রবিবার, ৫ নভেম্বর, ২০১৭

বাকশালঃ স্বাধীনতা-উত্তর বাঙালীর রাজনৈতিক সংস্কৃতি

বাকশাল শুধু একটি রাজনৈতিক সংগঠন ও ব্যবস্থার নাম নয়। একটি সামন্ত-স্বৈরতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি, যার উদ্ভাবক আওয়ামী লীগ হলেও, এর ধারক ও বাহক বাংলাদেশের প্রায় সবগুলো রাজনৈতিক দল।

বাকশাল সংস্কৃতির মূলে আছে সংগঠনের - তার রাষ্ট্রই হোক কিংবা দলই হোক - ওপর এক ব্যক্তির অসীম নিয়ন্ত্রণ এবং সেই ব্যক্তি ও তার পরিবারের প্রতি সংশ্লিষ্ট সমষ্টির প্রশ্নহীন আনুগত্য।

যে-কোনো সংগঠনের জন্যে প্রয়োজন তার উপযুক্ত সংস্কৃতি ও বিধি-বিধান। মানব-সমাজের সর্বোচ্চ সংগঠন হচ্ছে রাষ্ট্র, যার বিভিন্ন প্রকার বিকশিত হয়েছে ইতিহাসের নানা স্তরে।

একেক প্রকার রাষ্ট্রের জন্যে একেক প্রকার রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রয়োজন হয়। কিন্তু এক প্রকারের রাষ্ট্রের সাথে যদি তার উপযুক্ত প্রকারের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অনুষঙ্গ না ঘটলে রাজনৈতিক সঙ্কট দেখা দেয়।

রাষ্ট্র-প্রকারের মূল প্রশ্ন হচ্ছেঃ সার্বভৌম ক্ষমতার ধারক কে? আধুনিক প্রকারের রাষ্ট্র হচ্ছে রিপাবলিক। রিপালিকের ডিফাইনিং ক্যারাক্টার বা মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এতে সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক সমগ্র জাতি। তাই এগুলোকে জাতিরাষ্ট্রও বলা হয়।

সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক সমগ্র জাতি, এই ধারণার মূর্তরূপ হচ্ছে এই যে, সকলের সমান সুযোগের ভিত্তিকে জনগণ তাদের নিজেদের মধ্য থেকে প্রতিনিধি নির্বাচিত করবে এবং সেই প্রতিনিধি আইনের বিধান মেনে জনগণের পক্ষ থেকে সার্বভৌম ক্ষমতার চর্চা করবে। কিন্তু একটি রিপালিকে যখন জনগণের পক্ষ থেকে সার্বভৌম ক্ষমতার চর্চা করার সমান সুযোগ সকলের জন্যে থাকে না, তখন সেটি কার্যতঃ আর রিপাবলিক থাকে না।

বাঙালী জাতির রাষ্ট্র-চিন্তকদের মধ্যে রিপাবলিকের ধারণা ও সংস্কৃতির অনপস্থিতি ছিলো বলেই হয়তো তারা রিপাবলিকের বঙ্গানুবাদ করেছেন 'প্রজাতন্ত্র'। যে তন্ত্রে রাজা নেই, সেখানে প্রজা হয় কী করে? আর, প্রজা যদি নাই থাকবে, একটি রাষ্ট্র প্রজাতন্ত্র হয় কী করে?

বস্তুতঃ যে-রাষ্ট্র প্রজাতন্ত্র, সেখানে রাজা বা রাজাসম কেউ না থেকে পারেনই না। মোট কথা, প্রজাতন্ত্র কোনোক্রমেই রিপাবলিক নয়। রিপাবলিকের বাংলা নাম হবে জনতন্ত্র।

বাকাশাল হচ্ছে প্রজাতান্ত্রিক সংস্কৃতি, যেখানে রাজা না হয়েও একজন রাজার মতো রাষ্ট্রপতি বা সরকারপতি থাকবেন এবং জনগণ প্রজা না হয়েও প্রজার মতো তাঁর দ্বারা এবং তাঁর তিরোধানে তাঁর পরিবারের সদস্যদের দ্বারা বংশানুক্রমে শাসিত হতে থাকবে।

এই মুহূর্তে বাংলাদেশে বাকশাল সংস্কৃতির মূর্ত ধারক হচ্ছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। এই দুই দলেরই দেবতাস্বরূপ নেতা হচ্ছে দুই রহমান - শেখ মুজিবুর রহমান ও জিয়াউর রহমান। প্রথম রহমান ছিলেনে বাকশালের জনক, আর দ্বিতীয় রহমান ছিলেন বাকশলের সন্তান।

বাকশাল-সংস্কৃতির রহমানী প্রকারকে আমি রহমানিজম বা রহমানবাদ বলেও কখনও কখনও নির্দেশ করে থাকি। কিন্তু রহমানবাদের বাইরেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে বাকশাল-সংস্কৃতি চর্চিত হচ্ছে।

বাকশাল রাজনৈতিক সংস্কৃতি দিয়ে বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্র চললেও বাংলাদেশ রিপাবলিক গড়ে উঠবে না। বাংলাদেশকে একটি রিপাবলিক হিসেবে গড়ে তুলতে গেলে বাকশালের প্রজাতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিপরীতে জাতীয় রিপাবলিকান রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে।

বাংলাদেশে এই সংস্কৃতি গড়ে তখনই গড়ে তোলা সম্ভব। এটি সম্ভব তখনই, যখন বাঙালী জাতির সচেতন ও শিক্ষিত অংশ এটি গড়ে তোলা জরুরি বলে উপলব্ধি করে পথের সন্ধানে গাত্রোত্থান করবে।

আমার ধারণা, বাংলাদেশে এই সংস্কৃতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক বিশ্বে বাসকরা বাঙালী জনগোষ্ঠী আর্থিক রিমিট্যান্সের সাথে-সাথে কালচার‍্যাল রিমিট্যান্সের মাধ্যমে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারবে।

০৫/১১/২০১৭
লণ্ডন, ইংল্যাণ্ড


EmoticonEmoticon