মঙ্গলবার, ৩ অক্টোবর, ২০১৭

ভয়ঙ্কর সুন্দরীঃ হায় ল্যাস ভেগাস !

আমার সাথে অনেকেই হয়তো সহমত হবেন যে, ল্যাস ভেগাসের মতো এতো পরিচ্ছন্ন ও আলোকোজ্জ্বল নগরী পৃথিবীতে খুবই কমই আছে। কলোরাডো নদীর ওপর নির্মিত বাঁধ থেকে যে বিদ্যুত উৎপাদিত হয়, তার আনীত প্রাচুর্যে আলোকোজ্জ্বল এই ল্যাস ভেগাস নগরী। এই নগরী বিশ্ব-ভ্রমণকারীদের কাছে এক প্রার্থিত গন্তব্য। ল্যাস ভেগাসে গেলে যেটা চোখে পড়ে, তা হলো অবিশ্বাস্য রকমের বড়ো বড়ো হৌটেল। একেকটি হৌটেল একেকটি ঐতিহাসিক, পৌরাণিক কিংবা ভৌগলিক থিম নিয়ে নির্মিত। হৌটেলগুলো যেনো একেকটি জাদুঘর।

দিনের আলোতে যেমন-তেমন, সন্ধ্যা নামার সাথে-সাথে আলোকে আলোকময় হয়ে ওঠে এই নগরী, যেনো দিনের বিগত আলোকে ভুলিয়ে দিতে তার আগমন ঘটে। আর, সেই সাথে শুরু হয়ে রাস্তায়, পানশালায়, বিপণীকেন্দ্রে, ভোজনালয়ে এবং সর্বোপরি ক্যাসিনোগুলোতে লোকস্রোত।

লোকদের দেখলে মনে হয় না, এই পৃথিবীতে দুঃখ বলে কোনো কিছু আছে। মনে হয় সুখের সাগরে ভাসতে ভাসতে লোকেরা অবলীলায় আবর্তিত হচ্ছে। সাদা, কালো, হলুদ, শ্যামলা, নানা বর্ণের নানা জাতের মানুষ। বুঝিবা পৃথিবীর সুখী মানুষদের তীর্থস্থান এই লাস ভেগাস। কিন্ত দৃশ্যতঃ এই সুখের সাগরেও দুঃখের হাঙ্গরের উদয় হতে পারে, যেমনটি রোববার রাতে হয়েছে। ল্যাস ভেগাসের উৎসবমুখর লোকসমুদ্রের মধ্যে ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরতে শুরু করলো। এ-পর্যন্ত পাওয়া তথ্য থেকে জানা যায়, ৫৮ ব্যক্তিকে এই সুখের পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়েছে নিকটবর্তী হৌটেলের ৩২তম তলা থেকে চালানো বন্দুকের গুলিতে।

প্রায় ৪০,০০০ মানুষ এসেছিলো সঙ্গীত উৎসবে সঙ্গীত উপভোগ করতে। তারা কি জানতো, তাদের এই সঙ্গীতপ্রিয়তা, এই আনন্দ ও সুখ, যা তারা এই নগরীতে পেতে চেয়েছে এসেছিলো, তা এই নগরীরই কারও কাছে বিষময় বোধ হচ্ছিলো? কী কারণ থাকতে পারে ৬৪ বছর বয়স্ক ষ্টিফেন প্যাডকের নির্বিচারে গণঘাতক হয়ে নিজেকেও হত্যা করার? আমি দুই মাসেরও কম সময় আগে এই ল্যাস ভেগাসে ছিলাম। সপরিবারে বেড়াতে গিয়েছিলাম। এটি ছিলো দুই বছর পর আমার দ্বিতীয় বারের মতো যাওয়া। যেখানে রক্তের বন্যা বইয়ে দিয়েছে প্যাডক, তার কাছেই Luxor Hotel-এ ছিলাম প্রথম বার।

এবার ইচ্ছে করেই যাইনি Luxor-এ। আমি ক্যাসিনো হোটেলে থাকাতে স্বস্তিবোধ করি না। জুয়ো ও জুয়াড়ীদের ব্যাপারে আমার ন্যুনতম ভক্তি নেই, বিশ্বাস নেই। কারণ, জুয়ো এমন এক নেশা, যা যে-কোনো মাদকের চেয়ে অধিক ধ্বংসাত্মক। কিন্তু ল্যাস ভেগাসে হৌটেল মানেই ক্যাসিনো। সত্যি বলতে, Luxor আমার কাছে মৌটেও ভালো লাগেনি। বাইরে থেকে পিরামিডের বিশালত্ব দেখা গেলেও ভেতরের মান তেমন ভালো নয়। অবশ্য আমার ভালো না লাগার কারণ হতে পারে ক্যাসিনোর প্রতি আমার অনাকর্ষণ। তো, এবার যখন সপরিবারে যাবোই ঠিক হলো, আমি খুঁজছিলাম এমন একটি হৌটেল, যেখানে ক্যাসিনো নেই এবং মানেও ভালো। ছেলে-মেয়েকে ল্যাস ভেগাস দেখাবো বলে একটি ভালো পরিবেশের হৌটেল খুঁজছিলাম এবং পেলামও, কিন্তু নামটা আমার অপছন্দেরঃ Trump International!

হ্যাঁ, মার্কিন প্রেসিডেণ্ট ডৌন্যাল্ড ট্রাম্পের নামে ও মালিকানাধীন হৌটেল এটি। তাঁর মতো ব্যক্তি কীভাবে ল্যাস ভেগাসের মতো স্থানে ক্যাসিনো বিহীন হৌটেল খুললেন, তা আমার কাছে রীতিমতো বিস্ময়ের বিষয় বলেই মনে হয়েছে। তবে, আমাদের গোটা পরিবার এই মর্মে সহমত যে, মিঃ ট্রাম্পের উচিত ছিলো শুধু ব্যবসায়ী হয়েই থাকা। Trump Hotel থেকে যে-দিন আমরা কলোরাডো নদীর ওপর হূবার ডাম দেখতে গাইডেড ট্যুরে বেরুলাম, Luxor-এর সামনে দিয়েই গেলাম। আমার পরিবারকে দেখালামও 'সেবার এখানে ছিলাম' বলে। চলতি পথে দু'পাশের ও সামনের ছবি তুলতে তুলতে যাচ্ছিলাম। ছবিগুলো আর দেখা হয়নি।

আজ খুঁজতে গিয়ে দেখলাম আমি Mandalay Bay Hotel-এর একটি ছবিও তুলেছিলাম। এই সেই Mandalay Bay Hotel, যেখান থেকে ঘাতক ষ্টিফেন প্যাডক (Stephen Paddock) অর্ধশতাধিক মানুষ খুন করে নিজেও আত্মঘাতী হয়েছে। ছবিটি গাড়ীর কাঁচ ভেদ করে তোলা বলে স্পষ্টতা আসেনি। আমি জানি না এবং সম্ভবতঃ এখনও পর্যন্ত কেউ জানে না কেনো ষ্টিফেন প্যাডক গণঘাতী ও আত্মঘাতী হলো। ষ্টিফেন প্যাডক যদি ধর্মীয় মৌলবাদী হতো – বিশেষতঃ ইসলামিক মৌলবাদী – আমরা হয়তো প্যারিসের কনসার্ট আক্রমণের মতো একটি বোধগম্য কারণ দিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারতাম। কিন্তু ষ্টিফেনের প্যাডকের এমন কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। সুখের নগরী ল্যাস ভেগাসে দুঃখের দেবতা হয়ে ষ্টিফেন প্যাডকের এই হানা কী কারণে হতে পারে? কী ছিলো তার মনে? হিংসা? ঘৃণা? হতাশা? ক্রোধ? জিঘাংসা? কিন্তু কেনো? তুমি কি উত্তর দেবে হে ভয়ঙ্কর সুন্দরী ল্যাস ভেগাস?

সোমবার ২রা অক্টোবর ২০১৭ লণ্ডন, ইংল্যাণ্ড


EmoticonEmoticon