শনিবার, ২০ জানুয়ারী, ২০১৮

ভারতীয় বর্ণবাদ ও প্রণব মুখার্জীর চেয়ার-উপবেশন

প্রণব মুখার্জীর চেয়ারটা কি দিল্লি থেকে আনা? এমনই একটি প্রশ্ন করেছেন এক ফেইসবুকার, আমাকে। এই প্রশ্নের অর্থ হচ্ছে এই যে, কাজটি প্রণব মুখার্জীর নয়, কাজটি স্থানীয় লোকদের দ্বারা কৃত।

দৃশ্যতঃ উপরের প্রশ্নটি এবং তার অর্থ যৌক্তিক বলেই মনে হয় এবং বাস্তবেও তাই। কিন্তু এখানে একটি 'কিন্তু' আছে।

লক্ষ করুন! যে-মঞ্চে একটি মাত্র রাখা চেয়ারে ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী বসে রয়েছেন এবং তাঁর দু'পাশে তাঁর চেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ-সহ নারী-পুরুষ মিলিয়ে অনেক লোক দাঁড়িয়ে রয়েছেন, তার পশ্চাৎপট লক্ষ করুন।

মঞ্চের পশ্চাৎপটে লিখা রয়েছে 'High Commission of India, Dhaka'. দেখেছেন? দেখে না থাকলে, আবার দেখে নিন।

একটি দেশের দূতাবাস যে-কোনো ভিন্ন দেশেই থাকুন না কেনো, সেটি হয় অনেকটা সার্বভৌম ভূমির মতো। একটি দেশের দূতাবাসে স্বাগতিক দেশ কূটনৈতিক সম্পর্ক বিপন্ন করা ছাড়া নাক গলাতে পারে না। এটি হচ্ছে বৈশ্বিক কূটনীতিতে স্বীকৃত বিষয়।

ভারতীয় দূতাবাসে তাদের নিজস্ব ব্যানার পশ্চাৎপটে রেখে একটি মঞ্চে একটি মাত্র চেয়ার রাখা হয়েছে এবং সেখানে প্রণব মুখার্জীকে বসিয়ে তাঁর চেয়েও পদ-মর্য্যাদায় উঁচু ও বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি-সহ নিমন্ত্রিত সকল অতিথিকে দু'পাশে দাঁড় করিয়ে ছবি তোলা হয়েছে।

তো, এই পরিস্থিতিতে অভ্যাগতদের কী করার ছিলো? পরিস্থিতির ওপর তাদের আদৌ কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিলো কিংবা থাকা সম্ভব ছিলো? তাঁরা যা পারতেন, তা হচ্ছে ওখানে না দাঁড়ানো। কিন্তু বিষয়টির তাৎপর্য্য ও ফলাফল ভাবার মতো পরিস্থিতি ও সময় কিংবা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করার সময় ও সুযোগ ছিলো কিনা?

ফলে, বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিবর্গ-সহ সকল অতিথিকে দাঁড় করিয়ে রেখে ভারতীয় দূতাবাসে ভারতীয় প্রণব মুখার্জী একটি মাত্র চেয়ার উবেশন করার মতো শিষ্টাচার বহির্ভূত কাজটির দায়িত্ব অতিথিদের ওপর চাপানো ঠিক হবে না।

ভারতীয় দূতাবাসে ঘটিত এই অকূটনৈতিক, অশালীন, অভদ্র, অসভ্য ও বর্বর আচরণের দায়িত্ব ভারতীয় দূতাবাসের। তবে, এমন একটি বর্বর পরিবেশ ও পরিসজ্জার কেন্দ্রে নিজেকে স্থাপন করার জন্যে প্রণব মুখার্জীকে ব্যক্তিগতভাবে দায়িত্ব নিতে হবে। কারণ, উপবেশনটি তিনি করেছেন।

ভারতে এখনও প্যাডেল বিহীন এক ধরণের রিকশা আছে, যাতে চালক অনেকটা টাঙ্গায় ব্যবহৃত ঘোড়ার মতো টেনে নিয়ে চলে। আজকের যুগের জন্যে এটি বর্বরদের বাহন। আজও ভারতে বর্বর মানসিকতার বাবু-বিবির এতে উপবেশন করেন, আর মানবেতর রিকশা-ওয়ালা পশুর মতো ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে তাদেরকে টেনে নিয়ে চলেন। এই হচ্ছে চক্ষু পীড়াদায়ক বৈষম্য-সংস্কৃতির দেশ - ভারত!

ভারতের এই বৈষম্য সংস্কৃতির পেছনে আছে ঐশ্বরিক বর্ণবাদ, যেখানে বিশ্বাস করা হয় মানুষ চার বর্ণে জন্মে - ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। ব্রাহ্মণগণ সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বোচ্চে এবং শূদ্ররা সর্বনিকৃষ্ট ও সর্বনিম্নে। ব্রাহ্মণগণ পূজ্য এবং শূদ্রগণ অস্পৃশ্য।

মানুষের ঐশ্বরিক বিশ্বাস আইন করে পরিবর্তন করা যায় না। ভারতে বর্ণবাদ যে কী ভয়াবহ, তা বলে শেষ করার মতো নয়। বর্ণবাদের বিষ সইতে না পেরে ভারতের সংবিধানের রচয়িতা ও পাণ্ডিত্যের জন্যে পাশ্চাত্য পূজিত প্রফেসার আম্বেদকার শেষ বয়সে ১৯৫৬ সালে তাঁর প্রায় ৫০০,০০০ অনুসারী নিয়ে প্রকাশ্যে ময়দানে বর্ণবাদী ধর্ম পরিত্যাগ করে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেন।

বর্ণবাদের আধিপত্য অবিভক্ত বাংলায়ও ছিলো। কিন্তু ১৯৪৭ সালে  হিন্দু মহাসভার জঙ্গী দাবীর মুখে ব্রিটিশ ঔপনিবেশি শাসকগণ বাংলাকে ধর্মের ভিত্তিতে পূর্ব-পশ্চিমে ভাগ করে দেওয়ার পর বাংলার দুই খণ্ডে অসম রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশ শুরু হয়।

ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে গঠিত পাকিস্তানের অংশ হিসেবে পূর্ববঙ্গের তথাকথিত স্বাধীনতা অর্জিত হলেও, বাঙালী জাতি ১৯৪৮ সালেই বুঝতে পারে, তাদের পরিচয় হচ্ছে তারা বাঙালী - হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান নির্বিশেষে তারা বাঙালী।

এই যে ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তার ধারণা, তা পূর্ববঙ্গে ১৯৪৮ সালে শুরু হয়ে, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে অতিকায় এক উল্লম্ফন পায়, যা ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রণ্টের নির্বাচন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যূত্থান, ১৯৭০ সালের স্বায়ত্ত্বশাসনের ম্যাণ্ডেইট স্বরূপ নির্বাচন এবং ১৯৭১ স্বাধীনতা-যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে স্বাধীন বাঙালী জাতিরাষ্ট্রে পরিণতি লাভ করে। ফলে, বাঙালী জাতির পূর্বখণ্ডে যে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও মনোস্তাত্ত্বিক রূপান্তর ঘটে, তা পশিমবঙ্গের বাঙালী জাতির চিন্তারও বাইরে।

পশ্চিমবঙ্গের বাঙালী জাতি বস্তুতঃ ভারতীয় জাতি-বোধের অংশ হিসেবে বিকশিত হওয়ার একটি ব্যর্থ চেষ্টা অব্যাহত রাখে। বহুজাতিক ও বহুভাষিক ভারতীয়দের এক জাতি-বোধের বাস্তব ভিত্তি কী? সংবিধানে যা-ই  লিখা থাকুক না কেনো, তার ভিত্তি হচ্ছে ধর্মীয় বোধ। আর ধর্মীয় বোধের মধ্যে যে বিশ্ববোধ ও মানবিক বোধ আছে, তাতে আছে মানুষে-মানুষে অসাম্য তথা বর্ণবিভক্তি।

বর্ণবাদের সাংস্কৃতিক পরিবেশে বেড়ে ওঠা  লোকদের কাছে উচ্চবর্ণের জন্যে উচ্চাসন সংরক্ষিত রেখে নিম্ন বর্ণের লোকদের পদতলে বসতে দেওয়া একটি স্বাভাবিক ও প্রকৃতির বিধান বলে প্রত্যক্ষিত ও বোধিত।

ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী সেই ব্রাহ্মণ বর্ণভূক্ত ব্যক্তি, যিনি সারা জীবন উচ্চাসনে বসে নিম্ন বর্ণের মানুষদেরকে পদতলে বসতে দেওয়ার সংস্কৃতিক পরিবেশ বেড়ে উঠেছেন। ভারতীয় হাই কমিশনে যারা কাজ করেন, তারাও সেটিকে স্বাভাবিক ও গ্রহণীয় হিসেবেই দেখেছেন।

ফলে, ভারতীয় হাই কমিশন যে একটি মাত্র চেয়ারে ব্রাহ্মণ প্রণব মুখার্জীকে বসতে দিয়ে তাঁর চেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ ম্লেচ্ছদেরকে আসন দান না করে, দাঁড় করিয়ে ছবি তুলে সেই ছবি তা প্রদর্শন করেছেন, তার কী অর্থহীন, উদ্দেশ্যহীন?

আমি তা মনে করি না। বস্তুতঃ এই ছবি দ্বারা তারা একটি হাইয়ারার্কি ও একটি হিজেমোনি কমিউনিকেইট করার চেষ্টা করেছেন। প্রধানতঃ ভারতের নাগরিকদের কাছে তারা এই বার্তাই দিতে চেয়েছেন, যা ছবিটি সিগনিফাই করছে।

সেমোয়েটিক্সে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যে-কোনো ডিসকৌর্স এ্যানালিষ্ট বলতে পারবেন, এই ছবির কীভাবে সিগনিফাইয়ার (signifier) হিসেবে কাজ করছে, কী বিষয়টি সিগনিফাইড (signified) হয়েছে এবং কী সিগনিফিকেশন (signification) বিকশিত করে কী মীথ (myth) তৈরি করা হয়েছে।

যাহোক, বাংলাদেশের বাঙালীদের পুরনো প্রজন্ম ব্রাহ্মণ্যবাদী হিজোমনিতে জন্ম নেওয়ার কারণে পুরনো অভ্যাসের কারণে কখনও কখনও এখনও মেনে নয়। কিন্তু বাংলাদেশের বাঙালীদের নতুন প্রজন্ম ব্রাহ্মণ্যবাদী হিজোমনিতে অভ্যস্ত নয় বলে, তাদের পক্ষে ব্রাহ্মণ্য সুপ্রিম্যাসি বা শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নেওয়া তো দূরের কথা, কল্পনা করাও সম্ভব নয়।

প্রকৃতপক্ষে ব্রাহ্মণ্যবাদী শ্রেষ্ঠত্বের প্রস্তাবনা বাংলাদেশের বাঙালীর কাছে একটি হাস্যকরে শিশুসুলভ আব্দার ছাড়া আর কিছুই নয়।


EmoticonEmoticon