রবিবার, ২২ অক্টোবর, ২০১৭

মহান রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবঃ শতবর্ষের প্রেক্ষাপটে

রুশ বিপ্লবের প্রভাবে দুনিয়ার বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিবর্তন ঘটে।রাজনীতি, অর্থনীতির সাথে সাথে সাহিত্য, সংস্কৃতি,চিত্রকলা, নাটক, গান,নৃত্য- সকল  ক্ষেত্রেই। class struggle একটা উন্নত স্তরে না পৌঁছলে তা সমাজে ধ্বংস ও নৈরাজ্য নিয়ে আসতে পারে। শ্রেণী সংগ্রাম সবসময় উন্নত স্তরে নাও যেতে পারে। স্পাটার্কাসের বিদ্রোহের পর রোম সাম্রাজ্যের পতন হয় স্থানীয় উপজাতিদের আক্রমণে।
মার্ক্স "ক্যাপিটাল " গ্রন্থে পুঁজিবাদের ব্যাখা করেছেন,পুঁজি নিয়ে বলেছেন,কিন্তু সমাজতন্ত্র কেমন হবে তা বলেন নি।
দুই ধরণের  বন্টন ব্যবস্থা আমরা দেখতে পাইঃ according to ability এবং according to need।
সমাজতান্ত্রিক বন্টন ব্যবস্থায় শ্রমিক শ্রম বিক্রির জায়গায় থাকে।শ্রম বিক্রি করার সামর্থ্য থেকে তার আয় হয়।এই আয় হবে unequal, কারণ মানুষ unequal। এখানে যতটুকু সে দেবে,ততটুকুন পাবে।আর according to need এই বন্টন ব্যবস্থা দাঁড়ায় কম্যুনিজমে। কম্যুনিজমে productive force যখন অনেক developed  করবে, সেই সময়।মার্ক্স "গোথা কর্মসূচী"র উপর বলতে গিয়ে এ বিষয়ে সবিস্তারে বলেছেন। অর্মত্য সেন-"unequal production " বইয়ের একটা অংশে  মার্ক্সের এই কথাগুনো হুবহু তুলে ধরেছেন। Welfare Economy নিয়ে লেখায় অমর্ত্য সেন সোভিয়েত নিয়ে বলেছেন।বলেছেন- সোভিয়েত মানুষের অনেক প্রয়োজন পূরণ করেছে। ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত পতন হয়।সেসময় World Bank বলছে- সোভিয়েত ইউনিয়ন অনেক "বেসিক নীড' পূরণ করেছে। WB এটা বলছে!

বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে- ইঞ্জিনিয়ারিং, মৌলিক বিজ্ঞানে  সোভিয়েতের অনেক অবদান ছিলো। স্বাস্থ্য সুবিধা, কাজ পাওয়ার অধিকার সে মানুষকে দিয়েছিলো। যখন পতন হয় তখনও বয়স্ক লোকদের পেনশন দিচ্ছে, অনেক টাকা বেতন দিয়ে তাদের কাজে টানছে।
১৯৩০ সালে মহামন্দা হয়েছিলো,আপনারা জানেন।সেই মহামন্দায় ইউ.এস.এ -তে ৩০% মানুষ বেকার হয়ে পড়ে,  অনেক মানুষ আত্মহত্যা করে, আমেরিকার জিডিপি অর্ধেকে নেমে এসেছিলো। সেই মন্দাভাব সোভিয়েতকে স্পর্শ করে নি-আয় কম ছিলো মানুষের কিন্তু সবার জন্য কাজ ছিলো।

সোভিয়েত বিপ্লবের সময় ছিলো অনগ্রসর পুঁজিবাদ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ২য় জার নিকোলাস রাশিয়াকে যুদ্ধে নামিয়ে দেয়।অভাব দেখা দিলো খাদ্যের, যুদ্ধেও অভাব হলো অস্ত্রের। সৈনিকদের বলা হলো- যুদ্ধে কেউ মারা গেলে তার অস্ত্র সংগ্রহ করে যুদ্ধ করতে!  সে সময় প্রায় ৫০ লক্ষ মানুষ দূর্ভিক্ষে মারা যায়, যারা যুদ্ধ করছিলো তাদের মাঝে হতাশা দেখা দেয়।
দুটো বিপ্লব হয় সে সময়।ফেব্রুয়ারি বিপ্লবে নতুন পার্লামেন্ট বা ডুমা তৈরী হয়। জারকে ফেলে অস্থায়ী সরকার তৈরী হয়। শুরুতে এই সরকারের প্রধান ছিলো লভোভ এবং শেষে ছিলো কেরেনস্কি।
লেনিন সে সময় সুইজারল্যান্ড থেকে বললেন- এই যুদ্ধ আমাদের দরকার নেই।এতে জনগণের স্বার্থ নেই।এ যুদ্ধ থামাতে হবে। লেনিন জার্মানির সাথে সন্ধির কথা বলেন।
সোভিয়েতগুলোতে বুর্জোয়া, পেটিবুর্জোয়া, মধ্যবিত্ত প্রথমে সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও পরবর্তীতে বলশেভিক শ্রমিকরা শক্তিশালী হয়।
লেনিন ডাক দিলেন- 'শ্রমিক কৃষকের ঐক্য চাই' বলে। বললেন- কৃষককে জমি দিতে হবে, সৈন্যদের দিতে হবে শান্তি আর শ্রমিককে দিতে হবে রুটি। এর ফলে তিনি শক্তিশালী হয়ে উঠলেন।সেন্ট পিটার্সবাগ যা পরে নামকরণ হয় " পেত্রোগাদ" নামে, শ্রমিকরা সেখানে বিদ্রোহ করে।জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে '৭ নভেম্বর', আর গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে '২৫ অক্টোবরে' বিপ্লব হয়।
বিপ্লবের পরপরই লেনিন সন্ধি করেন। কেরেনস্কি  যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে, লেনিন এসে এই যুদ্ধের পরিসমাপ্তি টানলেন।বললেন- একই সাথে বু্র্জোয়া ও প্রোলেতারিয়েত বিপ্লব করতে হবে। প্রোলেতারিয়েতকে ক্ষমতা নিতে হবে।
মার্ক্স বলেছিলেন- সমাজ পরিবর্তিত হবে, পূর্ন বিকাশের পর সেখানে Subjective ও Objective কন্ডিশন খাপ খাইয়ে সেটেলমেন্টে আসবে। পরে মার্ক্স বলেছিলেন- চীনসহ বিভিন্ন অনুন্নত জায়গায় বিপ্লব হতে পারে।
১৪ টা দেশ রাশিয়াকে ঘিরে থাকার পরও তারা জিতেছিলো কেন? কারণ তারা প্রাণ দিয়ে দেশকে রক্ষা করেছিলো।তখন লেনিনের পাশে ছিলো ট্রটস্কি। সে সময় রাশিয়াকে সাহায্য করার কেউ ছিলো না।

Prebrazhensky  বলেছিলেন- পুঁজি যতো বাড়বে, ততই প্রবৃদ্ধি হবে, ততই উন্নয়ন হবে। এই পুঁজি সংগ্রহ করা হয় " collectivisation" সহ " five years plan "দিয়ে।এর আগে NEP গ্রহণ করেছিলেন লেনিন।এটা দেয় বুখারিন। Prebrazhensky  'socialist accumulation'য়ের মধ্য দিয়ে তাদের সম্পদ গড়ে তোলার কথা বলেন। ক্ষুদ্র পুঁজি ও মধ্যজীবীরা এ থেকে লাভবান হয়। এই পুঁজি আসবে, আহরণ করা হয় কৃষি থেকে। কৃষি থেকে পুঁজি এনে (শোষণ) শিল্পে সোভিয়েত এগিয়ে যায়।
১৯২৩ সালে গৃহযুদ্ধ শেষ হয়। ১৯২৪ য়ে লেনিন মারা যান।ক্ষমতায় আসেন স্ট্যালিন অনেক ঝড়-ঝঞ্জা পারর করে। সে সময় অনেক নেতাকে বিদায় দিতে হয়।কামেনেভ, জিনোভিয়েভ, রাদেক আরো অনেক লেনিনের সঙ্গী বাঁচে নি। স্ট্যালিনকে এটা করতে হয়েছিলো। এই পার্জিং করা হয়, আগেও হয়েছিলো। ফরাসী বিপ্লবের নেতা রবেসপিয়রকে বিপ্লবের পর গিলোটিন করা হয়েছিলো স্ট্যালিনের ডিক্টেটরশিপ ছিলো, প্রোলেতারিয়েত ডিক্টেটরশিপ হিসেবে। এই ডিক্টেটরশিপে লেনিনের কাছের মানুষরা মারা পড়ে। ১৯৩০ য়ের পার্জিং য়ে তার প্রয়োজন পড়ে কেউ টিকে নি।
" সমাজতন্ত্র একদেশে টিকবে না"- বলেছিলো ট্রটস্কি।কারণ, তাকে পুঁজিবাদীরা ঘিরে ফেলবে। তিনি বলেছিলেন- Permanent revoulation য়ের কথা। এই ট্রটস্কিকেও সরিয়ে দিতে হয়।
ইংল্যান্ডে প্রথম পার্লামেন্ট হয়। সেখানে চার্লসের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।ক্রমওয়েল মারা যাওয়ার পর তাঁর মন্ত্রী ছিলেন ছিলেন মহাকবি  মিল্টন; মিল্টন  "প্যারাডাইজ লস্ট" য়ে " রিপাবলিক" য়ের কথা বলেছিলেন। বলেছেন- "it's better to reigning hell to provide heaven। "
ইংল্যান্ডে পার্লামেন্টে বুর্জোয়ারা আসার সাথে সাথে 'এলিট'রা ও ক্ষমতায় এলো। তৈরী হলো ' হাউস অফ লর্ডস" এবং " হাউস অফ কমন্স"।  এই aristocracy শাসন কিন্তু আর Feudal পথে যায় নি। তারা চলেছিলো পার্লামেন্টের রাস্তায়। এভাবে পু্ঁজিবাদকে অনেক সংগ্রামের পথেই যেতে হয়েছিলো। সমাজতন্ত্রকেও যেতে হবে।

" মার্চেন্ট ক্যাপিটাল" গড়ে উঠেছিল ফ্রি মার্চেন্ট তৈরী করে। পুঁজিবাদ স্থাপিত হয় " Industrial Revolution" য়ের পর।
সোভিয়েত পতনের পর আমরা কি দেখলাম? দেখলাম ৯২-৯৩ ' সালে জাপানে অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হলো। স্পেকুলেশন বাড়লো। টোকিও রিয়েল এস্টেটের দাম ইউএসএ-য়ের সমান হয়ে উঠলো। সেই স্পেকুলেশনে দঃ কোরিয়া,তাইওয়ান, হংকং সব জায়গায় ক্রাশ করলো।এরা ছিলো " টাইগার",  হয়ে পড়লো " ক্যাট"! জাপান এখনো সে Stagnation কাটিয়ে উঠতে পারে নি।

২০০৭ সালে আমেরিকায় 'বেইল আউট' ও মন্দা তৈরী হলো।সেখানে জায়গাকে শেয়ারে পরিণত করা হয়েছিলো। পুরোটা এই  speculative ফলাফল। আমেরিকায় শ্রমিকদের বেতন বেড়েছে ৫.৬ শতাংশ আর ধনীদের আয় বেড়েছে কয়েক হাজার গুণ। মাত্র ৬ জন ব্যক্তির আয় ৩৭৫ কোটি মানুষের সমান। তারা জানে না কোথায় তারা invest করবে? এই " concentration of capital " বাড়ছে।
যেভাবে 'ফিউডাল' ধ্বংস হয়েছিলো। সেভাবে " ক্যাপিটালিজম" ও ধ্বংস হবে। আমেরিকা আজ আর 'লো ইন্ডাস্ট্রি' তৈরী করতে পারে না।কিন্তু সেই "হাইটেক" বাজার তার নেই।
চীনের প্রধানমন্ত্রী  সি চিন পিং বলেছে- আমাদের সোভিয়েত থেকে শিক্ষা নিতে হবে। কেন বলেছে? কারন- সোভিয়েতে যা হয়েছিলো তা ছিলো  "কন্সটিটিউশনাল ক্যু"! sign করে তিনটি ফেডারেশন বের হয়ে গেলো। এটা কোন Revolution ছিলো না। কেন? এভাবে ক্যু করে সোভিয়েত পতন হয়েছিলো? কারণ সেখানে পার্টির কোন কন্ট্রোল ছিলো না। জনগণ, রাষ্ট্রের উপর পার্টির নিয়ন্ত্রণ ছিলো না। এই ক্যু হয়েছিলো পার্টির ভেতর থেকে।  সোভিয়েত constitution য়ে  ছিলো ইচ্ছা করলে কোন ফেডারেশন বের হয়ে যেতে পারবে। ১৯১৭ সালে ফিনল্যান্ড বের হয়ে যায়। ইয়েলৎসিন বললো- আমরা বের হয়ে যাচ্ছি। সে প্রথমে জানালো প্রেসিডেন্ট রিগ্যানকে।পরে জানালো গর্বাচেভকে। রুশ ফেডারেশন বের হয়ে গেলে তো আর কিছুই থাকে না। অথচ এর আরা ২বছর আগে ইয়েলৎসিনকে শাস্তি দেয়ার কথা উঠেছিলো। কিন্তু পারে নি।কারণ- পার্টি সুসংগঠিত ছিলো না।
চার্লস বেথেলহেম ' Class struggle in USSR " বইয়ে লিখছে-  'লেনিন বলেছে এটা 'State Capitalism ', সোশ্যালিজম নয়।
সোভিয়েত কখনো এই ব্যুরোক্রেসী থেকে বের হতে পারে নি। পার্টি ও রাষ্ট্র -দুটোতই ব্যুরোক্র্যাট ছিলো। লেনিন চেয়েছিলেন তা মুক্ত করতে,কিন্তু মারা যান,পারেন নি। স্ট্যালিনও চেষ্টা করেছিলো কিন্তু পারেন নি।

শুধুমাত্র রাশিয়ায় নয়, কিউবা,চীন, ভারত, উত্তর কোরিয়া প্রভৃতি দেশে infrastructure তৈরী করে দেয় সোভিয়েত। এই ৩য় বিশ্বের দেশগুলোতে তারা যে সহায়তা করতো তা ছিলো বাজেটের ২০%। মার্কিনীরা প্রোপাগান্ডা চালায় এই বলে যে- আমাদের বিলাসী জীবন আছে,তোমাদের  নেই। এতে সোভিয়েত জনগণ ও ক্ষুদ্ধ হয়। ইয়েলেৎসিন মাত্র ২% জনপ্রিয় ছিলো। আজ পুতিন ও জনপ্রিয় হতে পেরেছে এই কারণে।

সবে তো শুরু, ১০০ বছর তো কিছুই নয় একটা উৎপাদন ব্যবস্থা পাল্টাতে। পুঁজিবাদ যেখানে প্রতি দশ বছর পর  stagnant হয়, সোশ্যালিজম সেখানে মানুষকে সৃজনশীল করে।মানুষকে মানুষের মর্যাদা দেয়। এমন সমাজ ভবিষ্যতে আসবে যেখানে মানুষ কাজের আনন্দে কাজ করবে। উৎপাদন সেই জায়গায় পৌঁছবে, যেখানে মানুষ তার শ্রম বিক্রি করবে না।
         সবাইকে ধন্যবাদ।

( বক্তব্যটি চট্টগ্রামে অক্টোবর বিপ্লব  উদযাপন পরিষদ আয়োজিত সেমিনার চলাকালীন সময়ে হ্যান্ডনোট থেকে সংগৃহীত। কোন কিছু ভুল বা বাদ পড়লে কিংবা খন্ডিত হলে- দুঃখিত)


EmoticonEmoticon