বিপ্লব নকল করা যায় না। ১৯১৭ সালের ৭ই নভেম্বরের পেত্রোগ্রাদের বিপ্লবকে ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বরে ঢাকায় নকল করতে গিয়ে সৃষ্ট হয়েছিলো তথাকথিত 'সিপাহী জনতার গণ-অভ্যূত্থান', যেখানে সৈনিকদের বিদ্রোহ থাকলেও জনগণের কোনো অংশগ্রহণই বস্তুতঃ ছিলো না।
'বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা' গড়া হয়েছিলো সৈনিকদের নিয়ে, কিন্তু সেটি পেত্রোগ্রাদের মতো শ্রমিক ও সৈনিকদের মিলিত 'সোভিয়েত' বা প্রতিনিধিত্বমূলক পঞ্চায়েত ছিলো না। ফলে, ৭ই নভেম্বরের বিপ্লবী প্রয়াস উদ্দেশ্যের দিক থেকে যাই হয়ে থাকুক, জনবিচ্ছিন্নতার কারণে রাষ্ট্রীয় প্রতিবিপ্লবে বিধ্বংসিত হয়েছে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, জাসদ ও বিএনপি পরস্পর-বিরোধী হলেও ৭ই নভেম্বরকে উভয় দলই কোনো-না-কোনোভাবে সৈনিক ও জনতার মিলিত একটা অভ্যূত্থান হিসেবে বুঝে ও বুঝিয়ে থাকে।
এই বাংলায় গণ-অভ্যূত্থান হয়েছে প্রথমে ১৯৬৯ সালে এবং সর্বশেষ ১৯৯০ সালে, যেখানে লক্ষ লক্ষ মানুষের অংশগ্রহণ ছিলো এবং তাদের লক্ষ্য স্পষ্ট ছিলো। প্রথমটিতে ছিলো প্রেসিডেণ্ট ফীল্ড মার্শাল মুহম্মদ আইয়ুব খানের পদত্যাগ এবং দ্বিতীয়টিতে ছিলো প্রেসিডেণ্ট জেনারেল হোসেইন মুহম্মদ এরশাদের পদত্যাগ।
১৯৬৯ ও ১৯৯০ সালের গণ-অভূত্থানের লক্ষ্য যথেষ্ট ছিলো কিনা, তা নিয়ে তর্ক হতে পারে, কিন্তু লক্ষ্য যে স্পষ্ট ছিলো, তা নিয়ে বিতর্ক নেই। কিন্তু ১৯৭৫ সালের তথাকথিত সিপাহী-জনতার গণ-অভ্যূত্থানের কী লক্ষ্য ছিলো, তা সাধারণ মানুষের কাছে তো দূরের কথা, এমনকি জাসদের সকল সদস্যের কাছেও স্পষ্ট ছিলো না।
১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বর বাস্তবে ছিলো সেনাবাহিনীর মধ্যে একটি ক্যুর বিরুদ্ধে আরেকটি ক্যু। আর, সে-কারণেই ক্ষমতাটা শেষ পর্যন্ত সেহাবাহিনীর হাতে - সুনির্দিষ্টভাবে, জেনারেল জিয়াউর রহমানের হাতে - গিয়েছে। সেখানে জনতার ভাগ ছিলো না, কারণ জনতার কোনো অংশগ্রহণই ছিলো না।
সেনা-অভ্যুত্থানের নেতা কর্ণেল আবু তাহের জিয়াউর রহমানকে বিশ্বাসঘাতক বলে নির্দেশ করে বলেছেন যে, তিনিই তাঁকে ক্ষমতায় বসিয়েছিলেন। কর্ণেল তাহেরের এই স্বীকারোক্তিই বলে দেয় আসলে এটি কী ছিলো। কীসের ভিত্তিতে কী উদ্দেশ্যে কর্ণেল তাহের জেনারেল জিয়াউর রহমানকে "বিশ্বাস" করেছিলেন, যার ঘাতকতা শেষোক্তজন করেছেন বলে প্রথমোক্তজন অভিযোগ করেন?
যে-কোনো রাষ্ট্র-বিপ্লবের মৌলিক প্রশ্ন হচ্ছে রাষ্ট্র-ক্ষমতা কোন উদ্দেশ্যে কার হাত থেকে কে ছিনিয়ে নিয়ে কার হাতে সংহত করবে। ১৯১৭ সালের এপ্রিলে লেনিন তাঁর বিখ্যাত 'এপ্রিল থিসিস'-এ বিষয়টির অনুপুঙ্খ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে সাধারণভাবে জনগণকে এবং বিশেষভাবে বিপ্লবী শ্রেণীসমূহ, তাদের সংগঠন ও নেতাদের প্রতি স্পষ্ট দিক নির্দেশ দিয়েছিলেন।
আমার মনে হয়, আবেগ সংবরণ করে সকল গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনাকে আমাদের বিশ্লেষণপূর্বক বিচার করা দরকার। অন্যথায় ইতিহাস থেকে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করা হবে না, যদিও নকল করার প্রয়াস হয়তো থেকেই যাবে।
৭ই নভেম্বর ২০১৭
লণ্ডন, ইংল্যাণ্ড
EmoticonEmoticon