রবিবার, ২২ অক্টোবর, ২০১৭

মহান রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবঃ শতবর্ষের প্রেক্ষাপটে"-

২০১৭ সাল ; মার্ক্সের 'পুঁজি' রচনার সার্ধশত বছর,অক্টোবর বিপ্লবের শতবর্ষ এবং অমর বিপ্লবী চে গুয়েভারার মৃত্যুর পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হতে চলেছে- এ বছর। মার্ক্স যে কথাটি বলেছিলেন -একটা সমাজের 'অবজেক্টিভ কন্ডিশন'য়ের বিকাশের মাত্রায় তার পূর্ণতাপ্রাপ্তি ও বিলুপ্তি ঘটে, অবজেক্টিভ ফোর্স যতই থাকুক না কেন।
জার্মানি ও ইংল্যান্ডের পুঁজিবাদী ব্যবস্থা শক্তিশালী ছিলো।কিন্তু বিপ্লব সফল হয়েছিলো রাশিয়ায়।জার্মানিতে রাশিয়ার চেয়েও শক্তিশালী কম্যুনিস্ট পার্টি ছিলো কিন্তু ক্ষমতায় যেতে পেরেছিলো রাশিয়ার শ্রমিকশ্রেণী।এই ক্ষমতায় যাওয়া বা বিপ্লব আচমকা হয় নি,এর একটা ইতিহাস ছিলো।ছিলো বিপ্লবের লক্ষ্যে পরিচালিত ভাবাদর্শের সংগ্রাম। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বলেছিলেন-" নির্বাচনের জন্য পোস্টার ই যথেষ্ট কিন্তু বিপ্লবের জন্য প্রয়োজন সাহিত্য।"

কোন বিপ্লব আচমকা হয় না। রাশিয়াতেও হয় নি। লেনিন রাশিয়া ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি দেখে বলেছিলেন "weakest bonding of capitalism", "weakest power of imperialism "য়ের কথা, সেখানে আঘাত করারর কথা।লেনিনের সুদক্ষ নেতৃত্বে ও দূরদর্শীতায় ফেব্রুয়ারির পর লেনিনের সঠিক পদক্ষেপ ও কেরেনস্কি সরকারের স্বরুপ উন্মোচনে বলশেভিক পার্টি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো।ফলে দ্রুত তার শক্তি বাড়তে থাকে।ফেব্রুয়ারির আগে বলশেভিকদের খুব কম ক্ষমতা ছিলো। বিপ্লবের সময় আরো একজন মানুষের ভূমিকা আলোচনা করা দরকার -তার নাম ট্রটস্কি।পরবর্তী সময়ে তার ভুমিকা বা সমালোচনা যাই থাকুক বিপ্লবের সময় তার ভূমিকার আলোচনা হওয়া প্রয়োজন।
স্ট্যালিনের ভূৃমিকা অসাধারণ -পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায়।২য় বিশ্বযুদ্ধে তার অবদান হিটলারের পরাজয়। একেবারে মস্কো থেকে বার্লিন পর্যন্ত হিটলার বাহিনীর পশ্চাৎপদসরণ - এটা চারটিখানি কথা না।শুধু আবেগ আর মনোবল দিয়েও তা হতো না। এরজন্য শিল্পায়ন দরকার ছিলো, অর্থনীতি ও বস্তুগত ভিত্তি দরকার ছিলো- যা গড়ে উঠেছিলো স্ট্যালিনের নেতৃত্বে।

বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পারমানবিক বোমা আছে যুক্তরাষ্ট্রে এবং তা পাহারা দিতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হয়। সেই যুক্তরাষ্ট্র তৈরী করলো যুদ্ধজোট NATO, আর এর বিপরীতে সোভিয়েতের নেতৃত্বে তৈরী হলোলো আরেকটা জোট " ওয়ারস" জোট। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্ব ঢুকে পড়লো "ঠান্ডা যুদ্ধ"য়ের যুগে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর দুটো প্রচারণা খুব জোরদার হয়েছিলো যদিও তা অল্প সময়ের মাঝেই ভুল প্রমাণিত হয়।প্রথমটা ছিলো- আর যুদ্ধ থাকবে না, যেহেতু সোভিয়েত নেই। ফলে বিশ্ব এখন যুদ্ধ মুক্ত।
আরেকটি হলো- চরমপন্থা, হিংসা এগুলো থাকবে না। ইতিহাসের সমাপ্তি ঘটেছে সমাজতন্ত্রের পতনে। ফলে বিশ্বে থাকবে উদারনৈতিক গণতন্ত্র।
এই দুটো প্রচারণাই মিথ্যে হয়ে পড়ে অল্প ক'দিনেই।
৯১ সালে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের নতুন ফ্রন্ট তৈরী হলো।২০০১ সালে অনন্ত যুদ্ধের ঘোষণা দেয়া হলো।পরবর্তী সময়ে এটাকেই বলা হতে লাগলো "সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ।"

যদি যুদ্ধ না থাকে, শত্রু না থাকে, প্রতিপক্ষ না থাকে তবে পুঁজিবাদ বাঁচতে পারবে না। তার অর্থনীতির এটা আরেকটা ডিপার্টমেন্ট। তার দুটো Department থাকে অর্থনীতিরঃ
Department of capital এবং
Department of commodity।
তার সঙ্গে যুক্ত হয় আরেকটা-
Department of War & destruction।
পুঁজিবাদ টিকে থাকার জন্য নতুন নতুন পুঁজির ক্ষেত্র তৈরী করে। বাজারের জন্য যুদ্ধ তার লাগবে। এই যুদ্ধের জন্য purchase capability  দরকার হয় না।কারণ, রাষ্ট্রই হচ্ছে তার ক্রেতা। মানুষ যদি খেতেও না পায়, যুদ্ধাস্ত্র ঠিকই বিক্রি হবে।তাই যুদ্ধের পরিস্থিতি থাকলে রাষ্ট্র অস্ত্র কিনতে বাধ্য হবে। সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী রাষ্ট্রই হচ্ছে আমেরিকা।তার উৎপাদন ও বাজার প্রভৃতি ক্ষেত্রে যুদ্ধ বেড়েছে। উদারনৈতিক দেশগুলোতেও বিভেদ, হানাহানি,সাম্প্রদায়িক উস্কানি বেড়েছে। অস্ট্রিয়া, জার্মানি, ফ্রান্স সমস্ত দেশেই এই যুদ্ধ বেড়ে চলেছে, সাথে সাথে বাড়ছে এই যুদ্ধের নির্ভরতা ও উম্মত্ততা।

সারাবিশ্বে অভিবাসী ও রিফুইজির সংখ্যা বাড়ছে এই 'capitalist globalisation' য়ের ফলে।মায়ানমারে রোহিঙ্গারা উদ্বাস্তু হচ্ছে।ইতিহাসের মন্দভাগ্য হচ্ছে এই যুদ্ধের মদদ দিচ্ছে সমাজতন্ত্র থেকে সরে আসা চীন ও রাশিয়া। অক্টোবর বিপ্লব এখানে এটাই প্রমাণ করে -সমাজতন্ত্র থাকলে রাষ্ট্রের চেহারা কেমন হয়,না থাকলে কেমন হয়।
সমাজতন্ত্র মানুষকে অপমান থেকে মুক্তি দেয়।সমাজতন্ত্র মানে খাওয়া পরার সমাধান নয়।অনেক পথেই তা সম্ভব হয়।তার জন্য সমাজতন্ত্র নাও লাগতে পারে।প্রাণীর প্রাণ ধারণ করতে পারা কিংবা প্রয়োজন মেটানোর জন্য সমাজতন্ত্রের প্রয়োজন নয়।বুর্জোয়া অর্থনীতিতে মানুষের এই প্রয়োজন দেখা হয় " proverty line" দিয়ে।এই অর্থনৈতিক সূত্র দিয়ে মানুষের জৈবিক হিসাব করা হয়,যা মানুষকে হিসেব করা হয় প্রাণীর মতো করে।
সমাজতন্ত্র মানে মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখা।তার অর্ন্তনিহিত শক্তির বিকাশ করা। মার্ক্স যেটা বলেছিলেন- ' মুক্ত মানুষের মুক্ত সমাজ।' এর জন্য প্রয়োজন খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান সমস্যা থেকে পরিত্রাণ। প্রয়োজন মানুষের মাঝে বিরাট স্বপ্ন তৈরী করা-অক্টোবর বিপ্লব এটা করেছিল, যেখানে লিঙ্গ, জাতিগত, সম্প্রদায় বিভেদ থাকবে না।সামাজিক ও বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে সে বিকশিত প্রাণ নিয়ে বিকশিত হয়ে দাঁড়াবে।

সমাজতন্ত্রের একটা বড় দূর্বলতাই ছিলো- সমাজতন্ত্র এই পর্যন্ত কখনোই তার অর্ন্তগত ক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার করতে সক্ষম হয় নি।কারণ তাকে ঘেরাও করে রাখা হয়েছিলো। সেজন্য তাকে অনেক কিছুই করতে হয়েছিলো যা তার করার কথা ছিলো না। "চেকা" দরকার হয়ে পড়ে, দরকার হয় গুপ্তচরবৃত্তির। কিন্তু সমাজতন্ত্রের তো আমলাতন্ত্র দরকার হয় না,অন্যের দেশ দখল, যুদ্ধের প্রয়োজন পড়ে না।অন্যের তথ্য-উপাত্ত আড়িপাতা সমাজতন্ত্রের দরকার হয় না।আর এটা করতে গেলে বিপত্তি তৈরী হয়,ফলে পার্টির মধ্যে আমলাতন্ত্র তৈরী হয়।নব্য ধনিক, পুঁজিপতির সৃষ্টি হয়। ১৯১৯ সাল পর্যন্ত ১৪টা দেশ ঘিরে না রাখলে সামরিক বাহিনী নির্ভরতা না থাকলে ব্যুরোক্র্যাটিক উপাদান তৈরী হতো না।
সোভিয়েত থেকে চীন, চীন থেকে কিউবা- এই শিক্ষার ধারাবাহিকতায় পদক্ষেপ গ্রহণ করে।ছোট্ট দেশ কিউবা,তবু হাজার আক্রমণের মুখেও টিকে আছে।কিভাবে? সেখানে তারা পার্টিকে জনগণের সাথে যুক্ত করেছে।নয়তো মার্কিনীরা প্রচন্ড শক্তি, লোভ ও যুদ্ধাস্ত্র দিয়ে শেষ করে ফেলতো।কিন্তু পারে নি। কিউবার নাগরিকরা যারা আমেরিকায় চলে যেতে চায়, তারা বেশ কদর পায় যুক্তরাষ্ট্রের। তবুও কিউবানরা টিকে আছে। পার্টির যা যা কাজ তা তারা জানে,এখানে তার ভূমিকা স্পষ্ট ও খোলাখুলি।

সোভিয়েতে এই পার্টির সাথে জনগণের দূরত্ব তৈরী হয়েছিলো।নষ্ট হয়ে যায় তাদের সম্পর্ক। ফলে আমলাতন্ত্র ও নব্য ধনী তৈরী হয়।

সোভিয়েত আমলে দুটো ঘটনা ঘটে- এক. বার্লিন প্রাচীর ও আরেকটা চেকোশ্লোভাকিয়ায় আক্রমণ - দুটো ঘটনাই ঘটে স্ট্যালিন মারা যাওয়ার পর।আর তারাই স্ট্যালিনের সমালোচনা করে যারা এই ঘটনাগুলো ঘটিয়েছিলো।স্ট্যালিনর সমালোচনা হতে পারে। বিপ্লবীদের সেই সাহস থাকতে হবে পর্যালোচনা করার।আমাদের ও এই সমালোচনা ও পর্যালোচনার সাহস রাখতে হবে কারণ আমরাও এই বিপ্লবের গৌরব ও উত্তরাধিকারী।
আমাদের প্রশ্ন করতে হবে- মস্কো বা পিকিংপন্থী হওয়ার জন্য কোন স্তালিন কিংবা মাওসেতুঙ দায়ী? এই পর্যালোচনা হওয়া প্রয়োজন। প্রথমে দ্বি-বিভক্ত ও পরে বহু বিভক্ত- এই সমালোচনা ও পর্যালোচনা আমাদের করতে হবে।
আমাদের সামনে লেনিন বা মা ও সেতুঙ নেই।আমাদের নিজেদের পায়ে দাঁড়িয়ে নিজেদের মাটিতে বিপ্লবের ভুমি তৈরী করতে হবে।
রাশিয়ার অনেক সিদ্ধান্ত চীন গ্রহণ বা অনুসরণ করে নি, করলে চীনে বিপ্লব হতো না, আবার ভিয়েতনামে বিপ্লব হতো না- যদি চীনের সবকিছু গ্রহণ করতো।

কোন সমাজের বিকাশের রাস্তা সরল ও একরৈখিক হয় না। পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠিত হতে কয়েক শ  বছর লেগেছিলো।ফরাসী বিপ্লবের আরো কয়েকশো বছর আগে পুঁজিবাদ জন্ম নিয়েছিলো।অনেক উত্থান-পতন, রাজতন্ত্রের পূর্নভাব, আরো অনেক সফলতা ও ব্যর্থতা নিয়ে পুঁজিবাদ স্থায়ী হয়।প্যারী কমিউন ছিলো ৭২ দিনের।আর রুশ বিপ্লব সেখানে টিকেছিলো ৭২ বছর! পুঁজিবাদের প্রায় ৪/৫ শ বছর লেগেছিল। মানুষ ক্রমাগত অভিজ্ঞ ও ম্যাচিউরট হচ্ছে,শিক্ষা নিচ্ছে প্রযুক্তি ক্ষমতাও তার বেড়েছে।এটাও প্রমাণ করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে এতো বছর লাগবে না।
সারাবিশ্বের গণহত্যা, ধর্ম-বর্ণ বৈষম্য, প্রকৃতি ও সম্পদ ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষারর আন্দোলন বেগবান করতে হবে।
আজ মস্কো নেই, পিকিং নেই- কিন্তু তার শিক্ষা আছে।আমাদের তত্ত্বচর্চা করতে হবে, সাহিত্য নির্মাণ করতে হবে।এই লড়াই নির্মাণের পথেই আমরা আরো  শতগুণ শক্তিশালী অক্টোবর বিপ্লব করতে পারবো- সেই আশা ব্যক্ত করে আমার বক্তব্য শেষ করছি,
সবাইকে ধন্যবাদ।
( বক্তব্যটি চট্টগ্রামে আয়োজিত সেমিনার চলাকালীন সময়ে হ্যান্ডনোট থেকে সংগৃহিত।কোন কিছু  ভুল বা বাদ পড়লে  কিংবা খন্ডিত হয়ে থাকলে দুঃখিত।)


EmoticonEmoticon