শনিবার, ১৪ অক্টোবর, ২০১৭

কিশোর কুমার থেকে সাবধান

কিশোর কুমার ছিলেন ভীষণ খেয়ালি মানুষ। তিনি নিজের বাড়ির সামনে লিখে রাখতেন ‘বি অ্যাওয়ার অফ কিশোর কুমার’(কিশোর কুমার থেকে সাবধান)। একবার এক পরিচালককে কামড়ে দিয়েছিলেন। আরেক পরিচালককে তিনি আলমারির ভিতর ঘণ্টা দুয়েক বন্ধ করে রাখেন। পারিশ্রমিকের অর্ধেক টাকা পাওয়ায় একবার সিনেমার সেটে অর্ধেক মেকআপ করে হাজির হন। আরেকবার এক নাছোড়বান্দা পরিচালককে বলেন যদি তিনি সকলের সামনে কুকুরের মতো ঘেউ ঘেউ করেন তবেই তার ছবিতে তিনি কাজ করবেন। তার বাড়িতে সাক্ষাৎকার নিতে আসা এক সাংবাদিককে তিনি বাগানে নিয়ে গিয়ে গাছদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন নিজের বন্ধু হিসেবে।
মাত্র ছয় বছর বয়সে কোনো এক অজ্ঞাত কারণে কণ্ঠস্বর হয়ে যায় খড়খড়ে। ওই শিশুর গলার আওয়াজ শুনলে মানুষ বিরক্ত হতো। আর ওই শিশুই যদি গলা ছেড়ে গান ধরত? অসহ্য ঠেকত অন্যদের কাছে। সবাই যেন বলতে চায়- থাক বাবা গান না অন্য কিছু করো। একদিন বাড়িতে রাখা বটিতে পা কেটে যায় ওই শিশুর। রক্ত বন্ধ হচ্ছে না। বন্ধ হচ্ছে না শিশুর কান্না। পায়ে লাগল সেলাই। তাতে বাড়ল যন্ত্রণা আর কান্না দুটোই। কাঁদতে কাঁদতে ওই শিশু একসময় ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম ভাঙার পর শিশুটি ডাকছে সবাইকে। একি? ওর গলার স্বরই গেছে বদলে। এও কি সম্ভব?
দাদা অশোক কুমারের বর্ণনায় এভাবেই এসেছেন কিশোর কুমার ।
শিশুটির নাম রাখা হয়েছিল আভাস কুমার। যাকে সারা বিশ্ব চেনে কিশোর কুমার নামে। বাংলা ও হিন্দিগানে যুগের পর যুগ সব ধরনের শ্রোতাদের মন এখনো জয় করছেন তিনি। শুধু গান নয়, অভিনয়েও মাতিয়েছেন রুপালি পর্দা।

একদিনের ঘটনা, বছর তিনেকের শিশু কিশোরকে কাঁধে চাপিয়ে বাবা কুঞ্জলাল বের হতেন হাটে-বাজারে। রাস্তায় অসংখ্যবার থামতে হতো তাঁকে। সমাজের উঁচুতলার মানুষ বলে সবাই তাঁকে যথেষ্ট সমাদার করতেন। কিন্তু পথে বেরিয়ে বাবার কাঁধে চেপে যেতে যেতে শিশু কিশোর বাবার টাকে চাপড় মেরে তবলা বাজানোর স্বাদ পেতেন।
খুব কম লোকই হয়ত খুঁজে পাওয়া যাবে যাদের কিশোর কুমারের গান ভাল লাগে না। আমার, আমাদের শৈশব কৈশোরের অনেকটা সময় কিশোর কুমার শাসন করেছেন।
তার কাছেই প্রথম শোনা পৃথিবী বদলের গান, সুখজাগানিয়া প্রেম , কিংবা হতাশার অভিমানে নিজেকে খুঁজা ।এমনি করে আমাদের প্রেমে-দ্রোহে-আনন্দ-বেদনায় এই দরাজ গলা সাথে সাথে থেকেছে-----
কিশোর কুমার পৃথিবীতে একবারই আসেন---তারপর জন্ম-জন্মান্তর ধরে চলে তাঁর স্তবগাঁথা।
১৯৮৭ সালের ১৩ই অক্টোবর ৫৮ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চলে যান না ফেরার দেশে । তাঁর আত্মা এখনও বাংলা গানের সঙ্গেই । তিনি এখনও যেমন চিরসবুজ , তেমনি বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল ।
গৌতম ঘোষ বলেন কোনও শিল্পীকে ছোট না করেই একটা কথা বলতে পারি, কিশোর কুমার এক জনই। আর জন্মাবেন না। আসলে গান তো ঠাকুর গড়ার মতো। মিউজিক ডিরেক্টর কাঠামো তৈরি করে দেন। তাতে রং দিয়ে সম্পূর্ণ করাটা তো শিল্পীর কাজ।
একটা ঘটনা বলি। সুজিত গুহ একটা ছবি করেছিলেন, আশা-ভালবাসা। সেখানে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আর বাপ্পি লাহিড়ির সুরে একটা গান গেয়েছিলেন কিশোর কুমার, ‘নটবর নাগর তুমি করো না মস্করা’। গানের আগে পুলক বাবুকে ডেকে স্যর জিজ্ঞেস করেছিলেন, এই নটবরটা কে? পুলকবাবু বলেছিলেন ভিলেন। তখন কিশোর কুমার বলেছিলেন, ‘নটবর কে জানেন? এ তো শ্রীকৃষ্ণের নাম। এমন অসাধু একটা লোকের নাম নটবর হল কেন? হঠাত্ করে গানটা শুরু হলে জমবে কি না আমার সন্দেহ আছে। আমি একটু জমিয়ে দেব?’ আপনারা লক্ষ করবেন, ওই গানটা শুরুর আগে উইদআউট মিউজিক একটা ডায়লগ আছে, ‘যা যা যা যা গোপাল, যা ব্যাটা গরু চড়া’— ওটাই স্যরের জমিয়ে দেওয়া। এমন অজস্র গল্প রয়েছে। গল্প তো নয়, এ সব সত্যি ঘটনা।
কিশোর কুমার না জন্মালে পৃথিবীটা এত রোমান্টিক কখনোই হত না!


EmoticonEmoticon