মঈদুল হাসানের 'মূলধারা ৭১' পড়লাম। আসলে তাড়াতাড়ি পড়তে গিয়ে এমন গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের রেফারেন্স লিংকগুলো এবং সহনোটগুলো বাদ দিয়েছি। মূল থিমটা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত মূলত ভারতে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের কর্মকাণ্ড, ভারতের ভূমিকা, চীন, রাশিয়া, আমেরিকার ভূমিকা উঠে এসেছে। এই বইটিকে ৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম দলীল হিসেবে দেখা হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের একান্ত সচিব ছিলেন মঈদুল হাসান। তাঁর দেখা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ঘটনা সম্বলিত বই 'মূলধারা ৭১'। বইটি শুরু হয়েছে ৭১ সালের ২৫ মার্চের গণহত্যা, রাতের মধ্যে শেখ মুজিব কে গ্রেফতার, শেখমুজিবের নির্দেশে আওয়ামীলীগ নেতাদের গোপন জায়গায় আশ্রয় এবং সেখান থেকে সীমান্ত পার হয়ে ভারত চলে যাওয়া। সারাদেশে পাকিস্তানী আর্মির আতর্কিত হামলা এবং ব্যাপক প্রাণহানি। দুএকটি জায়গায় ছোট প্রতিরোধ ছাড়া সারাদেশে পাকিস্তানী আর্মির কতৃত্ব প্রতিষ্ঠা। চট্টগ্রামে প্রথমে একটা প্রতিরোধ হয়েছিল সেখান থেকে প্রথমে আওয়ামীলীগ নেতা হান্নান শাহ পরে মেজর জিয়াউর রহমান ২৭ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। ভারত গিয়ে তাজউদ্দিনের প্রথমে কলকাতায় অবস্থান এবং সেখান থেকে দিল্লী গিয়ে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সাক্ষাত করেন। সেখান থেকে ইন্দিরা গান্ধীর পজিটিভ মনোভাব নিয়ে কলকাতায় এসে একান্ত নিজ উদ্দ্যোগে অস্থায়ী প্রবাসী সরকার গঠন করেন যার প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন নিজে, রাষ্ট্রপতি শেখমুজিবকে করা হয়, তাঁর অবর্তমানে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোস্তাক। এই মোস্তাক তখনকার আওয়ামীলীগ এর মধ্যে দক্ষিণপন্তী রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত। যিনি বার বার চেষ্টা করেছেন প্রধানমন্ত্রী পদে যাবার।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে দেশের ভিতরে যে সীমিত প্রতিরোধ হয়েছিল তা কিছুদিনের মধ্যে স্থিমিত হয়ে যায়। কারণ একটি প্রশিক্ষিত বাহিনীর বিরুদ্ধে কোন ধরণের প্রশিক্ষণ সাংগঠনিক প্রস্তুতি ছাড়াই যুদ্ধটা এসে পড়েছিল। ফলে অল্পকালের মধ্যে এক ধরণের হতাশার সুর বাজতে থাকে। আবার আওয়ামীলীগ এর মত একটি বিভিন্ন শ্রেণী আদর্শের দলের পক্ষে এই যুদ্ধকে জাতীয় গণযুদ্ধে পরিণত করা দূরহ ছিল। কারণ সামনে আওয়ামীলীগ যত হুমকি দেয় না কেন ভিতর থেকে ছিল ফাঁকা। আবার যুদ্ধে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের ভিন্ন ভিন্ন স্বার্থ এবং দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে অংশ নিয়েছে। একটি নিরেট জাতীয় স্বার্থ সেখানে উপস্থিত ছিল না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আওয়ামীলীগ তার দলীয় সংকীর্ণ স্বার্থ থেকে বের হতে পারেনি। ফলে মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামীলীগ এর বাইরে অন্যান্য দলের কর্মীদের নেওয়া হত না। তখনকার কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়ন কর্মীদের প্রথমদিকে যুদ্ধে নেওয়া হয় নাই। পরে যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন এর সমর্থন ও সহযোগীতার কারণে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের একান্ত ইচ্ছায় অন্যান্য দলের কর্মীদের যুদ্ধে যোগদান করতে দেওয়া হয়। কিন্তু এটা আওয়ামীলীগ এর একাংশের মধ্যে বিরোপ প্রভাব ফেলে। আবার ভারতীয় র এর উদ্দ্যোগে ছাত্রলীগের নেতাদের নিয়ে গড়ে উঠে 'মুজিব বাহিনী' নামে আরেক গ্রুপ। যার নেতৃত্বে শেখ মনি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক এবং তোফায়েল আহমদ। এরা আবার প্রবাসী সরকারের নিয়ন্ত্রণে ছিল না। তাঁদেরকে আলাদাভাবে ভারতীয় বাহিনীর নিজস্ব উদ্দ্যোগে জেনারেল উবান এর মাধ্যমে ট্রেনিং দেওয়া হত। শেখ মনি তাজউদ্দিনের প্রধানমন্ত্রী হওয়া মেনে নিতে পারেননি। ফলে বিরোধ গেলেই ছিল। এগুলো শেষপর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের ক্ষতি করেছে।
একটি বিশাল শরণার্তীর চাপ ছিল ভারতের উপর। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সহ ভারতের সীমান্ত এলাকার জনগণ যে আন্তরিকতা এবং সহযোগীতা করেছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু ভারত সরকারের সহযোগীতার মূলে ছিল তাঁদের নিজস্ব রাজনৈতিক স্বার্থ। একদিকে শরণার্তীর চাপ আর অন্যদিকে ভারতের দুইদিকে পাকিস্তান এটা ভারতের জন্য ছিল একটা বাড়তি চাপ। ফলে বাংলাদেশকে আলাদা করে তাঁদের নিজস্ব অধীনস্থ করা ছিল তাঁদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, যা এখনো এইদেশের জনগণ বয়ে ভেড়াচ্ছে।
আবার মুক্তিযুদ্ধে অতিমাত্রায় ভারত নির্ভরতা এবং ভারতের হস্তক্ষেপ আমাদের জন্য কখনই শুভকর ছিল না। ফলে বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও ভারতের একটি ক্রীড়নক রাষ্ট্রে পরিণত হয়। যা একসময় উপলব্ধি করেছিলেন কমরেড সিরাজ শিকদার। ১৯৬৮ সালে তিনি তিনি পূর্ব বাংলার শ্রমিক কৃষক এবং সাধারণ মানুষকে নিয়ে ভারতীয় আগ্রাসন মুক্ত জাতীয় গণযুদ্ধের কথা বলেছিলেন। যদিও এটাকে বাস্তব রূপ দিয়ে সাংগঠনিক শক্তি নির্মাণ করা কঠিন ছিল। আবার এদেশের বামপন্থী এবং কমিউনিস্ট নামধারী দলগুলোর আন্তঃবিরোধ, মানুষের আকাঙ্ক্ষা ধরতে না পারার কারণে নেতৃত্ব চলে যায় আওয়ামীলীগ এর মত মধ্যপন্তী দলের হাতে। ফলে একদিকে অতিমাত্রায় ভারত নির্ভরতা আর অন্যদিকে সুবিধাবাদী নানা স্বার্থের মানুষের কাছে মুক্তিযুদ্ধ নিরাপদ ছিল না। এদের একটি অংশ পরবর্তীতে লুটপাটে অংশগ্রহণ করেছে। এজন্য মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল তাহের দীর্ঘমেয়াদী গণযুদ্ধের কথা বলতেন যার মধ্য দিয়ে এদেশের মানুষ নিজেকে খাঁটি হিসেবে গড়তে পারে। কিন্তু শেষপর্যন্ত ভারতীয় ইচ্ছায় মাত্র নয় মাসে মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়, কিন্তু মুক্তি এখনো আসেনি।
EmoticonEmoticon