মঙ্গলবার, ১০ অক্টোবর, ২০১৭

"গল্প নয় সত্যি" - ০৫

মাস পূর্ন হবার আগেই ভদ্রলোক চলে যান তার কর্মস্থলে৷ সপ্তাহ খানেক বাদে আমিও চলে এলাম বাবার বাড়ীতে৷
পড়ালেখায় মন দিলাম আগের মতই করে৷
সপ্তাহের রবিবার ভদ্রলোকের অফ-ডে সেদিন তার সাথে ফোনালাপ হত ৷ তখন তো হাতে হাতে মুঠো ফোন ছিলোনা, বাজারে মাত্র একটা ফোনফ্যাক্সের দোকান ছিলো৷ ফোন করে টাইম বলে দিত সেখানে থাকার জন্য, বাজার থেকে বাড়িতে খবর পাঠানো হত তারপর গিয়ে কথা বলতে হত ৷
সপ্তাহ দুই ঠিকঠাক মতই কথা হল তারপর থেকে তার মধ্যে একটা পরিবর্তন!
তিনি বলতেন আমাদের সম্পর্কটা কন্টিনিউ করা সম্ভব নয়, কারন তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে বিয়ে করানো হয়েছে ৷
তিনি তার প্রেমিকাকেই বিয়ে করবেন, সংসার করতে হলে তার সাথেই করবেন৷
আর আমি যেন স্ব—ইচ্ছায় তার থেকে সরে যাই, বিনিময়ে তিনি আমাকে মোটা অংকের টাকা দিবেন!
প্রতি সপ্তাহে আমাকে ফোন দেবার আগে তিনি তার প্রেমিকার সাথে কথা বলতেন,তারপর আমাকে ফোন দিয়ে কথা বলতেন, জানতে চাইতেন আমি কি চিন্তাভাবনা করলাম বা কি করবো? 
সে যদি রিলেশনটা না রাখে তাতে জোর করার কিছু নেই ৷ তবু কেন আমাকে প্রেশার দিচ্ছিলো জানিনা, তাছাড়া এ বিষয়ে আমার কিছুই করার ছিলোনা৷ পরিবারের কাউকে বল্লেও দোষ আমাকে দেয়া হত, তাই কাউকে কিছু বলা হত না ৷
এভাবেই চলে গেলো একটা বছর৷ এর মাঝে আমার প্রিয় মানুষটি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে ৷দাদীকে হারানোর কষ্ট কাটাতে বেশ সময় লেগেছিল ৷সব চিন্তা বাদ দিয়ে পড়াশোনা নিয়েই ব্যস্ত রইলাম, মাসে দু একবার একদিনের জন্য ও বাড়ি যেতাম ৷
একদিন সকাল বেলা স্কুলে যাবো ঠিক সে সময়ে দেখি ননদের ছেলে এসেছে আমাকে নেবার জন্য, জানতে পারলাম ভদ্রলোক একদিন আগে দেশে ফিরেছেন৷ নিরুপায় হয়ে যেতে হল শ্বশুর বাড়ী৷
আমাকে দেখেই তিনি বেশ বিরক্ত হলেন দেন বলেও ফেল্লেন আমি কেন ও বাড়িতে গিয়েছি ?
কেন গিয়েছি তার কোন উত্তর আমার জানা ছিলো না ৷
লম্বা ছুটি নিয়ে এসেও তিনি পনেরো দিন থেকে আবার চলে গেলেন প্রবাসে৷ আমিও ফিরে এলাম বাবার বাড়ীতে৷
আবার পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ততা৷
মাস পেরুবার আগেই নিজের মধ্যে কিছু একটার অস্তিত্ব অনুভব করলাম!
মাথা ঘোরা,বমি হওয়া, খেতে না পারায় সিউর হলাম আমার দেহের মধ্যে আরো একজন জায়গা করে নিয়েছে ৷
সে এক অন্য রকম অনুভূতি!  কাউকে বলে বুঝানো সম্ভব নয় ৷এটা যেনে  পরিবারের সবাইকে বেশ আনন্দিত দেখলাম৷
ততদিনে ভদ্রলোকের আচরণগুলো আম্মুর সাথে শেয়ার করতাম,একে একে পরিবারের সবাই জানতে পারলো ভদ্রলোক চান না সম্পর্কটা টিকে থাকুক ৷
তাই সবাই ধারনা করলেন বেবীটা হলে তার মধ্যে পরিবর্তন হবে৷
আমিও তেমনটাই বিশ্বাস করলাম বেবী হবার খবরটা তিনি জানতে পারলে সব থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিবেন ৷
একদিন রোববার এক দাদীকে সঙ্গে নিয়ে(শরীর খুব দূর্বল থাকার জন্য)  ফোনফ্যাক্সের দোকানে গেলাম কথা বলার জন্য ৷ আমি খুব উত্তেজিত ছিলাম খবরটা দেবার জন্য, বা তিনি খবরটা শুনে কতটা আনন্দিত হন সেটা দেখার জন্য ৷
ফোন এলো——
কথাও হলো, তবে তিনি একটুও খুশি হননি, বরং বেশ রেগে গেলেন আর আমাকে বল্লেন যত দ্রুত সম্ভব আমি যেন বাচ্চাটা নষ্ট করে ফেলি! যেখানে আমাদের সম্পর্কটাই টিকবেনা সেখানে বচ্চার তো প্রশ্নই আসেনা ৷ আমিও বেঁকে বলসাম বল্লাম আমি বাচ্চা নষ্ট করবোনা ৷তিনি আরো রেগে গেলেন৷
সেদিন তার সাথে প্রথম আমার খুব ঝগড়া হয়,
তিনি এক পর্যায়ে বলেন এ বাচ্চার দ্বায়ভার সে নিতে পারবে না ৷ দেন তিনি সবাইকে এটাও বলবেন এ বাচ্চা তার নয় ৷
দাদী সমস্ত কথা আম্মুকে বল্লেন,পরিবারের সবাই এমন কথা শুনে আমার উপর প্রেশার দিতে শুরু করলেন বাচ্চা নষ্ট করার জন্য ৷ কিন্তু আমি তখনও আমার জায়গায় অটূট!  কোন ভাবেই আমি আমার সন্তান নষ্ট করবো না ৷
শুরু হয় প্রতি নিয়ত আম্মুর সাথে আমার যুদ্ধ! তিনি আমাকে এক মুহুর্ত সহ্য করতে পারেননা ৷ আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিলেন, খেতে বসলেও ডাকতেন না,  আম্মু তার অন্য সন্তানদের নিয়ে খেতে বসতেন, শুধু আমি ছাড়া ৷
ভদ্রলোক আমার সাথে টোটালি যোগাযোগ বন্ধ করে দিলেন, দেন পরিবারের সবাইকেও বারণ করে দিলেন আমাদের সাথে যেন কোন রকম যোগাযোগ না করা হয় ৷
সে সময়গুলো আমার কাছে যে কতটা ভয়াবহ ছিলো বলা বাহুল্য৷
সকাল বিকেল দুবেলা এলাকার ছোট বাচ্চাদের পড়ানো শুরু করলাম,  সকালে আরবী বিকেলে বাংলা ৷ এমন দিন অপেক্ষা করবে ভাবতে পারিনি, সামান্য অর্থও আমার কাছে জমা ছিলোনা ৷
সকাল বিকেল যেটুকু সময় বাচ্চাদের নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম সে টুকু সময় ভালোই যেত বাকি সময়টা কাটত বিষন্নতায় ৷
আমার গর্ভধারিনী আমাকে বেশ অবাক করে দিয়েছিলেন সে সময়, গর্ভাবস্তায় কখনো তিনি কাছে এসে জিজ্ঞেস করেননি তোর শরীর কেমন?  তোর কিছু খেতে ইচ্ছে করে কিনা ?  তোর জন্য কিছু রাঁধবো কিনা ? 
তবুও সময় থেমে থাকেনি, সময় গিয়েছে তার নিয়মে ৷
তখন রাত ১২ টা আম্মু ,ছোট বোন, ছোট ভাই সবাই ঘুমে বিভোর ৷ হঠাৎ কোমরের মধ্যে চিনচিন ব্যথা অনুভব করলাম,  তারপর একটু একটু করে বাড়তে শুরু হল, যখন ব্যথা বাড়ে শোয়া থেকে উঠে বসি, যখন কমে যায় আবার শুয়ে পড়ি৷
সারারাত উঠ বস করেই কাটিয়ে দিয়েছি তবু আম্মুকে ডাকার সাহস পাইনি৷
ফজরের আজান কানে ভেসে আসতেই বুঝলাম ভোর হয়েছে, তখন ব্যাথাটাও বেড়ে শতগুনে চলে গিয়েছে ৷ আমি উঠে পায়চারী করা শুরু করি, ভাবি হয়ত ব্যাথাটা কমে যাবে ৷
শরীর ঘামতে শুরু করে,আমি দাড়িয়ে থাকার মত কোন শক্তি খুঁজে পাইনা,দেয়াল ধরে ধরে সামনের বারান্দার খাটে গিয়ে শুয়ে পড়ি আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে,  তখনি দশমাস পর মা বলে চিৎকার দিয়ে উঠি ৷
খুব ভালো ভাবেই একটা কন্যা শিশুর জন্ম দেই৷
আম্মু আবার আমাকে অবাক করিয়ে দিয়ে বলেন সাউয়াই যখন হবে তখন মরা হইলেই পারত ৷
আমার মেয়ে হয়েছে বলে আম্মু খুশি হয়নি, সে ভেবেছিলো হয়ত ছেলে হবে ৷
অদ্ভূত!  আম্মু একটি বারের জন্য আমার মেয়েটিকে কোলে নেয়নি বরং পরদিন আমাকে ঐ অবস্থায় একা রেখে তিনি তার বড় মেয়ের বাড়ি বেড়াতে চলে যান.......


EmoticonEmoticon