শুক্রবার, ১৩ অক্টোবর, ২০১৭

রুশ বিপ্লব শতবর্ষ বার্ষিকী উপলক্ষে

দুনিয়ার বুকে অসংখ্য ছোট বড় বিপ্লব হয়েছে। কিন্তু ব্যাপ্তি এবং বিশালতার কারণে দুইটি বিপ্লব ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে। এর মধ্যে প্রথমটি হল ফরাসি বিপ্লব। যার ব্যাপ্তিকাল ছিল প্রায় দশবছর (১৭৯০-১৭৯৯)। এর মধ্যে ভাগে ভাগে বিপ্লব হয়েছিল। ফরাসি বিপ্লব কে আমরা সাধারণত বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব হিসেবে জানি। এর আগে ইউরোপে বিভিন্ন ধরণের সংস্কার এবং বিপ্লব হয়েছিল। তারও আগে ইংল্যান্ডে শিল্প বিকাশের মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদী অর্থনীতির যাত্রা শুরু হয়। এর সাথে সাথে বুর্জোয়া শ্রেণী হিসেবে নতুন একটি শ্রেণীর উৎপত্তি ঘটে যারা পুরাতন সমাজব্যবস্থা ভেঙ্গে নতুন সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলে। কেমন হবে সেই সমাজ? পুরাতন সামন্ততান্ত্রিক রাজা বা ভূমির উপর সামন্তীয় জমিদারের কতৃত্ব ভেঙ্গে মালিকানার ক্ষেত্রে ব্যক্তির ব্যক্তিগত মালিকানা এবং ভূমির উপর ব্যক্তির ভোগের ধারণা তৈরি করে। সাথে সাথে রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যক্তির অংশগ্রহণ এবং ভোটদান ছিল বুর্জোয়া ব্যবস্থার অন্যতম ভূমিকা। আগের সমাজে ধর্ম ছিল সামন্তীয় রাজার সাথে গাঁটছাড়া বেঁধে বেঁচে থাকতো। কিন্তু বুর্জোয়ারা রাষ্ট্রের সাথে ধর্মকে পৃথক করার প্রথম দাবি করে। ফলে রাষ্ট্র পরিচালনায় ধর্ম বা ধর্মের পুরোহিতদের কতৃত্ব লোপ পায়। তাই ফরাসি বিপ্লব ফ্রান্সে সংগঠিত হলেও এর ব্যাপ্তি ছিল বিশ্বব্যাপী। কিন্তু ফরাসি বিপ্লবের সীমাবদ্ধতা হল অর্থনীতির মালিকানার প্রশ্ন। কারণ বুর্জোয়ারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর পুঁজিবাদী অর্থনীতি বিকশিত হতে থাকে। এর ফলে অর্থনীতিতে উৎপাদন ব্যাপক হতে থাকে। শিল্পায়ন এবং বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কার উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিশাল পরিবর্তন নিয়ে আসে। কিন্তু এর সাথে সাথে সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য ধীরে ধীরে ব্যাপক হতে থাকে। একদিকে একদল মানুষের হাতে সম্পদ করায়ত্ত হয় আর অন্যদিকে সমাজের বিশাল একটি অংশ উৎপাদনে অংশগ্রহণ করলেও তাঁদের জীবনযাত্রা কষ্টকর হয়ে উঠে। ফলে সামাজিক বৈমষ্যের কারণে উৎপাদন ব্যবস্থায় অংশগ্রহণকারী শ্রমিকরা ক্ষোভ বিক্ষোভ প্রদর্শন শুরু করে। এ নিয়ে সমাজতাত্ত্বিকরা নানাভাবে চিন্তা করছেন। আসলে সংকটের কারণ কী? উৎপাদন বিশাল হলেও কেন সমাজ বিশাল অংশ অভুক্ত থাকে বা ঠিকমত চলতে পারে না। অনেক সমাজতাত্ত্বিকদের নানা রকমের মতামতের পর কার্ল মার্ক্স নিজস্ব গবেষণা, অভিজ্ঞতা, ইতিহাসে সমাজ বিকাশের কালপর্ব পর্যালোচনা করে এই স্বিদ্ধান্তে পৌছান যে সমাজে এই সংকটের মূলে হল মালিকানার প্রশ্ন। পুরাতন সামন্তীয় মালিকানা থেকে সমাজে ব্যক্তি মালিকানার উদ্ভব হলেও এখন নতুন ধরণের সংকট দেখা দেয় তা হল ব্যাপক প্রতিযোগীতামূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় কিছু মানুষের হাতেই সম্পদ কুক্ষিগত হয়। তাই সমাজে মালিকানার পরিবর্তন করতে হবে। ব্যক্তি মালিকানা বিলুপ্ত করে সামাজিক মালিকানা স্থাপন করতে হবে। যার মাধ্যমে গড়ে উঠে মার্ক্সবাদ বা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের দার্শনিক মতবাদ। এর ফলে ইউরোপে সমাজতন্ত্রের ভিত্তি হিসেবে মার্ক্সবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়।

প্রথম বিল্পবের কথা বলছিলাম ফরাসি বিপ্লব। আর দ্বিতীয় বিপ্লব হল রুশ অক্টোবর বিপ্লব। অক্টোবর বিপ্লবের বিশালত্ব হল তা মার্ক্সবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করে সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যাভিমুখে নতুন ধরণের সমাজ নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। প্যারি কমিউনের পর শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে প্রথম সমাজ ব্যবস্থার স্বপ্ন লালন করে এই বিপ্লব এগিয়েছিল। কিন্তু রুশ দেশে বিপ্লব হলেও অর্থনীতি ঠিক শিল্প বিকশিত ছিল না। কিছু কিছু শিল্পায়ন হলেও উন্নত পুঁজিবাদে যে শিল্পায়ন ও সমাজের সংস্কার হয় তা সেখানে সেইভাবে হয় নাই। তারপর ১ম বিশ্ব যুদ্ধের ব্যাপক ক্ষয়কতির পরে ভঙ্গুর অর্থনীতি নিয়ে সোভিয়েত রাশিয়ার পথচলা। অন্যদিকে শিক্ষাক্ষেত্রে পশ্চাদপদতা, মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তার ক্ষেত্রে একটি পশ্চাদপদ দেশে সমাজতন্ত্র গড়ে তোলা কঠিন ছিল। প্রথমে বড় বড় অর্থনীতিকে রাষ্ট্রীয় অধীনে রেখে পুঁজিবাদী অর্থনীতি এবং শিল্পের বিকাশ ব্যাপকহারে হতে থাকে। প্রতি ৫ বছরব্যাপী প্লাণে অর্থনীতি দ্রুততম সময়ে বিকশিত হলেও সামাজিক সম্পর্ক বিকাশে ব্যাপক উন্নতি হয় নি। আবার কমিউনিস্ট পার্টি এবং নেতৃত্বের মধ্যে একটি পেটিবুর্জোয়া ক্লাস জন্ম নেয় যারা মূলত সুবিধাভোগী অংশ। হর্থাৎ মূল উৎপাদক শ্রেণী শ্রমিকদের উপর ক্ষমতা না গিয়ে ক্ষমতা চলে গিয়েছিল একটি সুবিধাভোগী শ্রেণীর হাতে। এটাই মূলত সোভিয়েত ইউনিয়নের মূল সংকট যে সেখানে প্রলেতারিয়েত একনায়কতন্ত্র বলতে যা বুঝায় তা প্রলেতারিয়েত শ্রেণীর হাতে ক্ষমতা না থেকে একটি আমলাতান্ত্রিক পেটিবুর্জোয়া শ্রেণী সেখানে ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছিল। আবার এর অন্যতম সংকট ছিল এরা নিজেদের নিয়ে এত ব্যস্থ ছিল যে বিশ্বের অন্যান্য জায়গায় বিপ্লব গড়ে তোলা বা সহযোগিতা করা, সেই ক্ষেত্রে খুব মনোযোগী ছিল না। ফলে একদেশীয় সমাজতন্ত্র তত্ত্ব বাস্তবে মার খেয়েছে। এভাবে গোটা দুনিয়া পুঁজিবাদী আর একা সমাজতন্ত্র বেশিদূর যেতে পারে না। ফলে এর পরিণতি যে ভাল হবে না বুঝা যায়। তবে শিক্ষা স্বাস্থ্য শিল্পায়নের ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি করেছিল। কিন্তু এর পরও কেন এটি ঠিকলো না এটা আজকের দিনে খুবই অগুরুত্বপূর্ণ। একদিকে আমলাতন্ত্রের বিকাশ, এর মধ্য দিয়ে দুর্নীতি গড়ে উঠে আর অন্যদিকে একদেশে সমাজতন্ত্র। এগুলো বাস্তবে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে এগিয়ে নেয় না। আবার দমনপীড়ন কঠোর নিয়মকানুন অত্যাচার নির্যাতন ও পতনের জন্য সমানভাবে দায়ী। সমাজ অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশ, পরিচালনা ক্ষেত্রে জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণ এবং পুরাতন পুঁজিবাদী ধরণের আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ভেঙ্গে সম্পূর্ণ শ্রমিক শ্রেণীর নিয়ন্ত্রণাধীন ব্যবস্থা হতে পারেনি। ফলে আজকের দিনে কর্তব্য হল পুরাতন ভুল ভ্রান্তি স্বীকার করে এর থেকে অভিজ্ঞতা নেওয়া। কোন এক নেতাকে অন্ধ অনুকরণ না করে তাঁর ত্রুটি বিচ্যুতিগুলো মেনে নিয়ে ব্যাপক আলোচনা করা। তা না হলে পুরাতন সংস্কার থেকে বেরিয়ে আসা যাবে না। একদিকে যেমন রুশ বিপ্লবের অভিজ্ঞতা নিতে হবে অন্যদিকে এর সীমাবদ্ধতা নিয়ে আলোচনা করতে হবে। এটাই হবে অক্টোবর বিপ্লব শতবর্ষ বার্ষিকীর আলোচ্য বিষয়। অক্টোবর বিপ্লব বেঁচে থাক, কমরেড লেনিন লাল সালাম, দুনিয়ার মজদুর এক হও!


EmoticonEmoticon