এখানকার মাওবাদী লাইনের বিপ্লবীদের কেউ কেউ নতুন আলোচনা নিয়ে এসেছেন ‘সমাজতন্ত্র-কমিউনিজম নয়, নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কথা বলতে হবে’। বক্তব্য এরকমই স্মৃতি থেকে উল্লেখ করা শব্দগত কিছু ভিন্নতা থাকতে পারে। এর মধ্য দিয়ে উনারা কমিউনিজম কে অংশত খারিজ করে নয়া গণতন্ত্রের চীনা লাইন নিয়ে ব্যস্থ হয়েছেন। প্রথমে উল্লেখ করা দরকার যে মার্ক্স এঙ্গেলস এর সময়ে বিভিন্ন সমাজতন্ত্রীদের উত্থান হয়েছিল যারা মোটামুটি সমাজতন্ত্রের কথা বলতো। এদের মধ্যে বিভিন্ন ধরণের বুর্জোয়া সমাজতন্ত্রী, ইউটোপীয় সমাজতন্ত্রী ছিল। ফলে মার্ক্স এঙ্গেলস কে শ্রমিক শ্রেণীর জন্য বেছে নিতে হয়েছিল কমিউনিজম ও কমিউনিস্ট শব্দগুলো। এ নিয়ে এঙ্গেলস কমিউনিস্ট ইস্তেহারের ১৮৮৮ সালের ইংরেজি সংস্করণের ভূমিকায় এঙ্গেলস উল্লেখ করেন-
“কিন্তু লেখার সময় একে সমাজতন্ত্রী ইশতেহার বলা সম্ভব ছিল না। ১৮৪৭ খ্রীস্টাব্দে সমাজতন্ত্রী নামে বুঝাতো বিভিন্ন ইউটোপীয় মতবাদের অনুগামীদেরঃ যেমন ইংল্যান্ডে ওয়েন-পন্থী, ফ্রান্সে ফুরিয়ে-পন্থীরা, উভয়েই তখন সংকীর্ণ গোষ্ঠীর পর্যায়ে নেমে গিয়ে ধীরে ধীরে লোপ পাচ্ছিল; অন্যদিকে বুঝাতো অতি বিচিত্র সব সামাজিক হাতুড়েদের, এরা নানাবিধ পুঁজি ও মুনাফার কোনও ক্ষতি না করে সর্বপ্রকার সামাজিক অভিযোগের প্রতিকার করার প্রতিশ্রুতি দিত। উভয় ক্ষেত্রেই লোকেরা ছিল শ্রমিক আন্দোলনের বাইরে, উভয়েই চোখ ছিল ‘শিক্ষিত’ সম্প্রদায়ের সমর্থনের দিকেই। শ্রমিক শ্রেণীর যেটুকু অংশ নিতান্ত রাজনৈতিক বিপ্লবের অপর্যাপ্ততা বুঝেছিল, সমাজের সম্পূর্ণ বদলের প্রয়োজনীয়তা ঘোষণা করেছিল, সেই অংশ তখন নিজেদের পরিচয় দিত। অবশ্য এ ছিল একটা কাঁচা, অমার্জিত, নিতান্তই সহজবোধের কমিউনিজম ; তবে এতে মূলকথাটি ধরা পড়েছিল এবং শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে এর এতটা প্রভাব ছিল যে এ থেকে জন্ম নেয় ফ্রান্সে কাবে'র ও জার্মানিতে ভাইতলিং-এর ইউটোপীয় কমিউনিজম। তাই ১৮৪৭ সালে সমাজতন্ত্র ছিল বুর্জোয়া আন্দোলন আর কমিউনিজম শ্রমিক শ্রেণীর। অন্তত ইউরোপ মহাদেশে সমাজতন্ত্র ছিল ‘ভদ্রস্থ’ আর কমিউনিজম তার ঠিক বিপরীত। আর প্রথম থেকেই আমাদের ধারণা ছিল যে ‘শ্রমিক শ্রেণীর মুক্তি হওয়া চাই শ্রমিক শ্রেণীর নিজস্ব কাজ’, তাই দুই নামের মধ্যে কোনটি নেব সে সমন্ধে কোন সংশয় ছিল না। তাছাড়া আজ পর্যন্ত এ নাম বর্জন করার দিকে আমরা যাই নি”।
(কমিউনিস্ট ইস্তেহারঃ ১৮৮৮ সালের ইংরেজি সংস্করণ এর ভূমিকায় এঙ্গেলস এর লেখা)
এখন আমরা বর্তমান সময়ে কি এই শব্দগুলো ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা নেই? বর্তমান সময়ে বিভিন্ন সমাজতন্ত্রী আমরা দেখতে পাই। এদের বেশিরভাগ প্রলেতারিয়েত একনায়কতন্ত্র স্বীকার না করে সমাজতন্ত্রের কথা বলেন, শাসন ব্যবস্থায় বুর্জোয়ারা অবস্থান করেও এর নাম দেন সমাজতন্ত্র। এজন্য শ্রমিক শ্রেণীর জন্য হওয়া চাই কমিউনিজম-কমিউনিস্ট শব্দগুলো। এগুলো স্বীকার না করার অর্থ হল প্রলেতারিয়েত একনায়কতন্ত্রকে অস্বীকার করা।
এখন আসা যাক নয়া গণতন্ত্র নিয়ে। নয়া গণতন্ত্রের ধারণা রুশ বিপ্লবের পরে বিকশিত হলেও এর তাত্ত্বিক রূপ দেন মাও সেতুং। লেনিন এই ধারণা দিলেও এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন নাই বা বিস্তারিত তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দেন নাই। তবে রুশ বিপ্লবের পরে জনগণতন্ত্র নামে একটি তাত্ত্বিক ধারণা বিকশিত হয়। যার ব্যাখ্যা এরকম যে সব দেশে পুঁজিবাদ বিকশিত হয়নি, সে সব দেশ তখনো সামন্তবাদ এবং উপনিবেশ, আধা উপনিবেশ দ্বারা পরিচালিত সে সব দেশের জাতীয় মুক্তির লড়াইকে জনগণতন্ত্র বলা হয়েছে। চীনে এর নাম নয়া গণতন্ত্র। মাও সেতুং এর ব্যাখ্যা করতে বলেন-
“চীনের বিপ্লবের ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট্য হল এই যে, এই বিপ্লব দুটি পর্বে বিভক্ত, গণতন্ত্রের পর্ব ও সমাজতন্ত্রের পর্ব। প্রথম পর্বের এই গণতন্ত্র এখন আর সাধারণ ধরণের গণতন্ত্র নয়, এ এক চীনা কায়দায়, এক বিশেষ ও নতুন ধরণের গণতন্ত্র-নয়া গণতন্ত্র। তাহলে কি করে এই ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট্য দেখা দিল? বিগত একশ বছর ধরেই তা বিদ্যমান ছিল, না সম্প্রতিই শুধু তার উদ্ভব ঘটেছ?
চীনের ও দুনিয়ার ঐতিহাসিক বিকাশকে মোটামুটিভাব্র বিচার করে দেখলেই স্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, আফিং যুদ্ধের পরে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও রাশিয়ার অক্টোবর বিপ্লবের পরেই শুধু এই বৈশিষ্ট্যের সৃষ্টি হয়েছে। এখন দেখা যাক কি করে এই বৈশিষ্ট্র্যের জন্ম হল।
এটা স্পষ্ট যে, চীনের সমাজের চরিত্র যেহেতু উপনিবেশিক, আধা-উপনিবেশিক ও আধা-সামন্ততান্ত্রিক রূপকে একটা স্বাধীন, গণতান্ত্রিক সমাজে পরিবর্তিত করা; দ্বিতীয় পর্বের কাজ হল বিপ্লবকে এগিয়ে নিয়ে সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। এখন আমরা যে কাজ করছি, তা চীন বিপ্লবের প্রথম পর্বের কাজ”।
(মাও সেতুং নির্বাচিত রচনাবলী, ২য় খন্ড পৃষ্ঠা ৪৩৩)
দেখা যাচ্ছে চীনের তখনকার বাস্তবতা ছিল জাপান সাম্রাজ্যবাদী উপনিবেশ এবং আধা সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে একটি বিশেষ বাস্তবতায় নয়া গণতন্ত্রের ধারণা বিকশিত হয়েছিল। বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় এবং বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে এর বাস্তবতা কতটুকু কার্যকর? মাওবাদী দাবিদার বন্ধুরা বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে এর গভেষণাধর্মী কোন লেখা হাজির করেন নাই। চীনের তখনকার বৈশিষ্ট্র্যের সাথে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতি অর্থনীতির মিল ও অমিল নিয়ে তাঁদের বক্তব্য কই?
বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে নয়া গণতন্ত্র কতটুকু গ্রহণযোগ্য? প্রথমত দরকার বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করা যা অতীতে ভালভাবে হয়নি বা হলেও ভাসাভাসা এবং অনেক ক্ষেত্রে ভ্রান্ত। সেই জায়গা থেকে অন্য দেশের বৈশিষ্ট্য অনুকরণ কেন। বাংলাদেশ ব্রিটিশ উপনিবেশ বা পাকিস্তানি আধা উপনিবেশ পর্ব পার করে এসেছে। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন মুক্ত নয়। বাংলাদেশের অর্থনীতির বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করে বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র এবং তাঁদের অধীনস্থ কর্পোরেট পুঁজি। অন্যদিকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় দেশীয় বুর্জোয়া শ্রেণী। সামন্তবাদের অবশেষ থাকলেও রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে বুর্জোয়া শ্রেণী। ফলে বাংলাদেশের বুর্জোয়া শ্রেণী শ্রমিক শ্রেণীর মিত্র নয়। ফলে বাংলাদেশের প্রলেতারিয়েত শ্রেণীর লড়াই হবে দেশীয় বুর্জোয়া শ্রেণীর বিরুদ্ধে তেমনি সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। এজন্য আমি মনে করি বাংলাদেশের জন্য নয়া গণতন্ত্র নয় লড়াই চালাতে হবে সমাজতন্ত্রের জন্য। তা ঠিক যে পিছিয়ে থাকা পুঁজিবাদী রাষ্ট্র এবং ক্রয়িঞু বুর্জোয়া শ্রেণীর কারণে গণতন্ত্রের বিকাশ এখানে ঠিকমত হয়নি। ফলে প্রলেতারিয়েতকে ক্ষমতার কেন্দ্র ধরে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হবে এবং সাথে সাথে গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কাজ এগিয়ে নেওয়া হবে। অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্য হবে সমস্ত শিল্প এবং ব্যাংক জাতীয়করণ, ভূমি ব্যবস্থা জাতীয়, সমবায় এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যক্তি মালিকানাধীন। আস্তে আস্তে ছোট ছোট মালিকানাকে সমবায় এবং জাতীয়তাকরণের দিকে নিয়ে আসা হবে। সংক্ষেপে এটাই আশু কর্মসূচী।
EmoticonEmoticon