আগে বলা হতো একজন নারী ধর্ষিতা হলে সে তার 'ইজ্জত হারায়'। স্বাধীনতা যুদ্ধে আমাদের ত্যাগ বুঝাতে আগে 'দুই লক্ষ মা-বোনের ইজ্জত হারানো'র কহতা উল্লেখ করে বহু দেশপ্রেমিক বক্তৃতা বিবৃ্তি আমরা শুনেছি।
আমার যতোটুকু মনে পড়ছে, আশির দশকে বাংলাদেশে চর্চিত নারীবাদ যখন নারীর মর্য্যাদার প্রশ্নে নতুন মাত্রার সচেতনতা নিয়ে এলো, তখন ধর্ষিতা নারীর 'ইজ্জত হারানো'র পরিবর্তে 'সম্ভ্রম হানি'র কথা প্রচলিত হলো।
প্রশ্ন হতে পারে, ধর্ষিতা নারীর অবস্থান-বিবৃতিতে এই 'আইডোম্যাটিক শিফট' বা বাগধারাগত পরিবর্তনে কী প্রকারের অর্থগত পরিবর্তন হয়েছে? অনেকেই অর্থগত মৌলিক পরিবর্তনটি নির্দেশ করেন 'সম্ভ্রম' দ্বারা 'ইজ্জত' শব্দের পরিবর্তনের মধ্যে। কিন্ত বিষয়টি কি বাস্তবে তাই?
'ইজ্জত হারানো' ও 'সম্ভ্রম হানি' কথা দু'টির প্রতিটিতে প্রথম শব্দটি হচ্ছে এ্যাডজিক্টিভ্যাল নাউন বা বিশেষণের বিশেষ্য, আর দ্বিতীয়টি ভার্ব্যাল নাউন বা ক্রিয়া বিশেষ্য। ইজ্জত ও সম্ভ্রম শব্দের মধ্যে পদ-প্রকারগত ও অর্থগত কোনো পার্থক্য নেই।
'ইজ্জত হারানো' আর 'সম্ভ্রম হারানো'র অর্থ সর্বতোভাবে অভিন্ন। কারণ, ইজ্জত ও সম্ভ্রম বিশেষ্য দু'টি যথাক্রমে আরবি ও সংস্কৃত, যাদের অভিন্ন অর্থ হচ্ছে মান বা সম্মান। বস্তুতঃ বাংলা অভিধানে 'ইজ্জত' শব্দের অর্থ 'সম্ভ্রম' দেখানো হয়েছে।
যাহোক, 'ইজ্জত হারানো' ও 'সম্ভ্রম হানি' কথা দু'টির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে 'হারানো' ও 'হানি' ক্রিয়া-বিশেষ্য দু'টির সাথে নারীর পদ-সম্পর্কগত সম্পর্কে মৌলিক পার্থক্য থাকার। নীচের বিশ্লেষণে বিষয়টি ব্যাখ্যা করছি।
'হারানো' ক্রিয়া-বিশেষ্যের সাথে 'নারী' সাবজেক্ট বা কর্তা হয়ে বাক্য গঠন করে; যেমন, 'পাক হানাদার বাহিনীর কাছে দুই লক্ষ নারী ইজ্জত হারিয়েছে' বাক্যে নারী সাবজেক্ট বা কর্তা। এ-বাক্যে 'নারী' কর্তা হওয়ার কারণে, 'হারানো'র দায়িত্ব তার। কারণ, এখানে 'হারানো' নারীর দ্বারাই সম্পাদিত।
বিপরীতক্রমে, 'হানি' ক্রিয়া-বিশেষ্যের সাথে 'নারী' সাবজেক্ট বা কর্তা হিসেবে নয়, বরং অবজেক্ট বা কর্ম হিসবে যুক্ত হয়। 'পাকহানাদার বাহিনীর কাছে দুই লক্ষ নারীর সম্ভ্রম হানি ঘটেছে' বাক্যে 'নারী' সাবজেক্ট বা কর্তা নয়, সে অবজেক্ট বা কর্ম। এই বাক্যে সাবজেক্ট বা কর্তা হচ্ছে 'নারীর সম্ভ্রম'।
নারীর ইজ্জত হারানো ও সম্ভ্রম হানির মধ্যে দ্বিতীয়টি অপেক্ষাকৃত সক্ষম ও গ্রহণযোগ্য এই কারণে নয় যে, প্রথমটি আরবি ইজ্জতের বদলে দ্বিতীয়টিতে সংস্কৃত সম্ভ্রম ব্যবহৃ হয়েছে। দ্বিতীয় কথাটি সক্ষমতা ও গ্রহণযোগ্যতা হলো এই যে, এর সাথে পাক-হানাদার বাহিনীকে কর্তা করে বাক্য গঠন করা যায়; যেমন, 'পাক-হানাদার বাহিনী দুই লক্ষ নারীর সম্ভ্রম হানি করেছে।'
লক্ষ্য করুন, উপরের বাক্যটিতে যদি 'সম্ভ্রম' শব্দের পরিবর্তে 'ইজ্জত' শব্দ ব্যবহার করে বলি, 'পাক-হানাদার বাহিনী দুই লক্ষ নারীর ইজ্জত হানি করেছে', তাতে অর্থের পরিবর্তন হয় না। কারণ, আগেই বলা হয়েছে, বাংলা অভিধানে 'সম্ভ্রম' শব্দের একটি অর্থ হচ্ছে 'ইজ্জত'।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, একজন পুরুষ যখন একজন নারীকে ধর্ষণ করে, তখন কি তার অপরাধের শিকার ঐ নিরাপরাধ নারীর ইজ্জত বা সম্ভ্রম যায়? নাকি যে-পুরুষ অপরাধ করে, তার ইজ্জত ও সম্ভ্রম যায়? আমি নিশ্চিত নই; তবে প্রশ্নটি পরীক্ষার দাবী রাখে।
উপরন্তু, নারীর ইজ্জত বা সম্ভ্রম যদি যায়, তা কি শুধু ধর্ষণ করলেই যায়? একজন নারীকে যদি প্রহার করা হয়, কিংবা কান ধরে ওঠবস করানো হয়, তাতেও কি তার ইজ্জত ও সম্ভ্রম যায় না? নিশ্চয় যায়। তো, আমরা কী প্রকারে ধর্ষণ দ্বারা 'সম্ভ্রম হানি'র সাথে কান-ধরে-ওঠবস করানোর দ্বারা 'সম্ভ্রম হানি'র পার্থক্য নির্দেশ করবো?
আমরা ইংরেজীতে আমরা অনায়াসে বলতে পারি, 'The invading Pak-army rapped two hundred thousand women', এবং অর্থের কোনো সমস্যা নয় না। কিন্তু, আমরা যদি বলি, 'The invadiing Pak-army insulted two hundrend thousadn women', তাতে প্রকৃত ঘটনাটি প্রকাশিত হয় না। কারণ< insult শব্দ দ্বারা যে-কোনো অসম্মানজনক আচরণ বুঝানো সম্ভব।
আমার মনে হয়, আমরা যতোক্ষণ না পর্যন্ত বলবো 'পাক হানাদার বাহিনী দুই লক্ষ নারী ধর্ষণ করেছে', ততোক্ষণ পর্যন্ত আমাদের বক্তব্য সিণ্ট্যাক্টিক্যালি ও সিমাণ্টিক্যালি সঠিক হবে না। বিষয়টি আমি নারীবাদী এ্যাক্টিভিষ্ট ও লেখকদেরকে ভেবে দেখতে অনুরোধ করছি।
আমার ধারণা, যৌন সংক্রান্ত সমস্ত শব্দের প্রতি বাঙালী সংস্কৃতিতে এক ধরণের ট্যাবু আছে। তাই, নারীর যৌনাঙ্গে অনুমতি বিহীন বলপূর্বক পুরুষাঙ্গের অনুপ্রবেশ দ্বারা যে-অপরাধ সঙ্ঘটিত হয়, এবং সেটি যে সঙ্গম নয় - ধর্ষণ, তা আমরা মুখ ফুটে বলতে পারি না।
এই 'বুক ফাটে তবু মুখ ফোটে না' সংস্কৃতি আধুনিক কালের জন্যে একটি সমস্যা বটে। তাই, নারীমুক্তির সাথে ভাষামুক্তির প্রশ্নটি জড়িত।
০৩/০৯/২০১৭
লণ্ডন,ইংল্যাণ্ড
EmoticonEmoticon