মঙ্গলবার, ১০ অক্টোবর, ২০১৭

"গল্প নয় সত্যি"— ০৭

আব্বু চলে যাবার পর মনে হয়েছিলো পুরো পৃথিবীটা আমার উপর ভেঙ্গে পড়েছে!  পায়ের নিচের মাটিও সরে গিয়েছে, ইচ্ছে হয়েছিলো চিৎকার করে কাঁদি ৷ কিন্তু মনটা কেমন যেন পাথর হয়ে গিয়েছিলো,  এক ফোটা অশ্রু আমি ফেলিনি ৷
মেয়েটাকে কোলে নিয়ে রুমের দরজা বন্ধ করে বসে ছিলাম ঝিম মেরে!
কি করবো বা কি করা উচিৎ কিছুই ভেবে পাচ্ছিলাম না ৷ কারন তখন বাইরের জগতটা ছিলো অপরিচিত, কখনো একা বাড়ির বাইরে যাওয়া হয়নি সে সুযোগ ও হয়নি কখনো ৷
শুধু ভেবেছিলাম চোখের সামনে মেয়েটা এভাবে মরে যাবে আর আমি কিছুই করতে পারবো না ?
বারবার মনে হয়েছিলো আব্বু ঠিকই বলে আমি রোজা,নামাজ, পর্দা - ধর্মানুযায়ী চলিনা বলেই আমার এই পরিণতি ৷
সেদিন বিকেলে ফুপাতো (যে আমার সব থেকে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলো)বোনকে ফোন করলাম আর বল্লাম বিকেলের মধ্যেই যেন ও আমার সাথে দেখা করে৷
আমি মনে মনে ও বাড়ী থেকে বেরুবার প্লান করলাম, যদিও একা একা বের হতে পারাটা অসম্ভব ছিলো৷
ফুপাতো বোন ঘন্টাখানেক বাদেই চলে এসেছিলো, প্রয়োজনীয় কিছু কাপড় নিয়ে সবার সামনে দিয়ে বের হলাম কাউকে কিছু না বলেই ৷
অন্য জা, শ্বাশুরী পথ রোধ করে দাড়ালেন এবং বেশ ভয়ও দেখালেন যদি আমি এভাবে বের হয়ে যাই তাহলে আর কখনো ও বাড়ীতে ঢুকতে পারবোনা ৷ তবুও বের হয়ে গেলাম ৷ সে সময়ে মেয়ের আর আমার মাসিক খরচ বাবদ আমার কাছে পাঁচ হাজার টাকা ছিলো৷যদিও সেটা খুবই সামান্য তবুও এত ভাবনার সময় তখন ছিলোনা ৷
রাতটা ফুপুর বাড়ী থেকে খুব সকালে ঢাকার উদ্দেশ্যে বোন কে সহ বের হয়ে গেলাম, শ্বশুর বাড়ীর পাশ দিয়েই যাতায়াতের রাস্তা,  তাদের বাড়ী অতিক্রম করে কিছুটা সামনে আসতেই মেয়ের বড় চাচা সহ আরো তিনচার জন আমার রাস্তা আটকে ধরলেন,আমাকে কোথাও যেতে দেয়া হবেনা আমি যদি স্ব-ইচ্ছায় না যাই তারা জোর করেই আমাকে টেনে হিচড়ে নিয়ে যাবেন এমনটাই বল্লেন ৷
কাজিন খুব রেগে গেলো ও খুব উচ্চস্বরে বলা শুরু করলো যদি নিজেদের ভালো ত চান রাস্তা ছেড়ে দিন ৷
মেয়ের বড় কাকাও যা তা বলা শুরু করে দিলো,  আমার কাজিনও ছাড়ার পাত্রি নয়, এক পর্যায় আমার কাজিন পা থেকে জুতা খুলে হাতে নিয়ে নিলো, মুহুর্তের মধ্যে অনেক লোক জড়ো হয়ে গেলো৷ আমি কাজিন কে থামিয়ে দিয়ে বল্লাম ঝামেলা বাড়াস না, এদের সাথে ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ নেই বরং তুই এখান থেকে সরাসরি থানায় যাবি তারা জোর করে আমাকে নিয়ে যেতে পারবে তোকে তো পারবে না থানায় গিয়ে মানহানির/নারী নির্যাতনের কেইস করবি৷ আমিও দেখবো তারা কত বাড় বাড়তে পারে ৷
অনেক লোক যখন ঘটনা কি জানতে চাইলো তখন মেয়ের চাচা বল্লো বাড়ীর বউ রাগ করে চলে যাচ্ছে তাই নিয়ে যেতে চাইছি কিন্তু যাচ্ছে না ৷
তখন সবাইকে আমি মূল ঘটনা বল্লাম ৷  সবাই যখন মেয়ের অবস্থা দেখলো তখন আমার পক্ষ নিয়ে কথা বলতে শুরু করলো৷ তখনও আমাকে ছাড়বেনা তখন তারা অন্য কথা বলতে লাগলো, মেয়ের বাবা নাকি বলেছে তাদের বাড়ি থেকে দেয়া গহনা সব দিয়ে তারপর যেতে বলেছে৷ আমি তাদের বাড়ি থেকে দেয়া আমার সমস্ত গহনা নাকের ফুলটা সহ দিয়ে দেই ৷
তারপর তারা আমার রাস্তা ছেড়ে দেয় ৷
ঢাকায় এসে এক কাজিনের বাসায় উঠি, সেদিন রাতেই সে কাজিন পপুলারে  সিরিয়াল নেয়, অনেক পিছনে সিরিয়াল থাকার পরও মেয়ের অবস্থা খারাপ দেখে সবার কাছে অনুরোধ করে আগেই ডাঃ দেখাই৷
ডাঃ মেয়েকে দেখে বলেছিলো আরো দু একদিন পরে নিয়ে আসতেন!  মেয়ের এমন অবস্থা দেখেও আপনারা কি করে চুপচাপ বসে ছিলেন ? আপনাদের সাহসের প্রশংসা করতে হয় ৷
ডাঃ বেশ কিছু টেষ্ট দিলেন, রিপোর্ট না দেখে কোন মেডিসিন দিতে পারবেনা ৷
সেদিন শুধু মেয়ের যাতে প্রসাব-পায়খানা হয় তার ওষুধ দিয়েছিলেন৷
পরদিন রিপোর্ট নিয়ে গিয়ে জানতে পারি মেয়ের কিডনীতে ইনফেকশন হয়েছে ৷
বাসায় ফিরে খুব কান্নাকাটি করেছিলাম, আমার এমন বিপদের সময় যাদের পাশে থাকার কথা ছিলো অথচ কাউকে পাশে পাইনি ৷ দূর সম্পর্কের এক বোন কে পেয়েছিলাম যার ঋণ কখনো শোধ করার নয় ৷
আম্মুকে ফোন করে বলেছিলাম তোমার স্বামী বলে গিয়েছে আমার মেয়েটা মরলে আমার সমস্যা কি ?
মেয়েটাকে যে আমি পেটে ধরেছি,জন্ম দিয়েছি মেয়েটা মরে গেলে আমার বুক খালি হত, তাতে আর কারো কিছু হত না৷ আমার কাঁদতে হত সারা জীবন৷
তোমার স্বামীর জন্য একটা গুড নিউজ আছে তাকে বলিও আমার মেয়েটার একটা কিডনী নষ্ট হবার পথে!
আম্মু সেদিন প্রচন্ড কান্নাকাটি করেছিলেন, কোথায় আছি বারবার জানতে চেয়েছিলেন, দেন ছুটেও এসেছিলেন আমার কাছে ৷ আমাকে জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদে ছিলেন৷ সেদিনই প্রকৃত আমার মা'কে আমি তার মাঝে খুঁজে পেয়েছিলাম ৷
অদ্ভূত হলো এরপরও আব্বু বারবার তার সম্মানের কথা বলেছেন!  আমি নাকি একা একা ওভাবে বের হয়ে তার সম্মান নষ্ট করেছি ৷৷


EmoticonEmoticon