বুধবার, ৪ অক্টোবর, ২০১৭

সুন্দরী প্রতিযোগিতার কারণে নারীরা মানসিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে

সুন্দরের সংজ্ঞা কি? মানুষের নিজস্ব চিন্তা ও ভাবনা থেকে যা কিছু গ্রহণযোগ্য এবং যা মানব মনে প্রশান্তির সৃষ্টি করে তাই সুন্দর। তবে সুন্দরের সংজ্ঞা ব্যক্তিবিশেষে ভিন্ন ভিন্ন রূপের ও ভিন্ন ভিন্ন মাত্রার হতে পারে। ক এর কাছে নদী সুন্দর, খ এর কাছে পাহাড় সুন্দর। আবার ক ও খ এর কাছে গোলাপ সুন্দর, গ এর কাছে পাতা সুন্দর। একটি নির্দিষ্ট কোন বিষয় বা বস্তু সকল মানুষের কাছে সুন্দর নয়।

মিস ওয়ার্ল্ড, মিস ইউনিভার্স, মিস আর্থ সুন্দরী প্রতিযোগিতা কি আসলে সকল মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য? কিংবা যিনি প্রতিযোগিতার মাধ্যমে মিস ওয়ার্ল্ড, মিস ইউনিভার্স, মিস আর্থ সুন্দরী নির্বাচিত হন তিনি কি আসলে বিশ্ব সুন্দরী? সকল মানুষের কাছে শ্রেষ্ঠ সুন্দরী? কিসের উপর নির্ভর করে বিশ্ব সুন্দরী নির্বাচিত হয়? কারা বিচারক? গুটিকয় বিচারকের দৃষ্টিতে নির্বাচিত সুন্দরীকে কেনই বা বিশ্ব সুন্দরী বলা হয়? একটি প্রতিষ্ঠানের আয়োজনে নির্দিষ্ট মাপকাঠির ভিত্তিতে, নির্দিষ্ট কিছু মানুষের বিচারে নির্বাচিত সুন্দরীকে সারা বিশ্বের মানুষকে বিশ্ব সুন্দরী হিসেবে চেনে ও মেনে নেয়। কিন্তু কেন? প্রতিযোগিতা করে বিশ্ব সুন্দরী নির্বাচন করার উদ্দেশ্যই বা কি? এ ধরনের অজস্র প্রশ্ন আমাদের নাড়িয়ে দেয়।

ধারণা করা হয় সুন্দরী রমণীরা সব সময়ই পুরুষের প্রেরণার উৎস। ইতিহাস থেকে জানা যায়, খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে প্রাচীন গ্রিসে গ্রিক জনপদ করিন্থের নতুন শহর ব্যাসিলিসের উদ্বোধন উপলক্ষে সর্বপ্রথম সুন্দরী প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। করিন্থের তৎকালীন শাসক কিপসেলাস এই সুন্দরী প্রতিযোগিতার প্রবর্তন করেন এবং সে প্রতিযোগিতায় করিন্থের শাসক কিপসেলাসের স্ত্রীকেই সেরা সুন্দরী নির্বাচিত হয়েছিল। ১৮৫৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে সুন্দরী প্রতিযোগিতা প্রথম শুরু হয়। তখন মার্কিন জনগণ এর বিরুদ্ধাচারণ করলে সাথে সাথেই প্রতিযোগিতাটি বন্ধ করে দিতে হয় বাধ্য হয় আয়োজকরা। এর পরের বছর সুন্দরী প্রতিযোগিতার কিছু বিষয় পরিবর্তন করে ‘ফটো সুন্দরী প্রতিযোগিতা’ নামে  সুন্দরী প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। ১৯২১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নতুনভাবে সুন্দরী প্রতিযোগিতার শুরু হয়। কিন্তু এই প্রতিযোগিতা জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণে ব্যর্থ হয়। অনেক বছর পরে  ধীরে ধীরে এই সুন্দরী প্রতিযোগিতা মানুষের ভেতরে আগ্রহ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টিক সিটির হোটেলসমূহের কর্তৃপক্ষরা হোটেলগুলোতে পর্যটকদের বেশি সময় ধরে আটকে রাখার কৌশল হিসেবে মেয়েদের সুইমস্যুটনির্ভর সেই প্রতিযোগিতার আয়োজন করে এবং এটাই আধুনিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার আদি নিদর্শন। এ ছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীতে কর্মরত সুন্দরী নারীদের নিয়ে প্রতিযোগিতার  মাধ্যমে নির্বাচন করা হয় সেনাবাহিনীতে কর্মরত সেরা সুন্দরী। 

১৯৫১ সালে বর্তমান ‘মিস ইউনিভার্স’ প্রতিযোগিতার আদলে আধুনিক সুন্দরী প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের মানুষেরা এই সুন্দরী প্রতিযোগিতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করে এবং এই প্রতিযোগিতার সঙ্গে জড়িতরা কট্টর সমালোচনার তোপে পড়ে; সুন্দরী প্রতিযোগিতার বিজয়ী সুন্দরীকে সমাজের লোকেরা প্রত্যাখ্যান করে। তা সত্ত্বেও আবারও ১৯৫২ সালে ‘মিস ইউনিভার্স’ ও ‘মিস ইউএসএ’ প্রতিযোগিতার শুরু হয় এবং ক্যালিফোর্নিয়ায় ‘মিস ইউনিভার্স’ প্রতিযোগিতা  অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৫৫ সালে ‘মিস ইউনিভার্স’ প্রতিযোগিতাটি টেলিভিশনে প্রচারিত হয়। ফলে এই সুন্দরী প্রতিযোগিতা প্রচার পায় সর্বত্র। ক্যালিফোর্নিয়ায় প্যাসিফিক মিলস নামে একটি ক্লথিং কোম্পানীর পৃষ্ঠপোষকতায় কয়েক বছর এই সুন্দরী প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতিষ্ঠান এই সুন্দরী প্রতিযোগিতা আয়োজন ও পরিচালনা করে। বর্তমানে মিস ইউনিভার্স অর্গানাইজেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান প্রতিযোগিতাটি আয়োজন করে আসছে এবং ১৯৫১ সালে যুক্তরাজ্যের এরিক মোর্লে প্রধান আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতা 'মিস ওয়ার্ল্ড' প্রতিযোগিতার আয়োজন বা শুরু করে। ২০০০ সালে এরিকের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী জুলিয়া মোর্লে আজ অবধি প্রতিযোগিতার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। ১৯৭১ সালের পর বিভিন্ন দেশে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে নানা ধরনের সুন্দরী প্রতিযোগিতা আয়োজিত হয়ে আসছে। কয়েক বছর ধরে মুসলিম বিশ্বের দেশগুলো থেকে নারীরাও এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করছে।

এর ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই। গত ২৯শে সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় 'অন্তর শোবিজ ও অমিকন এন্টারটেইনমেন্ট' এর আয়োজনে বসুন্ধরা আন্তর্জাতিক কনভেনশন সেন্টারের নবরাত্রী হলে অনুষ্ঠিত হয়েছে ‘লাভেলো মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ’ প্রতিযোগিতা। গত জুলাই মাসে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার জন্য তখন ‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ’ নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়া হয়। এরপরেই এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার জন্য প্রাথমিকভাবে প্রায় ২৫ হাজার আগ্রহীরা নাম নিবন্ধন করেন। তাদের মধ্য থেকে কয়েকটি ধাপে বাছাই করা হয়েছে সেরা ১০ জনকে। তার মধ্য থেকে তিনজন 'মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ' হয়েছে; যথাক্রমে প্রথম জান্নাতুল নাঈম, প্রথম রানার আপ হয়েছে জেসিয়া এবং দ্বিতীয় রানার আপ জান্নাতুন সুমাইয়া। প্রতিযোগিতার গ্র্যান্ড ফিনালের বিচারক ছিলেন বিবি রাসেল, জুয়েল আইচ, শম্পা রেজা, রুবাবা দৌলা, সোনিয়া বশির কবির ও চঞ্চল মাহমুদ।

বিচারকদের রায়ে নয়, আয়োজকের পছন্দে নির্বাচন করা হলো ‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ’! এমন সংবাদ শিরোনামে মুখরোচক আলোচনা-সমালোচনায় মুখর চারিদিক। সংবাদ মাধ্যমে জানা যায় যে, জান্নাতুল নাঈম নামের যে প্রতিযোগীকে চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করা হয়েছে, তিনি নাকি বিচারকদের পছন্দের তালিকায় ছিলেন না। যাচাই-বাছাই শেষে বিচারকেরা ভোট দিয়ে যাকে প্রথম নির্বাচিত করেছেন, আয়োজকের নির্দেশে উপস্থাপক তাকে দ্বিতীয় ঘোষণা করতে বাধ্য হন। এ ঘটনায় বিচারকরা নিজেদেরকে অপমানিত বোধ করেছেন বলে পত্রিকার পাতায় পরদিন বক্তব্য দেন। কিন্তু তাহলে অন্যতম বিচারক বিবি রাসেল আয়োজকদের পছন্দনীয় প্রতিযোগীর মাথায় মুকুট পরিয়ে দেন?

পুঁজিবাদের জগতে অন্যতম পণ্যের নাম নারী। নারীর শরীরটাকে পণ্য বানিয়ে পুঁজিতে রূপান্তরিত করেছে ব্যবসায়ীরা। বিশ্ব সুন্দরী প্রতিযোগীতার মাধ্যমে নারীকে মঞ্চে তুলে দর্শকের সামনে উপস্থাপন করে, শারীরিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি নারীর ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধিমত্তা, সাহস, চতুরতা, মানসিকতা, সাধারণ জ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে উপর পরীক্ষা করে যাচাই-বাছাই করা হয়। ঠিক যেন, নারী কোন মার্কেটের কোন দোকানে থাকা পণ্য, ক্রেতা এসে পণ্যটিকে ভালভাবে নেড়েচেড়ে দেখে কিনে নেয়। মাত্র নির্দিষ্ট কয়েকটি ক্যাটাগরির ভিত্তিতে ও গুটিকয়েক লোকের পছন্দানুযায়ী নির্বাচিত ব্যক্তিকে বিশ্বসুন্দরীর খেতাব দিয়ে পৃথিবীব্যাপী পরিচয় করিয়ে দেয়া হবে কোন এক নারীকে। জ্বলজ্বলে কামনার দৃষ্টি নিয়ে ঐ সুন্দরী নারীকে কাছে পাবার আকাঙ্ক্ষায়  উন্মত্ত হবে ধনকুবের পুরুষেরা। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পুরুষেরা সুন্দরী সঙ্গীর বাসনায় স্বপ্নের ঘোরে বিশ্ব সুন্দরীর সাথে কল্পনার রাজ্যে সময় কাটায়।

মাত্র গুটিকয়েক মানুষ সুন্দরের সংজ্ঞা বানিয়ে কিছু নারীকে বিশ্বসুন্দরীর খেতাব দিয়ে মূলত আপামর নারীদের অপমান করছে। যাকে ইচ্ছে বিশ্ব সুন্দরী বানিয়ে সাধারণ নারীদের ছোট করার অধিকার কে দিয়েছে এই প্রতিযোগিতার আয়োজকদের? প্রতিটি মানুষই প্রকৃতিগতভাবে সুন্দর। একটি সুন্দরের সাথে আরেকটি সুন্দরের তুলনা মূলত একটি প্রাধান্য দেওয়া, অন্যটিকে হেয় করা। এটি একটি বর্ণবাদী ধারণা। এর মাধ্যমে নারীর সঙ্গে নারীর উঁচুনিচু ভেদাভেদ তৈরি করে। ফলে অনেক সুবিধাবঞ্চিত নারীরা এ বিভেদ ও কৌশলী ধনতান্ত্রিক রেসিজমের শিকার হয়ে নিজেদেরকে ছোট মনে করতে শুরু করে ও তারা মানসিক ক্ষতির শিকার হয়। যা পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটায়। নারী সুন্দরতাকে ব্যবহার করে পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটানো সুন্দরী প্রতিযোগিতার অন্যতম উদ্দেশ্য। এবং বিভিন্ন কর্পরেট প্রতিষ্ঠানগুলো যে যেখান থেকে পারে এসব ঘিরে নিজেদের ব্যবসার ফেঁদে বসে।

পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পুরুষেরা পুরুষের মনোরঞ্জনের জন্য এ ধরনের সুন্দর ও সুন্দরীর সংজ্ঞা অন্যদের মাথায় গেঁথে দিয়ে সুন্দরী প্রতিযোগিতার আয়োজন করে চলেছে একবিংশ শতাব্দীতে। এমন অনেক মানুষ আছে যারা অন্যের দৃষ্টিতে সুন্দর। মনে মনে এক সুন্দরীর ছবি মনের আয়নায় পুরুষেরা আঁকে ও জীবন সঙ্গী বানানোর স্বপ্ন দেখে। কিন্তু বাস্তবে ঘটে যদি তার উলটো, তবে ওই জীবনসঙ্গীর সঙ্গে সুখী হতে পারে না। কেননা তার মনে থাকে এক ছবি আর বাস্তবে আরেক।

রূপকথার জগতের মতই স্বপ্ন দেখতে ভালবাসে মানুষ। অতীতে এমন একটা সময় ছিল যখন কোন পরিবারে সুন্দরী কন্যার জন্ম হতো, সেই সুন্দরী কন্যাকে গ্রাম বা শহরের মাঝখানে বানানো একটি বাড়িতে থাকতে হতো আর তাকে সমাজের পুরুষদের মনোরঞ্জন করতে হতো। অর্থাৎ ওই নারীর কোন ব্যক্তিগত ইচ্ছার মূল্যায়ন করা হতো না। সে হতো সমাজের সকল পুরুষের ভোগ্যপণ্য। তারই ধারাবাহিকতায় আজো নারীকে পুরুষের ভোগ্যপণ্য বানিয়ে উপস্থাপন করা হচ্ছে বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ।


EmoticonEmoticon