৪০২ খ্রিষ্টাব্দে (নরমিখলা একজন বৌদ্ধ, আরাকানে মুসলিম আধিপত্যে নিজেএ সুবিধার্তে মুসলিম হইয়া নাম পরিবর্তন কইর সোলাইমান শাহ্ হইসিল) তার স্বীয় চাচারে উৎখাত কইরা সিংহাসনে বসে আরাকানের সামন্তরাজা অননথিউ এর বিবাহিতা ভগ্নি সা-বু-ইউ রে অপহরন কইরা রাজধানী লংগ্রেত নিয়া আসছিল। অপহরনকারী মহিলা ছিল আরাকানের আরেক সামন্তরাজার স্ত্রী। এই ঘটনায় আরাকানের সমস্ত সামন্তররাজারা ক্ষেইপ্যা গিয়া সা-বু-ইউ রে ফেরত দিতে অনুরোধ করসিল কিন্তু নরমিখলা ওরফে সোলাইমান তাদের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করসিল। তখন সকল সামন্তরাজারা আরো ক্ষিপ্ত হইয়া বার্মার রাজারে আরাকান আক্রমন করার জন্য অনুরোধ জানায়। ১৪০৩ খ্রিষ্টাব্দে বার্মার রাজা মেং শো আই ৩০ হাজার সৈন্য নিয়া আরাকান আক্রমন কইরা দখল কইরা নেয়। নরমিখলা প্রাণভয়ে পালায়া তখন বাঙলার রাজধানী গৌড়ে আইসা আশ্রয় নেয়। ১৪৩০ খ্রিষ্টাব্দে গৌড়ের সুলতান জালালুদ্দীন শাহ্ সেনাপতি ওয়ালী খানের নেতৃত্বে বিশ হাজার গৌড়িয় সৈন্য দিয়া নরমিখলার স্বদেশভূমি পূনরুদ্ধারের জন্য পাঠায়। ওয়ালি খান বর্মি বাহিনীরে পরিজিত কইরা বিটলামি কইরা নিজেই আরাকানের সুলতান ঘোষনা করে। নরমিখলা ওরফে সোলাইমান আবার তখন পালায়া গৌড়ে ফিইরা আসে। পরের বছর সুলতান জালালুদ্দীন সিদ্ধী খান রে দিয়া আবার ত্রিশ হাজার সৈন্য দিয়া ওয়ালি খান রে হটানোর জন্য পাঠায়। সিদ্ধি খান আরাকানে পৌছার আগেই ওয়ালি খান পালায়া যায়। এইভাবে পঞ্চাশ হাজার গৌড়িয় সৈন্যের সাহায্য পাইয়া নরমিখলা ওরফে সোলাইমান শাহ্ আরাকানে ম্রাউক-উ নামে এক স্বাধীন রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করে।
সিনপিয়া তার আবেদনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কাছে গৌড়ের জালালউদ্দিন শাহ্'য়ের এই ঘটনা উল্লেখ করে সাহায্যের আবেদক করসিল কিন্তু সিনপিয়ার মানবিক আবেদন বৃটিশদের মন গলাইতে পারে নাই। তখন নতুন ভাবে বর্মী বাহিনী আইসা পড়লে তীব্র গোলা-বারুদ সংকটে পইরা সিনপিয়া বাঁশের তৈরী বর্শা দিয়া যুদ্ধ করতে করতেই বর্মী বাহিনীর কাছে পরাজয় বরণ করে। এইটা ছিল আরাকানীদের স্বাধীনতা পূনরুদ্ধারের প্রথম কাহিনী। সিনপিয়া পরাজিত হবার হবার তেরো বছরের মধ্যে আরাকানের দুই-তৃতীয়াংশ অধিবাসী পালায়া ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর পার্বত্য অঞ্চলে আশ্রয় নেয়। ধারনা করা হয়, সিনপিয়া সেই সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সহযোগীতে পেলে স্বাধীন আরাকানের স্বাধীনতা আজিবন অক্ষুন্ন থাকতে পারত।
দুইটা ঘটনা উল্লেখ করার পেছনে যথেষ্ট কারন আছে। দুইটা ঘটনাই বর্তমানে রোহিঙ্গা প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অবস্থান এক এবং অভিন্ন। বৃটিশদের হাটা পথই যেনো অনুসরন করছে বাংলাদেশ। সু-সম্পর্ক বজার রাখার নামে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা হজম করছে, পার্বত্য এলাকা থেকে বিদ্রোহী আরাকান আর্মিদের ধরে মিয়ানমারের কাছে হস্তান্তর করছে, যৌথ অভিযানের প্রস্তাব দিচ্ছে। বাংলাদেশ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিচ্ছে না। মিয়ানমার তথা বর্মীদের ইতিহাস অত্যন্ত বর্বর, ভয়ঙ্কর। বৃটিশরা সে সেসময় আরাকান বিদ্রোহীদের দমন করার জন্য চেষ্টার কোনো ত্রুটি করেনি। এমনকি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ এবং বার্মার সাথে সু-সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য তখন কোম্পানীর পক্ষ থেকে ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স কে বার্মার রাজধানী আভাতে কাজ করতে পাঠিয়েছিল বৃটিশ রা তবুও ইস্ট ইন্ডিয়ার সাথে বার্মিজদের সম্পর্ক তিক্ততার চরমে পৌছেছিল বলেই ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। সেখানে বাংলাদেশের ত্যালমেরে নিজেদের মুসাফির ভান নিয়ে থাকা একটি জাতির জন্য অনেক বেশি অমানবিক এবং বিবেকবর্জিত...
এই আরাকান বার্মিজদের কখনই ছিল না। মহাকবি আলাওল 'পদ্মাবতী' কাব্যে রোসাঙ্গ জনগোষ্ঠির (বর্তমান রোহিঙা) বর্ণনা দিয়েছিল এইভাবে, "নানাদেশী নানা লোক শুনিয়া রোসাঙ্গ ভোগ আইসন্ত নৃপছায়া তলে। আরবি, মিশরী, সামী, তুর্কি, হাবসি, রুমি, খোড়াসানী, উজবেগী, লাহোরী, মূলতানী, সিদ্ধী, কাশ্মিরী, দক্ষনী, হিন্দি, বঙ্গদেশী, বহু শেখ, সৈয়দজাদা, মোঘল, পাঠান যুদ্ধা, রাজপুত হিন্দু নানাজাতি"
এই আরাকান সপ্তদশ শতকের কবি দৌলত কাজীর, আলাওল, মরদন, নসরুল্লা খানদের।
[তথ্যসূত্রঃ রোহিঙ্গা জাতির ইতিহাস]
সুতরাং রোহিঙ্গা জাতি তথ্য আরাকানীদের সব রকম সাহায্য দিয়ে তাদের স্বাধীনতা, অধিকার আদায়ে সর্বাত্বকভাবে সহযোগীতা করা পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর রাষ্ট্রীয়ভাবে নৈতিক এবং মানবিক দায়িত্ব। কূটনৈতিক ভাবে সম্ভব না হলে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের অস্ত্র, প্রশিক্ষিন দিয়েও সাহায্য করা নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে পরে। আমাদের দেশের যেসব সে-কুলাঙ্গার রা রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের ইসলামি জিহাদী বলে আখ্যায়িত করে তাদের প্রতি অনুরোধ, রোহিঙ্গাদের ইতিহাস ঐতিহ্য জানুন যারা শতশত বছর ধরে নিজেসের স্বাধীনতা ও অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছে।
মাসুদ রানা ভাইয়ের একটি কথা দিয়ে শেষ করি,
গণহত্যায় মরার চেয়ে যুদ্ধ করে মরা শ্রেয়!
বার্মার 'রোহিঙ্গা' নামের আরাকানী বাঙালীদের যদি মরতেই হয়, গণহত্যাকারীদের বিরুদ্ধে তাদেরকে যুদ্ধ করে মরতে দিন! গণহত্যায় মরার চেয়ে মুক্তির জন্যে যুদ্ধ করে মরা অনেক মানবিক এবং অধিক সম্মানের ও মর্য্যাদার।
এবং সেই সম্মান ও মর্যাদায় আমাদের একাত্বতা প্রকাশ করা অবশ্য উচিত।
EmoticonEmoticon