বামপন্থি দলগুলি তাদের রাস্তার প্রতিবাদ আন্দোলনে দুর্নীতি, দখলবাজি এবং লুটপাটের বিরুদ্ধে র্কমসূচি দিয়ে ঠিক কাজই করেছে। যারা নির্বাচনে মুক্তি আসবে না মনে করেন এ প্রেক্ষাপটে তাদের নিয়ে কোনো কথা নেই। যারা নির্বাচনে যেতে চান এবং যেনতেন করে একটা এম.পি. সাব হতে পারলেই জীবন ধন্য মনে করেন তাদের বিষয়ে কথা হলো ,অতীতের দিকে তাকিয়ে দেখুন, বামপন্থিরা ইতিপূর্বে এমপি হননি তা নয়, হয়েছিলেন কিন্তু টেকেননি। শাসক দলে গিয়ে ভিড়তে হয়েছে অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই। আজ আবারও চোরাপথে এমপি হতে চাইলে একই পরিণতি হবে। এদেশে এমপি নির্বাচন হওয়া মানে আগামী পাঁচ বছর কে দেশটাকে লুটপাট করে ছোবড়া করে দেবে, তার পারমিট র্অজন। ঢাকা শহরে যানজটে নাকাল ঢাকাবাসীর যানজট অন্তত: সামান্য কমবে কে এমপি হলে বলুন তো? লক্ষ লক্ষ ঢাকাবাসীর লক্ষ লক্ষ র্কমঘন্টা নষ্ট হওয়া থেকে সামান্য পরিত্রাণ পাবে কে এমপি হলে ? কোনো পরিত্রাণ হবে না। আমরা যখন জানি, মুম্বাইয়ের ইস্টার্ন ফ্রিওয়ে ফ্লাইওভার ৮৮ কোটি টাকা প্রতি কিলোতে, কলকাতার পরমা-পার্কসার্কাস ৪৮ কোটি টাকা প্রতি কিলোতে, বাটানগর ৪৪ কোটি টাকা প্রতি কিলোতে, ১৩ সালের এপ্রিলের টেন্ডারে মালেশিয়ার ৫টি ফ্লাইওভার ৫৭ কোটি টাকা প্রতি কিলোতে, চীনের ১০০ কি.মি. উরালপথের ৪৮ কোটি প্রতি কিলোতে খরচ হলেও বাংলাদেশে যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারে ২৪১ কোটি টাকা প্রতি কিলোতে খরচ হয় অথচ যানজট কমে না এবং এদেশেই শ্রমিকের শ্রমের মজুরি পৃথিবীর সবচেয়ে কম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রির্জাভ থেকে চুরি হয়েছে ৮০০ কোটি টাকা ২০১৬ সালে। এই অপরাধে কারও শাস্তি না হওয়া থেকে বোঝা যায় কারা চুরি করেছে। শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারিতে জনগণের দেড় হাজার কোটি টাকা যারা লুট করেছে তাদেরও কোনো বিচার হয়নি। ২০১২ সালে হলর্মাক কেলেঙ্কারিতে ব্যাংক থেকে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা বের করে নেওয়া হয়েছে ভুয়া ব্যাক টু ব্যাক এল সি দিয়ে। বিসমিল্লাহ গ্রুপের নামে লুট হয়েছে এগারশ কোটি টাকা। ডেসটিনি গ্রুপের নামে চার হাজার একশ উনিশ কোটি টাকা লুট হয়েছে। বেসিক ব্যাংকের চার হাজার পাঁচশত কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। দেশে ব্যাংকের খেলাপি ঋণদাতার মোট সংখ্যা ১ লক্ষ ৪৫ হাজার ১৬২ জন। আর খেলাপি ঋনের পরিমাণ ৮২ হাজার ৭০৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংকের মূল হিসাব থেকে আলাদা করে রাখা বা অবলোপন পরিমাণ বাদ দিলেও খেলাপি ঋণ ৫১ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকা। এটা এখন সকলেরই জানা যে, শুধুমাত্র হুন্ডিতে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার নয়, খোদ ব্যাংকিং চ্যানেলেই মানি লন্ডারিং আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের ভাষ্যমতে (আতিয়ার রহমান) ২০১১ সালে ১১৭ কোটি ডলার, বা ৯৩৬০ কোটি টাকা পাচার হয়েছে যা ঐ বছরের রাজস্ব আয়ের ১১% বা বৈদেশিক উন্নয়ন সহায়তার ৭৮.৫%। আবার ২০১২ সালে ১৮০ কোটি ডলার বা ১৪ হাজার ৪০ কোটি টাকা যা বৈদেশিক সাহায্যের চেয়েও বেশি। স্বাধীনতার ৪২ বছরে তিন লক্ষ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। আগের বছর ৫৬০ কোটি থেকে পরের বছর ৯৩৩ কোটি টাকা শুধুমাত্র সুইস ব্যাংকেই পাচার হয়েছে। আগামী এক বছরে দক্ষিণ এশিয়ার র্শীষ পাচারকারী দেশ হবে বাংলাদেশ। এছাড়াও পানামা পেপারস কেলেঙ্কারির কথা সকলেরই জানা। যে কেলেঙ্কারীর জন্য পৃথিবীময় তোলপার হলো, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফকে পদত্যাগ করতে হলো, স্পেনের মন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হলো, কিন্তু বাংলাদেশের কারও কিছু আজ র্পযন্ত হলো না।
এটা সকলেই জানে, মোসাক ফনসেকা যা গোপনীয়তা রক্ষায় পৃথিবীর সেরা প্রতিষ্ঠান তাদের কাছ থেকেই প্রথমে জার্মান পত্রিকার সাংবাদিকতা বিষয়ক ওয়েবসাইট এক কোটি ১৫ লক্ষ নথি ফাঁস করে। তাতে বাংলাদেশের ২১ ব্যক্তি, তিন প্রতিষ্ঠান ও ১৮ ঠিকানা প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশে তদন্তের দায়িত্ব নেয় বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট, যার নাম বাংলাদেশ ফিনান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিট। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। অবশেষে বাংলাদেশ ব্যাংক আর্ন্তজাতিক সংগঠন এডমন্ড গ্রুপের সহায়তা চেয়েছিল, কাজ তাতেও হয়নি। দুদক বলেছে, ‘আমরা মিচুয়াল লিগাল এসিস্টান্স রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছি ১১টা দেশে। কেননা ১১ জনের দ্বৈত নাগরিকত্ব আছে।’ ওয়াশিংটন ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইনান্সিয়াল ইনটিগ্রিটি বলেছে, ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ৭৫৮৫ কোটি ডলার বা ৬ লক্ষ ৬ হাজার ৮৬ কোটি টাকা এদেশ থেকে পাচার হয়েছে যা দিয়ে এদেশের দুই বছরের বাজেট হতে পারতো। বিআরটিএ- এর মতে ৪৯ হাজার বিলাসবহুল গাড়ীর রেজিস্ট্রেশন আছে এর মধ্যে ২৫ হাজারের বেশি লেক্সাস, মার্সিডিসবেন্জ। এর একটির দাম আমদানি শুল্ক মিলে চার কোটি টাকা। আার বি এম ডাব্লিও কিনতে লাগে ৭ কোটি টাকা। এই বিএম ডাব্লিও বিক্রিতে বাংলাদেশএশিয়ার মধ্যে ৫ম স্থানে আছে। গাড়ীর পরে যদি বাড়ীর দিকে তাকান তবে দেখবেন রিহাবের মতে, ধানমন্ডিতে প্রতি র্বগফুট ১৫-১৮ হাজার টাকা, গুলশানে ২০-২৮ হাজার, বাড়ীধারা ২০-২৫ হাজার, বনানী ১৫-২২ হাজারপ্রতি বর্গফুট আবাসিক দালানের দাম গড়ে আড়াই কোটি টাকা। খোদ ঢাকা শহরে সাড়ে তিন লক্ষ বাড়ী আছে। অথচ কর দিচ্ছে মাত্র সাড়ে এগার হাজার বাড়িয়ালা। টিনধারী লোক ৩০ লক্ষ আর রির্টান জমা দেয় ১৩ লক্ষ। বাড়ী নিয়ে ,গাড়ী নিয়ে, ব্যাংক এর টাকা লুট নিয়ে পানামা পেপারস কেলেঙ্কারি নিয়ে আমরা বুঝতে পারি, শাসক দলগুলির নিরবিচ্ছিন্ন লুটপাটে এদেশে একটা ভয়ানক টাকাওয়ালা শ্রেণি গড়ে উঠেছে। এরা ছাড়া আর কেউই দেশ চালানোর জন্য নির্বাচিত হতে পারবে না। বাকীরা ভোটে দাঁড়ালে ৫০ থেকে ৫০০ ভোটই পাবে।
এহেন শাসকদলের পকেট ভরার উন্নয়ন যে দেশে চলছে অর্থাৎ শত শত কোটি টাকা লুটপাট যে দেশের শাসক দলগুলি করে সে দেশে পার্লামেন্ট র্নিবাচন মানে টাকার খেলা। একজন কেউ বলতে পারবেন আগামী সংসদ নির্বাচনে টাকা নেই কিন্তু সততা আছে এমন একটি মানুষও কি জিততে পারবে? যদি তা না হয় তবে বামপন্থিরা এ র্নিবাচনে অংশ নিলে নিজেদের মতার্দশ প্রচার করা ছাড়া আর কি অর্জন করতে পারবে তা ভেবে দেখা আজ প্রত্যেক বাম দলের কর্মীর জন্য সময়ের দাবি। বাম দলের কর্মীরা পরিশ্রম করেনি ফলে সফল হয়নি এমন অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে কখনো ছিল না। তারা অতীতেও পরিশ্রম করেছিল, আজও করছে, কিন্তু আজ পরিশ্রমের পাশাপাশি মাথা ঘামাতে হবে। বুঝতে চেষ্টা করতে হবে আজকের ফ্যাসিবাদের স্বররূপ কি?
কোনো কোনো বামদল মনে করেন দেশে এখনও পুরোপুরি ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আমি তেমন মনে করি না। আজ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্বের মতো একটা যুদ্ধ পরিস্থিতি না থাকলেও পুরোমাত্রায় ফ্যাসিবাদ বিরাজ করছে। এ ফ্যাসিবাদ যেমন ফর্মের দিক থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সময়ের মতো ফ্যাসিবাদ নয়, তেমনি আজকের ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াইও সেই সময়ের লড়াইয়ের মতো হবে না। উত্থানের যুগে ফ্যাসিবাদ পণ্যের বাজার দখলের মাধ্যমে একচেটিয়া কতৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য দুটি কাজ করেছে। এক. যুদ্ধ, যা দিয়ে বাজার দখল করেছে। দুই. ব্যাংক পুঁজি এবং শিল্প পুঁজির অঙ্গীভবন ঘটিয়েছে। এই ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াইতে সেদিন জর্জি দিমিত্রভরা ‘এ টু জেড’ ঐক্যের কথা বলেছিল। কিন্তু আজ পরিস্থিতি ভিন্ন। আজ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো যুদ্ধ যেমন নেই, বাজার দখল করার জন্য উপনিবেশও নেই। ফলে সেদিন যে বুর্জোয়াদের মধ্যে লিবারেল একটা অংশ ছিল তাও নেই। কেন নেই?
অবাধ প্রতিযোগিতার বাজার একচেটিয়া বাজারে পরিনণ হয়েছে সেজন্য নেই। আজ ক্ষমতার বাইরে থাকলে সব বুর্জোয়ারাই লিবারেল আর ক্ষমতায় গেলে ফ্যাসিস্ট। ফলে ফ্যাসিবাদ মোকাবেলার কোনো সংগ্রামেই আজ বুর্জোয়া ধনিক শ্রেনীর কোনো দল আজ আর কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে না। সেজন্য এ সংগ্রাম বামপন্থিদেরই করতে হবে। করতে গিয়ে বামপন্থিদেরও মনে রাখতে হবে আজ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো পরিস্থিতি নেই। কিন্তু ভিতরে আর একটা পরিস্থিতি আছে যা দেখিয়েছেন কমরেড শিবদাস ঘোষ। কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষা থেকে আমরা পেয়েছি অধ্যাত্ববাদের সাথে বিজ্ঞানের কারিগরি দিকের সংমিশ্রন ফ্যাসিবাদের ভাবাদর্শগত ভিত্তি তৈরি করে। ফলে আমরা ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াইতে কোনো মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক শক্তির সাথে ঐক্য করবো না।
আজ সরকার ঠিক করে দিচ্ছে কে বিরোধী দল হবে। একই দল একযোগে সরকারেও থাকে বিরোধী দলেও থাকে। এরকম পরিস্থিতিতে দেশি-বিদেশি শক্তিকে দেখাতে সরকার একটা নির্বাচন ঠিক করতে চাইতে পারে Ñ কিছু অনুগত গৃহপালিত বিরোধীদল তৈরি করে, তাদের কিছু সংসদীয় আসন দিয়ে প্রধান বিরোধীদল বিএনপিকে নাজেহাল করে পুনরায় ক্ষমতায় আসা। সরকারের এই ফাঁদে কিছু বামপন্থী নামের দল পা ফেলতে পারে, যারা মনে করবে পার্লামেন্টকে ‘পার্লামেন্টকে জনগণের ইচ্ছার যন্ত্রে রূপান্তর করা যায়’ কিংবা যারা মনে করে, বয়সও শেষ, দলও বিকাশমান নয়, ভবিষ্যতে না জানি কি হয় তার চেয়ে একটা এমপি হতে পারলে মন্দ কী।
এসব ক্ষেত্রে রক্ষাকবচ হলো দলের সচেতন কমীরা। তাঁরাই একটা বাম আন্দোলনকে নানামুখী সংকট থেকে তাদের বিচক্ষণতা দিয়ে রক্ষা করতে পারে। কে দালালি করবে, কে হটকারিতা করবে' এই পূর্ব ধারনা নিয়ে যেমন ঐক্য কিংবা আন্দোলন হয় না তেমনি ঐক্য কিংবা আন্দোলন করতে হলেও একটা সচেতন ভূমিকা থাকতে হয়। এদেশের মাটিতে আন্দোলন বহু হয়েছে, কিন্তু রাজনৈতিক তর্ক-বিতর্ক; সুস্থ আলাপ-আলোচনার অভাবে অনেক সময়ে তা অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেনি। ফলে আজকের ঐক্যের প্রশ্নটির সাথে রাজনৈতিক সংগ্রামে আপোষহীনভাবে লড়াইয়ের প্রশ্নটি জড়িয়ে আাছে। কুয়াশা পথে চলতে চলতে কাটবে আর আন্দোলনে অংশগ্রহণের তীব্রতা-সক্রিয়তা প্রতিদিন আমাদের মনোভাবের উপর প্রভাব ফেলতে থাকবে এবং আমরা শিক্ষিত হতে থাকবো, তা দিয়েও অনিশ্চয়তা কাটতে থাকবে। (কথা চলবে )
EmoticonEmoticon