চারদিক গুমোট পরিস্থিতি। এক অজানা আতঙ্ক ও অস্বস্তি গ্রাস করেছে সবাইকে।রুমের মাঝে চারজন মানুষ -সবাই চিন্তিত। যেন অসহায় হয়ে বসে থাকা ছাড়া আর কোন কাজই তাদের করার নেই। শীতের সন্ধ্যায় কনকনে হাওয়া তাদের এই নিস্তব্ধতাকে যেন মাঝে মাঝে বিদ্রূপ করে চলেছে।প্রাসাদের রুমের মৃদু আলোতেও লোকগুলো তাদের দুঃশ্চিন্তাগুলো লুকোতে পারছে না।এদের মধ্যে আছেন রাজ্যের মন্ত্রীসভার প্রধান, সম্রাটের ব্যক্তিগত উপদেষ্টা, পুলিশের প্রধান কর্মকর্তা এবং গোয়েন্দাবাহিনীর প্রধান।
অন্যসময় হলে এই সন্ধ্যায় প্রাসাদের প্রতিটি কোণে কোণে থাকতো হৈ হুল্লোড় ও ফূর্তির মেজাজ।শীতকালীন এই প্রাসাদে সমাজের অভিজাত,রাজন্যবর্গ, রাজনৈতিক নেতা, মন্ত্রী-আমলা, বিদেশী নানান অতিথির সমাগম ঘটতো।সারারাত চলতো তাদের আড্ডা, নাচ,কোলাহল। এজন্য রাজকোষের বিশেষ বরাদ্দ ও হতো। কিন্তু আজ সেই সবই যেন হাওয়া, শহরের প্রধান প্রধান সড়কগুলোতে ব্যারিকেড দেয়া হয়েছে।কাফ্যু চলছে সমস্ত শ্রমিক এলাকায়। কোন বিশৃঙ্খলা দেখলেই গুলি করার নির্দেশ দেয়া আছে,তবু যেন শান্তি নেই এই প্রাসাদে, প্রাসাদের মানুষগুলোর মনে। এই অশান্তিটাই যেন জমাট বেঁধে আছে ঘরটিতে।
উপদেষ্টাঃ মন্ত্রীমশাই! কি ভাবছেন? কাল আপনার মন্ত্রীসভার মিটিং হবে তো? নাকি এরই মধ্যে সবাই পালিয়েছে??( কিছুটা বিদ্রূপস্বরে কথাগুলো বলে উঠলেন)
অনেকক্ষণ চুপচাপ পরিবেশে উপদেষ্টার কথাগুলোতে সবাই যেন কিছুটা হতচকিত হয়ে উঠলো।
প্রধানমন্ত্রীঃ আ্যঁ! হাঁ! স্যার! কি জানি বলছিলেন? কালকের মিটিং। হ্যাঁ সবাইকে খবর দেয়া হয়েছে।পরিস্থিতি ঠিক থাকলে আশা করি -সময়মতই এসেম্বলি শুরু হবে।
উপদেষ্টাঃ আর পরিস্থিতি! ওটা কি আর ভালো হয়? ছোটলোকগুলো পুরো রাজ্যটায় ছারখার করে ফেলেছে।মনে হয় একেকটাকে মাটিতে পুঁতে ফেলি। এদিকে যুদ্ধের পরিস্থিতিও ভালো নয়, সম্রাট প্রতিদিন আমাকে যুদ্ধের খরচের কথা বলে? আমি বাপু! এতো টাকা কোথায় পাবো? ওদিক পুলিশ- গোয়েন্দারাও যত্তোসব আজেবাজে খবর ও দুঃসবাদই শুধু দিচ্ছে! ( উপদেষ্টার এবারকার আক্রমণ যেন বাকি দুজনের উপর।)
গোয়েন্দাপ্রধানঃ না স্যার! (কিছুটা প্রতিবাদের স্বরে) আর অন্যকোন ডিপার্টমেন্ট তাদের কাজ না করলেও আমার ডিপার্টমেন্ট কিন্তু থেমে নেই।প্রতিদিন তারা দেশের প্রতিটি খুঁটিনাটি খবর পৌছে দিচ্ছে হেডকোয়ার্টারে। সমস্ত শ্রমিক বস্তিগুলোর আনাচেকানাচে ছড়িয়ে আছে আমাদের এজেন্টরা।তাদের কারণেই তো এখনো আমরা টিকে আছি। পুলিশ- গোয়েন্দারাই তো এখন সম্রাটের সবচেয়ে বড় শক্তি। সৈনিকরা তো দেশেই নেই,যুদ্ধ করতে করতে তারা ক্লান্ত, তারাও চাইছে না মহামান্য জারের শ্রেষ্ঠত্বের যুদ্ধ।ছোটলোক ঐ কুলাঙ্গার বলশেভিকরা তাদেরও মাথা খারাপ করে দিচ্ছে! প্রতিদিন ফ্রন্টগুলো থেকে যু্দ্ধ বন্ধের জন্য গাদা গাদা চিঠি আসছে।
উপদেষ্টাঃ কি যুদ্ধ বন্ধ করতে চায়! হারামীগুলোর এত্তো বড় সাহস! ওরা কি জার হয়ে উঠেছে যে -যুদ্ধ বন্ধ করতে বলে! এদেরকে খাইয়ে পড়িয়ে পুষছি- এসব চিঠি লেখার জন্য! মন্ত্রী মশাই- কালকেই এসেম্বলিতে বলবেন- এ যুদ্ধ চলবে।বলবেন - এটা স্বয়ং সম্রাটের নির্দেশ!
গোয়েন্দাপ্রধানঃকিন্তু স্যার! যুদ্ধের চেয়েও বড় আরেকটি দুঃসংবাদ আমার কাছে আছে,যা শুনলে হয়তো কাল এসেম্বলির আগেই মন্ত্রীমশাই শুয়ে পড়বেন!
উপদেষ্টাঃ আবার কি দুঃসংবাদ! (কিছুটা উদ্বিগ্ন,কিছুটা বিরক্ত স্বরে)। যা বলার দ্রুত বলুন- ঠান্ডাটাও যেন এবার বেশিই পড়ছে।
গোয়েন্দার এই কথা শুনে বাকি দুজনও একটু যেন কেঁপে উঠলো।
গোয়েন্দাপ্রধানঃ স্যার! আমাদের গুপ্তচররা গতকালই খবরটা পেয়েছে- বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ নিয়ে। তারা শুনেছে কয়েকদিনের মাঝেই লেনিন দেশে আসবেন!
একথা বলার পর- পুরো রুমেই যেন বোমা ফাটলো!!
পুলিশ কর্মকর্তাঃ কি! কি! বললেন আপনি?
প্রধানমন্ত্রীঃ হা ঈশ্বর! (বলেই বিলাপ করার উপক্রম হলো)
উপদেষ্টাঃলেনিন!এতকিছুর মধ্যে সে আবার কি করতে আসছে! উফ্! এসব হতভাগা বুদ্ধিজীবীগুলোকে নিয়ে আর পারা যাচ্ছে না! যাই হোক- তো সে এলে কি হবে? এতে এতো ভয়ের কি আছে?
মন্ত্রীমশাইঃ কি বলছেন স্যার! ভয়ের কিছু নেই! আজ আমাদের এই দূর্দশার জন্য এ ব্যাটাই দায়ী। সেই তো সবাইকে খেপিয়ে তুলেছে।কারখানার শ্রমিকের বাচ্চাগুলো ধর্মঘট ডেকে চলেছে তো এরই কথায়, ফ্রন্টের সৈনিকগুলো ও মহামান্য জারের কথার অবাধ্য হতে শিখেছে- এরই প্ররোচনায়।আর আমাদের? আমাদের কে সে কি ডেকেছে শুনেছেন? বলেছে- পার্লামেন্ট নাকি শুয়োরের খোয়াড়!!
উপদেষ্টাঃ কি কি!! এত্তোবড় কথা! এতো জঘন্য ভাষায় আপনাদের গালিগালাজ করলো আর আপনারা তাকে কিছুই করলেন না?
মন্ত্রীঃ করবো কি স্যার! তাকে তো খুঁজেই পাওয়া যায় না।একবার শুনি সে দেশে- কিন্তু তা কেউই জানে না।আবার যেই তাকে ধরতে গেলো- অমনি সে হাওয়া।এদিকে তার লেখা কাগজ পড়ে নিমকহারামগুলো ধর্মঘট ডেকে চলেছে,আর এদেরকেই আমরা বেতন দিই?.. শান্তির জন্য তো সৈনিকদের পাগল করে তুলেছে তো ঐ নচ্ছার বদলোকটা!!
গোয়েন্দাপ্রধানঃ( উপদেষ্টার দিকে তাকিয়ে) একটা ভুল করছেন স্যার, লেনিন কিন্তু শুধু কোন বুদ্ধিজীবী নন, তিনি শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র-সৈনিক সমস্ত আন্দোলনকারীদেরই নেতা।এটা ঠিক তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না,কিন্তু তার কথা ঠিকই পৌঁছে যায় কারখানায়,কৃষক পল্লীতে,সৈনিকদের ব্যারাকে। এটা ঠিক আমি একজন গোয়েন্দা,কিন্তু লেনিনের চালাকির কাছে সত্যিই পেরে উঠাটা ওতো সহজ নয়, তার এই ক্ষমতার গুণে সত্যিই আমি মুগ্ধ!
উপদেষ্টাঃ আরে মশাই! রাখুন আপনার লেনিনের গুণগান! এসব শোনানোর জন্যই কি সম্রাট আপনাদের মতো গোয়েন্দাদের পুষছে! এই যে পুলিশ,আপনি করছেন কি? বলি- আপনার তো চাকরি খোয়ানোর সময় হয়ে এলো! গতকালই তো সম্রাট আপনাদের উপর ভয়ংকর চটেছিলো, অনেক কষ্টে আমিই তাকে সামলিয়ে ছিলুম!(এটা বলে যেন একটু তৃপ্তি পেলো)।
পুলিশঃ(এতোক্ষন এই আলোচনার পর- বেচারা পুলিশ কর্মকর্তা যেন আরো চুপসে গেলো। তবুও আমতা আমতা স্বরে কথা শুরু করলো)
জ্বি স্যার! আমরা কি করতে পারি বলুন? আমাদের অর্ধেক লোকই তো এখন যুদ্ধে।রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করতে বাকিদের দিনরাত হিমশিম খেতে হয়। তার উপর ঐ শ্রমিক ব্যাটারা যখন ক্ষেপে উঠে, শুধু রাইফেল, গুলি,লাঠি,জলকামান কিছুই দিয়ে থামানো যায় না।জেলভর্তি শুধু বলশেভিক আর বলশেভিক! মনে হয় পুরো রাশিয়াকে জেলখানা বানালেও এতো লোক আটঁবে না।
উপদেষ্টাঃ থামুন এসব বলার জন্য আপনাকে কে বলেছে? রাজ্যের সব টাকাকড়ি তো আপনাদের পিছনেই ঢালতে হয়!
সবগুলোকে জেলে পুরুন! জায়গা না থাকলে সাইবেরিয়া পাঠিয়ে দিন,আর তা না পারলে মাটির নীচে জায়গা করে দিন!! বুঝলেন!!(হা হা হা স্বরে হাসতে লাগলেন)
মন্ত্রীঃ স্যার! সেটা না হয় পারা গেলো কিন্তু লেনিনের আসাটাকে ঠেকাবেন কেমন করে? ঐ পাজী লোকটা যদি একবার রাশিয়ায় ঢুকে পড়ে তো সব সর্বনাশ হয়ে যাবে!চাষাভুষা সব কাজ ফেলে, সৈনিকগুলো যুদ্ধ ছেড়ে আমাদের দিকেই তেড়ে আসবে! আর ঐ ছোটলোক ধর্মঘটীরা তো আছেই!
উপদেষ্টাঃ আহ হা! অতো ভয় পাবেন না তো মশাই! উপায় একটা নিশ্চয় বের করতে হবে! (একটু চিন্তা করে আবার শুরু করলো)
শুনুন- কাল এসেম্বলি তে রটিয়ে দিন যে, ঐ বলশেভিকরা হচ্ছে জার্মানদের গুপ্তচর, তাই তারা সম্রাটকে যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য চাপ দিতে চায়,আর এই কাজটা করছে ঐ ফেরারী লোকটা যে কিনা এখন জার্মানিতে লুকিয়ে আছে।আর শুনুন জনগণের মাঝে কথাটা আপনি আমি বললে কেউ বিশ্বাস করবে না,তাই মেনশেভিক কিংবা এস আর নেতাদের দিয়ে মুখ দিয়ে বলান! আর পুরো পুলিশ, গোয়েন্দা বাহিনীকে আরো সতর্ক করুন,যাতে লেনিন রাশিয়ায় পা ফেলার আগেই যেন ধরা পড়ে,তার পায়ের স্পর্শ যেন মাটিতে না পড়ে। ঠিক আছে?
আর হাঁ আপনি!( গোয়েন্দা প্রধানের দিকে তাকিয়ে) সবসময় আপনি খোঁজ নিন লেনিন কোন পথে আসবে। সমস্ত স্টেশন, কলকারখানা, শ্রমিক বস্তিতে নজরদারি বাড়িয়ে দিন,আরো গুপ্তচর কাজে নামান, চব্বিশ ঘন্টাই যেন তারা খোঁজ রাখে। মনে রাখবেন- যেকোন মূল্যে লেনিনকে আমাদের চাই,জীবিত কিংবা মৃত।
এতোক্ষণ পর যেন সবাই স্বস্তি পেলো।
মন্ত্রীঃ তাই তো বলি স্যার! কেন সম্রাট আপনার উপর এতো আস্থা রাখেন,এতো বাঘা বাঘা লোক থাকতে হুজুর কেবল আপনার কথায়ই মাথায় নেন!চলুন এই কৃতিত্বে আমরা মহামান্য জার ও তার সুযোগ্য উপদেষ্টা মহাশয়ের সম্মানে এক পেয়ালা পান করি!!
(সবাই উঠে পান করতে লাগলেন)
পুলিশঃ স্যার! আমাদের সমস্ত ইউনিটকেই আজকে রাত থেকেই অর্ডার দিয়ে দিচ্ছি! তারা যেন সমস্ত গোলাবারুদ ও ট্যাঙ্ক-কামান নিয়ে যেন রেডি থাকে!রাষ্ট্রের এতোবড় একজন শত্রু কোনমতেই যেন আমাদের হাত গলে বেড়িয়ে যেতে না পারে।
মন্ত্রীঃ একজন লোকের জন্য ট্যাঙ্ক-কামান? কি বকছেন মশাই!
গোয়েন্দা প্রধানঃ কেন ভুল কি বকলো- মাননীয় প্রধানমন্ত্রী? লেনিনকে তো আপনারা চিনেন না! সে জার্মান বাহিনীর চেয়েও ভয়ংকর!আমার তো মনে হয় তাকে রুখতে যত গোলাবারুদ লাগবে,তাও আমাদের মজুত নেই! সে তো আর একা নয়,পুরো মজদুর শ্রেণীই রয়েছে তার সাথে। তাকে ধরতে পারাটা অতো সহজ হবে বলে মনে হয় না। মনে রাখবেন জার্মানরা যতো শক্তিশালীই হোক না কেন তাদের সাথে আপোষ সন্ধি করা যায়। কিন্তু লেনিন? তার সাথে? অসম্ভব!!
গোয়েন্দা প্রধানের কথায় আবারো বিষাদময় রাত ফিরে এলো প্রাসাদের এই কামরায়।
EmoticonEmoticon